বাংলার বাণী
১৫ই জুলাই, রবিবার, ১৯৭৩, ৩০শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
মরক্কোর স্বীকৃতি
মরক্কোর স্বীকৃতিতে সত্য দিবালোকের মতোই উদ্ভাসিত হচ্ছে। মিথ্যা প্রচারণার আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন ক্রমশঃই। ইতিপূর্বে বাংলাদেশকে সানন্দে স্বীকৃতি জানিয়েছেন ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেন। মিশর বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার স্বপক্ষে।
মরক্কোকে নিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানালেন একশ’টি রাষ্ট্র। মরক্কো হচ্ছে একশ’তম দেশ।
মরক্কোর স্বীকৃতি বাংলাদেশের আরেকটি কূটনৈতিক সাফল্যের নিদর্শন। গত শুক্রবার রাবাত ও ঢাকা থেকে থেকে এই স্বীকৃতিদানের কথা বলা হয়। ঘোষণায় প্রকাশ, বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের জন্যে মরক্কো সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মরক্কোর স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা মরক্কো পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র। মরক্কোর রাজধানী রাবাতে বেশ কয়েকবার ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষতঃ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন রাবাতে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে পাকিস্তানী শাসকবর্গের অনুকূলে হাওয়া প্রবাহিত হয়েছিলো। বিশ্বের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের বুকে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। এর নেপথ্য কারণ হলো পাকিস্তানী অপপ্রচার। সুখের বিষয় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো সে অপপ্রচারের ঘোর কাটিয়ে উঠেছেন। ইরাক, লেবানন, ইয়েমেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মিশর বাংলাদেশকে আনু্ষ্ঠানিকভাবে শীঘ্রই স্বীকৃতি জানাবেন।
মরক্কো এমন একটা সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন যখন আলজেরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কাবুলে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষনীতিতে বিশ্বাসী। কারো শত্রুতা নয় সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এ নীতি অনুসরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ সকলের সঙ্গে প্রীতি, শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন রচনায় আগ্রহী। বাংলাদেশের এ নীতি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এতে করে পাকিস্তান যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না জানিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একঘরে হয়ে যাচ্ছে মরক্কোর স্বীকৃতি সে ইঙ্গিতই বহন করে।
টিভি কেন্দ্রে চুরি এবং অন্তর্ঘাত
আমরা যুগবৎ অবাক এবং বিস্মিত হয়েছি। বাংলাদেশ টেলিভিশন সার্ভিসের ঢাকা কেন্দ্র থেকে বেশ কয়েক লাখ টাকা মূল্যের প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ দিব্যি চুরি হয়ে গেছে। এই অভূতপূর্ব চৌরকর্মের আবিষ্কারক প্রকৌশলী আরো একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ঘাটন করে জানিয়েছেন যে, চোর শুধু অতিমূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, চোর এই অপকর্ম করে সটকে পড়ার আগে ইমেজ অর্থিকান ক্যামেরার অত্যন্ত মূল্যবান বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটটিও ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ সম্পদ চুরি এবং অন্তর্ঘাতমূলক এই ঘটনাটিকে আমরা একেবারে হেলাফেলা করে উড়িয়ে দিতে পারিনা। ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়, ইতিপূর্বেও নাকি তিন তিনবার এ ধরনের মারাত্মক চৌর্যবৃত্তি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা টেলিভিশনের কর্মকর্তারা চৌর্যবৃত্তির এই পৌনঃপুনিক ঘটনাকে পাকিস্তানপন্থী চরদের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ বলে চিত্রিত করেছেন। ঢাকা টেলিভিশনকে পঙ্গু ও স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যেই নাকি অন্তর্ঘাতীরা এই ধরনের বিধ্বংসী কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্ঘাতীরা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ কারবার করবেই এবং সে অনুযায়ী ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের ট্রান্সমিশন বিঘ্নিত করার সর্বাত্মক সক্রিয় প্রয়াসের পরিচয়ও আমরা মর্মে মর্মে পেয়েছি। জানা গেছে, এই অন্তর্ঘাতমূলক কাজের পরিপ্রেক্ষিতে টিভির প্রকৌশলীরা ত্বরিৎ উদ্যোগ এবং দক্ষতার বলে বিকল্প ব্যবস্থাধীনে গত পরশু সন্ধ্যা ট্রান্সমিশন চালু করতে সক্ষম হন।
খুবই দুঃখ ও বেদনার ব্যাপার এই যে, প্রথমবার চুরি সংঘটিত হবার পরও টিভি কর্তৃপক্ষে নিদ্রাভঙ্গ হয়নি, ফলে একাধিকবার চুরি সংঘটিত হচ্ছে এবং বলতে দ্বিধা নেই এই ধরনের চুরি রোধ করার জন্যে কর্তৃপক্ষ যদি আগে থেকেই কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, তাহলে এমন অঘটন ঘটতে পারতো না। টেলিভিশন কেন্দ্রের মূল্যবান সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে টিভি কর্তৃপক্ষের সীমাহীন ঔদাসীন্য ও খামখেয়ালীর জন্যেই যে এ ধরনের মারাত্মক চুরি এবং অপচয় ঘটছে, তাতে কোন সন্দে নেই। আমরা ভেবে শিউরে উঠছি যে, টেলিভিশন কেন্দ্রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এবং চাবি থাকে একজন সাধারণ দারোয়ানের হাতে। টেলিভিশন কেন্দ্রটি একটি সংরক্ষিত এলাকা। কিন্তু এই কেন্দ্রটির বিভিন্ন মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এই ব্যর্থতার খেসারত হিসেবেই চুরি ও অন্তর্ঘাতমূলক ক্ষতিকর কাজগুলো অবলীলাক্রমে ঘটে গেছে। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার সেনাদের প্রচার কেন্দ্র ঢাকা টেলিভিশনে যখন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা হানা দিতেন তখন তারাও লক্ষ্য রাখতেন যাতে টেলিভিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটির কোনরকম ক্ষয়ক্ষতি সাধিত না হয়। অথচ কী নিদারণ পরিহাস, স্বাধীনতার পর টেলিভিশন কেন্দ্রে একের পর এক চুরি হচ্ছে, ধ্বংসাত্মক কাজকারবার চুটিয়ে চলছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ নাকে তেল দিয়ে সুখনিদ্রা যাপন করছেন। এতো বড়ো একটা কান্ড সংঘটিত হওয়ার পরও টিভি কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটিকে পাকিস্তানপন্থী চরদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বলে আখ্যায়িত করেই যেন রেহাই পেতে চাচ্ছেন। ‘পাকিস্তানপন্থীদের’ সম্পর্কে পূর্বাহ্নে কেন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, বিশেষতঃ এ ধরনের চুরি যেখানে আরো সংঘটিত হয়েছে, সেটাই টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের জিজ্ঞাস্য।
ধর্মঘট এবং উৎপাদন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে
সরকার এক হ্যান্ডআউটে শিশুরাষ্ট্রের পুনর্গঠনের কাজে অবহেলা প্রদর্শন করে বেতন এবং অন্যান্য সুবিধাদি আদায়ের উদ্দেশ্যে চাপ প্রয়োগের নীতি অনুসরণ না করার জন্যে এবং সর্বত্র উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে দেশের শ্রমিক সমাজ ও অন্যান্য কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীগণ শ্রমিক ভাই ও অন্যান্য কর্মচারীদের প্রতি এই আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একাধিক বার সুস্পষ্টভাবে সরকারী বক্তব্য রেখেছেন—আপনারা উৎপাদন বৃদ্ধি করুন—তাহলে আপনারাই উপকৃত হবেন, লাভবান হবেন। তিনি বলেছেন, উৎপাদন বৃদ্ধি না করে কেবলমাত্র বিভিন্ন দাবী-দাওয়া পেশ করলে কিংবা বিভিন্ন সুবিধাদি আদায়ের জন্যে কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করলে কোন লাভ হবে না, দাবী পূরণ করা সম্ভব হবে না।
সংগঠন করা, দাবী পেশ কিংবা বিক্ষোভ প্রদর্শন, ধর্মঘট ইত্যাদি প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশেরই গণতান্ত্রিক অধিকার। যেহেতু আমাদের দেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ সুতরাং ধর্মঘটের অধিকার আমাদের দেশে ক্ষুন্ন করা হয়নি সে অধিকার রয়েছে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে প্রয়োজনবোধে ধর্মঘটের আশ্রয় নেয়াকে আমরা সঙ্গত মনে করি। কিন্তু তাই বলে যখন তখন যে, কোন ব্যাপারে ধর্মঘটের আশ্রয় নেয়াকে আমরা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নিতে পারি না।
আমরা জানি, বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পূর্ব প্রচলিত বেতন বা সুযোগ সুবিধাদিতে শ্রমিক ভাইদের কিংবা কর্মচারী বন্ধুদের দিনযাপন করা দারুণ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। এবং সেজন্যে তাঁদের বেতন বৃদ্ধি পাওয়া উচিত, বিভিন্ন সুবিধাদিরও ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন। তবে এই প্রয়োজন কিভাবে মেটানো যাবে তা অবশ্যই ভেবে দেখবার অবকাশ রয়েছে।
উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জন হচ্ছে অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি। সুতরাং আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে, উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে সর্বত্র। অর্থাৎ জমিতে-কলকারখানায় এমনকি অফিস-আদালতেও। এবং সর্বক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নিশ্চিত ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় পর্যাপ্ত সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন সূচিত হবে। এবং তাহলে আমাদের অভাব অনটনও দূর হয়ে গিয়ে সচ্ছলতা ফিরে আসবে। শুধু তাই নয়, তাহলে শ্রমিক সমাজ ও কর্মচারী ভাইদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া পূরণ করাও অসম্ভব হবেনা। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও যদি তখন শ্রমিক সমাজ এবং কর্মচারীদের ন্যায্য দাবী পূরণে কর্তৃপক্ষ টালবাহানা করেন তখন দাবী আদায়ের জন্যে যে কোন পথ অবলম্বন করলে অন্যায় হবে না।
সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড কৃষক শ্রমিক ও কর্মচারী সকলের প্রতি আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা, তাঁরা নিশ্চয়ই দেশের সামগ্রিক অবস্থা আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করে সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি সাধন করার পর নিজেদের দাবী পূরণের জন্যে প্রয়োজনীয় পথ বেছে নিয়ে কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করবেন এবং তার আগে অসঙ্গতভাবে অযথা চাপ সৃষ্টি করে ধর্মঘট বা অন্যান্য উপায়ে যাতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোন অসাধু পথ সযত্নে পরিহার করবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক