বাংলার বাণী
৩০শে জুলাই, সোমবার, ১৯৭৩, ১৪ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
নমপেন অবরুদ্ধ, লননলের নাভিশ্বাস
কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনের মাত্র পাঁচ মাইল অদূর থেকে মুক্তিবাহিনী নমপেন শহরটিকে ঘেরাও দিয়ে রেখেছে। প্রিন্স সিহানুক সমর্থক প্রায় একুশ হাজার মুক্তিসেনা রাজধানী নমপেনে অনুপ্রবেশের জন্যে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে লননল সরকারের সামরিক কম্যান্ড মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ রুখে দাঁড়ানোর জন্যে সমস্ত সৈন্যকে মার্কিন বোমারু বিমানের সাহায্য নিতে নির্দেশ দিয়েছে। মার্কিন বোমারু বিমানগুলো অবশ্য অনড় হয়ে নেই। মুক্তিবাহিনীর গতিবিধির উপর তীক্ষ্ম নজর রেখে চব্বিশ ঘন্টা বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে। ঐদিকে লনলন সরকার কম্যুনিস্ট মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান পর্যুদস্ত করার জন্যে দেশবাসীকে অস্ত্রধারণ করার নির্দেশ দিয়েছে। চারিদিক থেকে নমপেনকে আজ মুক্তিবাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট লননলের নাভিশ্বাস ওঠা তাই স্বাভাবিক। সম্ভবতঃ মুক্তিবাহিনীর এই রণকৌশলের মোকাবেলা করতে কম্বোডিয়ার সরকারী বাহিনীকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। নইলে দেশবাসীকে কেন এমন অবলীলাক্রমে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
কম্বোডিয়ার সরকারী পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে যে, কিছুসংখ্যক লোকজন অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম চালানোর জন্যে নমপেন শহরে অনুপ্রবেশ করেছে। এদের খুঁজে বের করার জন্যেও নাকি পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘরে ঘরে তল্লাশী অভিযান চালাচ্ছে। পক্ষান্তরে কম্যুনিস্টরা বলছে যে, নমপেনের পতনের আর দেরী নেই।
মুক্তিবাহিনী নমপেন অধিকার করার জন্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে প্রবল তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা আমরা নমপেনের কাছাকাছি এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সরকারী বাহিনীর তুমুল লড়াইয়ের খবর থেকেই পুরোপুরি আঁচ করে নিতে পারছি। জাপান এবং মার্কিন নাগরিকদের নমপেন ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং অপসারণও ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে বলে প্রকাশ। বিদেশী নাগরিকরা যখন নমপেন থেকে বিদায় নিচ্ছেন, তখন বুঝতে কষ্ট হওয়া উচিত নয় যে, নমপেনে একটা বড়ো রকমের সংঘর্ষ আসন্ন। কম্বোডিয়ার মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্যে মুক্তিসেনারা আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমরাও এই কিছুদিন আগে মুক্তির জন্যে উদ্বেগাকুল হয়ে উঠেছিলাম এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামের রক্তের দাগ এখনো মিলিয়ে যায়নি। তাই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে পিছপা হইনা। আমরা বিশ্বের প্রতিটি দেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করি। কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন অবরুদ্ধকারী মুক্তিবাহিনীর সাফল্যও আজ আমরা সঙ্গত কারণেই কামনা করি। মার্কিন বোমারু বিমান সরকারী সৈন্যদের যতোই মদদ দিক না কেন, মুক্তির সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না। মুক্তি সংগ্রামীদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা
পরবর্তী কোন নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অটোরিক্সার ভাড়া প্রথম মাইল ৬০ পয়সা এবং পরবর্তী মাইল প্রতি ৫০ পয়সা গ্রহণ করার জন্যে অটোরিক্সা চালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। সম্প্রতি অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (জেনারেল) এর চেম্বারে অনুষ্ঠিত সরকারী, কর্মকর্তা, অটোরিক্সা চালক প্রতিনিধি এবং মালিক সমিতির এক যৌথ সভায় উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। বলা বাহুল্য এই নিয়ে দু’বার অটোরিক্সার ভাড়া নির্ধারিত হলো।
রিক্সা ও অটোরিক্সা চালকদের যথেচ্ছাভাবে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের ফলে যাত্রীদের যে কি দুর্ভোগ সে খবর দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রতিটি দৈনিকে প্রকাশ পেয়েছে। বোধকরি ক্রমাগত সেসব খবর দেখে বিরক্তিবোধ করেই মাস খানেক আগে অটোরিক্সা চালকদের সঙ্গে সরকারী কর্তৃপক্ষ যৌথ সভায় অটোরিক্সার ভাড়া নির্ধারণ করেছিলেন। কয়েকদিন ধরে সে ভাড়ার তালিকা প্রতিটি দৈনিকে প্রকাশিতও হয়েছিলো। যাত্রী সাধারণ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন এই ভেবে যে, অটোরিক্সা চালকদের যথেচ্ছাচার ভাড়া আদায়ের দৌরাত্ম্য থেকে বোধকরি পরিত্রাণ পাওয়া গেলো। কিন্তু না, যাত্রী সাধারণের ভাগ্যে সে সুফল জোটেনি। বরং অটোরিক্সা চালকদের মুখ থেকে অত্যন্ত রুঢ় ভাষায় শুনতে হয়েছে ‘পত্রিকায় ভাড়ার লিস্টি দিয়েছে পত্রিকায় চইড়াই যান সা’ব ঐ ভাড়ায় আর অটোরিক্সায় চরন লাইগবো না।’ অনুরূপ ব্যাপার ঘটেছে রিক্সার ক্ষেত্রেও। বিগত এক বছরের মধ্যে কতবার যে রিক্সা ভাড়া স্থির করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সে নির্দেশ কার্যকরী করার কোন কার্যকর ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। ফলে রিক্সা বা অটোরিক্সার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা পত্র-পত্রিকার পাতাতেই পচে মরেছে।
সর্বশেষে অটোরিক্সার যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তাও অস্পষ্ট। বলা হয়েছে প্রথম মাইলের ভাড়া ৬০ পয়সা এবং পরবর্তী মাইল প্রতি ৫০ পয়সা ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু এই ভাড়া কি যাত্রী প্রতি, না রিক্সা প্রতি? অর্থাৎ একজন যাত্রী যদি এক মাইল যায় তা হলে সে ৬০ পয়সায় যেতে পারবে, না কি যেহেতু তিনজন যাত্রী (বর্তমানে) স্বাভাবিকভাবে একটি অটোরিক্সায় চড়া যায় সুতরাং তিনজন গেলেও ঐ ৬০ পয়সাতেই যেতে পারবে? এবং অটোরিক্সাগুলোতে কি মিটার সিস্টেম চালু থাকবে না প্রদত্ত ভাড়ার তালিকা অনুসারে ভাড়ার হিসাব করতে হবে তারও কোন ব্যাখ্যা নেই।
প্রথম যখন অটোরিক্সা চালু হয় তখন দেখেছি মিটার সিস্টেমে চলতো এবং একজন যাত্রী রিজার্ভ গেলে কিম্বা দুইজন (মেয়েরা তিনজন) এক সঙ্গে গেলে মিটার অনুসারে যা ভাড়া উঠতো তাই ভাড়া দিতে হ’তো। জানিনা নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে কি স্থির হয়েছে। আমাদের বক্তব্য, অবশ্য শুধু তাই নয়। আমাদের কথা হচ্ছে এই নিয়ে দু’বার অটোরিক্সার ভাড়া স্থির হলো। এর আগেও একবার স্থির হয়েছিলো, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার ফলে। এবারের সিদ্ধান্তও যদি আগের মতোই হয় তাহলে অটোরিক্সা চালকদের ভাষায় যাত্রীদেরকে ‘পত্রিকায় চড়েই’ নির্ধারিত ভাড়ায় যাতায়াতের সুবিধা ভোগ করতে হবে। যদি তাই হয় তাহলে বলবো বর্তমান যানবাহন সংকটে যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগের কাঁটা ঘায়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আর নুনের ছিটা না দিলেই কি পারতেন না? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সত্যি সত্যি যানবাহন সংকট নিরসনকল্পে নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন ও মনোযোগী হবেন কি? হলে সবাই উপকৃত হবেন, সকলের প্রত্যাশা তাই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক