বাংলার বাণী
১৩ই জুলাই, শুক্রবার, ১৯৭৩, ২৮শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
ভূমিহীনদের ভূমিদান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা দরকার
বাংলাদেশ সরকারের ভূমি ও রাজস্বমন্ত্রী জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত গত পরশুদিন সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন দেশে বর্তমানে ছাব্বিশ লাখ ভূমিহীন কৃষক রয়েছে। রাজস্বমন্ত্রী কর্তৃক দেয় এই তথ্য অনুযায়ী আমরা অবগত হলাম দেশে কি পরিমাণ ভূমিহীন কৃষক রয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা জানতে সক্ষম হয়েছিলাম দেশে কি পরিমাণ খাস জমি রয়েছে। দু’টি প্রশ্নই পরশুদিন সংসদে সম্পূরকভাবে এসেছিলো। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় প্রশ্নের উত্তর পুনরায় ঘোষণা করেছেন দেশের সকল খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্টন করা হবে। এবং মাথাপিছু দেড় একর করে জমি বন্টন করা হবে। অনতিবিলম্বেই এ কাজে সরকার হাত দেবেন বলে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে বস্তুতঃপক্ষে বহু ভূমিহীন কৃষক রয়েছে। তাদের মধ্যে বিনামূল্যে জমি বন্টন করার একটি সিদ্ধান্ত বহুদিন পূর্বে ঘোষণা করা হয়েছিলো। এছাড়া আওয়ামী লীগ অতীত রাজনৈতিক সংগ্রামের সময় জনগণকে ওয়াদা দিয়েছিলো ভূমিহীনদের ভূমি প্রদান করা হবে। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় আসীন হয়ে সেই দায়িত্ব পালনের আবশ্যকতা আজ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই ভূমি বন্টনের প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত করা উচিত ছিলো। কিন্তু তা যথার্থ করা হয়নি। এটাকে আমরা দীর্ঘসূত্রিতাই বলবো এবং এই দীর্ঘসূত্রিতার পরিণতি যে কত ভয়াবহ তাও অনুমান সাপেক্ষ। অবশ্য ইতিপূর্বে ভূমি সংস্কার মন্ত্রী ভূমিহীনদের মাঝে ভূমি বন্টনের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন। এখন উচিত হবে তা আরও দ্রুত কার্যকরী করা। কৃষকদের এই প্রয়োজনীয় দিকটি নিয়ে অযথা সময়ক্ষেপণ করা মোটেই উচিত হবে না। ভূমিহীনরা প্রতীক্ষা করে রয়েছে সরকারী ওয়াদার জন্যে। ভূমিহীনরা ভূমি পেলে তাদের যে বস্তুগত উপকার হবে তা অস্বীকার করা যাবে না। তাছাড়া খাস জমি যে অসৎভাবে ভোগ দখল হচ্ছে তারও অবসান হওয়া দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশে বিরাট সংখ্যক ভূমিহীন কৃষক রয়েছে তাদের এতোকালের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া আজ সরকারের দায়িত্ব। এরাই বঙ্গবন্ধুর সেই আসল শক্তি। যাদের ভালোবাসা আর সমর্থন নিয়েই বঙ্গবন্ধু যে কোন মহাশক্তির মোকাবেলা করতে এগিয়ে গেছেন। এদের ভালোবাসাই তাঁকে মরণজয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেছে। তাই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আজ এদের কল্যাণ কামনায় বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ আওয়ামী লীগের নৈতিক কর্তব্য। ছাব্বিশ লাখ ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে ভূমি বন্টন করা হলে আংশিকভাবে হলেও দুঃখ কষ্টের অনেক লাঘব হবে। আমরা গভীর আস্থাবান সরকার বাংলার চির অবহেলিত কৃষকদের জন্যে বাস্তব অর্থেই কিছু করবেন।
পাকিস্তানী গণমানুষের মুক্তি সংগ্রাম
প্রেসিডেন্ট ভুট্টো যাবেন আমেরিকায়। তার সেই আমেরিকা সফরের ক’দিন মাত্র পূর্বে পাকিস্তানের প্রাক্তন এয়ার মার্শাল আসগর খান সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। সম্মেলনে তিনি মার্কিনী জনগণকে পাকিস্তানের ‘স্বাধীনতাকামী মানুষের’ অনুভূতি উপলব্ধি করতে বলেছেন। বলেছেন নিক্সন সরকারের দেওয়া সামরিক সরঞ্জাম কিভাবে তাদের স্বাধিকার সংগ্রামকে দমন করবার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর মিশন সম্পর্কে তিনি বলেছেন পাকিস্তানে দমননীতি অব্যাহত রাখার জন্যে তিনি আমেরিকার কাছে সামরিক সাহায্য চাইতে পারেন এমনকি সে সাহায্য লাভে তিনি সফলও হতে পারেন কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতি কোন শুভ পরিণতি ডেকে আনবে না। মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে তিনি একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন দেবার অভিযোগ আনেন।
এয়ার মার্শাল অভিযোগ এনেছেন, অভিযোগের স্বপক্ষে নানা যুক্তি এবং দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। সবশেষে মার্কিনী জনগণের কাছে পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী ‘মানুষের’ অনুভূতি উপলব্ধি করবার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দায়িত্বশীল লোক, পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক দলের তিনি নেতা। তার দল তাহরিক এ ইস্তেকলাল কোন প্রগতিশীল গণসংগঠন নয়, পাকিস্তানে মার্কিনী লবির সঙ্গে তার খুব কম দহরম মহরম রয়েছে এমন ভাববারও কোন অবকাশ নেই। কিন্তু সত্যি কথাটা মুখ ফসকে হলেও বেরিয়ে যায়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমন সাচ্চা বয়ান বিবৃত করবার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। যেভাবেই হোক অথবা যে কারণেই হোক আসগর খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে মার্কিনী খেলের চিত্র তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায়ের চরিত্র।
এমন কথা আমরা বলেছি এবং বলেছি বহুবার। পাকিস্তানের শাসন সম্প্রদায় আজ নতুন করে নয় বরং বহু পুরোনকাল থেকেই এই আত্মবিলুপ্তির পথ বেছে নিয়েছেন। সেখানকার রাজনীতিতে বহিঃশক্তি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব চলে আসছে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। পাকিস্তানে মার্কিনী লবির অদৃশ্য এবং দৃশ্য শক্তির টানে কিভাবে সেখানকার রাজনীতিতে একের পর এক পরিবর্তন এসেছে, সীমিত গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা কিভাবে সার্বিকভাবে সামরিক গোষ্ঠী গ্রাস করেছে তা আজ আর কারও অজানা নয়। এই মার্কিনী মুরুব্বীর সঙ্গে পাকিস্তানের চক্রান্তের রাজনীতিতে অংশীদারিত্বের হস্ত সম্প্রসারণ করে চীন বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। তখন থেকে চলছে পাকিস্তানে চীন-মার্কিন যৌথ ষড়যন্ত্রের লীলা। জনসাধারণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের স্বাধিকার সংগ্রামের যে কোন প্রচেষ্টা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামরিক শক্তি বলে।
পাকিস্তানের রাজশক্তির এই পাশবিকতার সঙ্গে আমরা বাংলাদেশের মানুষ পরিচিত। বহুদিন এই পাশবিকতার মোকাবেলা আমাদের করতে হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি সংগ্রামের মধ্যেই মুক্তির সোনা সূর্যকণা নিহিত। পাকিস্তানের শোষিত মানুষ তাদের সংগ্রামী যাত্রা অব্যাহত রাখলে বিজয় তাদের অবশ্যম্ভাবী। সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা এবং পুঁজিবাদের অভিশাপাচ্ছন্ন দেশসমূহে যখন মুক্তির সোনালী সূর্য আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন পাকিস্তানের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষও যে একদিন সে আলোর সাগরে সিনান করতে সক্ষম হবে সে বিশ্বাস আমাদের আছে। আমরা সেই নিগৃহীত জনতার অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম বোধ করছি। তাদের এবং বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক অতিনিবিড়, তাদের চলার পথে রয়েছে আমাদের সমর্থন, সহানুভূতি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক