You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.12 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জাতীয় বেতন কমিশনের রিপোর্ট | আবার ফাঁড়ি আক্রমণ, অস্ত্র লুট | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১২ই জুলাই, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ২৭শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

জাতীয় বেতন কমিশনের রিপোর্ট

অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় বেতন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সরকারী, আধা সরকারী, রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারীদের বেতনের স্কেলে যে পর্বতপ্রমাণ ছিলো তা জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষিত হওয়ার ফলে অপসারিত হলো।
পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনামলে মাথাভারী প্রশাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে উপরতলার মুষ্টিমেয় কর্মকর্তাদের বেতন, বাড়ী ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধার পথটিই প্রশস্ত ছিলোনা। স্বল্পবেতনভোগী কর্মচারীদের ভাগ্যে বঞ্চনা ও লাঞ্ছনাই জুটতো। ওদের অভাব অভিযোগের প্রতি তৎকালীন শাসকবর্গ আদৌ কোন কর্ণপাত করেনি। এ পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যকে দুরীভূত করার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার ইতিপূর্বে জাতীয় বেতনের স্কেল নির্ধারণের কথা ঘোষণা করেন। অবশেষে সরকার সেই প্রতিশ্রুতিকেই বাস্তবায়িত করলেন।
সরকারী, আধা সরকারী, রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রায় ছ’লাখ কর্মচারীর জন্যে সরকার যে বেতনের হার ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষণা করেছেন তাতে সরকারকে অতিরিক্ত ৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে।
জাতীয় বেতন স্কেলে দেশের মোট ২ হাজার ২শ’ ৮টি বেতনের স্কেলকে সম্পূর্ণরূপে নতুন ভাবে ঢেলে ১০টি জাতীয় বেতনের স্কেলে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
বেতন স্কেলের নতুন হার অনুযায়ী একজন কর্মচারী সর্বনিম্ন মাসিক ১৩০ টাকা ও সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা মূল বেতন পাবেন। এছাড়া তারা চিকিৎসা ভাতা ও আবাসিক ভাতা গ্রেড অনুসারে ভোগ করবেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বর্তমানে একজন সরকারী কর্মচারী সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন পয়ষট্টি টাকা মাসিক বেতন পান।
জাতীয় বেতন কমিশন যে বেতনের হার নির্ধারণ করেছেন তা আগামী পাঁচ বছরের জন্যে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
বেতন কমিশনের মতানুসারে বর্তমানে যে আর্থিক অবস্থা বিরাজমান তাতে কর্মচারীদের পর্যাপ্ত রেশন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দেশের উন্নয়নের গতিকে অব্যাহত রাখার জন্যে এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়াপত্তনের উদ্দেশ্যে কর্মচারীদের জন্যে অবশ্যই একটি পরিকল্পিত বেতনহার থাকা দরকার। কমিশনের মতে, কর্মচারীদের মনে অসন্তোষ বিরাজ করলে উন্নয়নের গতি ব্যাহত হবে।
বেতন কমিশনের রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক কর্মচারীর আনুষঙ্গিক সুবিধাদি সন্নিবেশন করা সহ বেতন নির্দিষ্ট হবার পর সেপ্টেম্বর মাসে দেয় আগস্ট মাসের বেতন প্রদান থেকে নতুন স্কেল অনুযায়ী বেতন দেওয়া শুরু হবে এবং সম্ভব হলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন আরও আগে দেওয়া হবে। অন্যান্য কর্মচারীদের সেপ্টেম্বর অথবা আরো পরে দেওয়া হবে। নতুন বেতন স্কেল ১৯৭৩ সালের ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হবে এবং এই তারিখ থেকে বকেয়াসমূহ পরিশোধ করা হবে।
জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষিত হবার ফলে দীর্ঘদিনের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের অবসান হলো। একশ্রেণীর সুবিধাভোগী কর্মচারী সৃষ্টির সনাতনী পদ্ধতিকে অপসারণ করার প্রাথমিক রিপোর্ট অভিনন্দিত হবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মাথাভারী প্রশাসন ব্যবস্থা অচল। সকলের সম্মিলিত শ্রমের উপরেই সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। এই নতুন জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকরী করার মাধ্যমে স্বল্প বেতনভোগী কর্মচারীরা প্রথমবারের মতো বাঁচার উপযোগী মজুরী পাবেন। এ প্রসঙ্গে আমরা বলবো যে, উপরতলা বা নীচুতলার কর্মচারীদের মধ্যে বেতনের পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য ঘুচিয়ে বেতন বৃদ্ধি করলেই মূল সমস্যার সমাধান হবে বলে আমরা মনে করি না। দ্রব্যমূল্যকে স্থিতিশীল করার উপরই সমস্যার সমাধান নির্ভরশীল। বেতন কমিশন অবশ্য এ দিকটার প্রতি দৃষ্টি রেখে বেতনের হার নির্ধারণের সময় নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যমূল্যের কথা চিন্তা করেছেন। সরকারকে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করার প্রতি অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে।

আবার ফাঁড়ি আক্রমণ, অস্ত্র লুট

আলীপুরা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদলের প্রধান ছিলো অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ। সেগুলো ছিনিয়ে তারা হামলা চালায় পার্শ্ববর্তী আলীপুরা হাটে। সেখানে তারা আনুমানিক দশ হাজার টাকার মালামাল লুট করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুর্বৃত্তদল ফাঁড়ি থেকে ছ’টি রাইফেল, একটি এস.এল.আর, তিনশ’ রাউন্ড এস.এল.আরের গুলি নিয়ে পালিয়ে গেছে। ফাঁড়ি পাহারারত একজন নায়েকসহ দু’জন কনস্টেবল সাত থেকে আট জন দুর্বৃত্তের এই আক্রমণ প্রতিহত করবার কোন প্রকার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো এমন কোন খবর রিপোর্টে প্রকাশ হয়নি।
থানা আক্রমণ এবং অস্ত্রশস্ত্র লুটের ঘটনা ইদানীং কালের। স্বাধীনতাত্তোরকালে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন আয়ত্তের বাইরে ছিলো, ব্যাপক বিশৃঙ্খলা যখন সারাদেশে এবং সবচাইতে বড় কথা থানাগুলোতে যখন যথেষ্ট পুলিশ পাঠানো সম্ভব হয়ে উঠেনি তখন কিন্তু থানা আক্রমণ অথবা অস্ত্র লুটের ঘটনা জানা যায়নি। জানা যাচ্ছে সম্প্রতি যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত উচ্চকন্ঠে দাবী করছেন যে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন।
আজ শুধু উত্তরাঞ্চলের কোন থানা আক্রমণের খবর পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই খবর আসে দূর দক্ষিণাঞ্চল থেকে; সেখানেও একই ঘটনা। দুর্বৃত্তরা থানা আক্রমণ করছে; অস্ত্রশস্ত্রসহ তারা চম্পট দিয়েছে, কোথাও বা ইচ্ছেমতো শ্লোগান দিয়েছে অথবা পতাকা উত্তোলন করেছে। এদের প্রতিরোধ অথবা প্রতিহত করবার সংবাদ বড় একটা চোখে পড়ে না; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে।
থানা আক্রমণের ঘটনা কতটুকু রাজনৈতিক আর কতটুকু অরাজনৈতিক তা নিয়ে চুলচেরা হিসেব না করেও বলা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তদের তরফ থেকেই এই লুট কর্মের উপর রাজনৈতিক রঙ্গ চড়াবার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আলীপুরা থানা আক্রমণ শেষে দুর্বৃত্তরা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র জিন্দাবাদ’ এবং ‘মুসলিম বাংলা জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়েছে অথবা অন্য কোন থানা আক্রমণের পূর্বে অথবা পরে সেখানে চেয়ারম্যান মাও-এর বাণী ছড়ানো হয়েছে—এটা সব ক্ষেত্রেই যে রাজনৈতিক ‘ক্রিয়াকান্ডে’র প্রমাণ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে তা আমরা মনে করি না। তবে এটাও সত্যি কথা যে, রাজনৈতিকভাবে যারা সন্ত্রাসবাদী হিংসাত্মক কার্যকলাপে বিশ্বাসী এবং ব্যক্তি হত্যাকে শ্রেণী শত্রু বিন্যাসের অঙ্গ হিসেবে মনে করেন তারাও চুপ করে বসে নেই। আমাদের কাছে খবর এসেছে মাওবাদী কিছু উগ্রপন্থী গ্রুপ এমনকি হঠাৎ করে বনে যাওয়া ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের একটা অংশ দেশের কোন কোন অঞ্চলে ‘মানুষ খুনের’ রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে।
খবরগুলো নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। দুর্বৃত্তরা যদি অবাধে থানা-ফাঁড়ি আক্রমণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় এজেন্সীসমূহকে বে-আব্রু করে চলে যাবার স্পর্ধা দেখাতে পারে তবে সাধারণ শান্তিকামী মানুষ কাদের ভরসায় আর নিজেদের নিরাপদ বলে ভাবতে পারবে? সরকার জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে সে সরকারের উপর তাদের আস্থা যে বাড়বে না—এটাও কি লিখে সরকারকে বুঝাতে হবে? আমরা দুষ্কৃতিকারী দুর্বৃত্তদের নানা উদ্বেগজনক তৎপরতার কথা বহুবার সরকারের গোচরে আনবার চেষ্টা করেছি। বোঝাবার চেষ্টা করেছি নতুন করে নিয়োগপ্রাপ্ত পুরোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের চরিত্র। কিন্তু কোন জবাব নেই, নেই কোন প্রতিকার। থানা-ফাঁড়ি আক্রমণ আর অস্ত্রশস্ত্র লুটের যে নয়া কর্মকান্ড শুরু হয়েছে তাতে করে দেখা যাক আগামীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সময় থাকতে সতর্ক না হলে তা অনিবার্যভাবেই অধিকতর বিপদ ডেকে আনবে। আর সেই অনাগত দিনের বিপদ ছায়াকে খাটো করে দেখবার কোন অবকাশ রয়েছে বলে অন্ততঃ আমরা মনে করি না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন