You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১১ই জুলাই, বুধবার, ১৯৭৩, ২৬শে আষাঢ়, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

পাক-চীন-মার্কিন ষড়যন্ত্র

সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রের পেছনে চীন ও আমেরিকা তৎপর রয়েছে।
তিনি আরো বলেন যে, একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের পর অর্থনৈতিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সরকার এই সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সমাজ থেকে সবরকম অভিশাপ মুছে ফেলে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত জনসভায় জনাব জিল্লুর রহমান পাক-চীন-মার্কিন যড়যন্ত্র প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা নতুন করে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে।
একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছে। ‘পোড়ামাটি’ নীতি অবলম্বন করে বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশকে ঠেলে দেওয়াতে একটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিলো। একেবারে শূন্য থেকেই যাত্রা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। অথচ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীরা এ শূন্যতার সুযোগ নিয়েই জনগণের মনকে বিষিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছে এবং এখনো করছে। এশিয়া ও আফ্রিকার তথা সারা বিশ্বই আজ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশগুলো আজকের দিনে বাইরে খাদ্য রপ্তানী করতে পারছেন না। বিশেষতঃ চালের অভাব সর্বত্র। তবু সরকার সাধ্যানুযায়ী বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানী করছেন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলো খাদ্যশস্য সাহায্য করেছেন। এ হলো আজকের বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে দেশের অভ্যন্তরে একদল অতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীরা অন্যায়, অসঙ্গত ও অযৌক্তিক শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মওলানা ভাসানীর মতো বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ খাদ্য সমস্যাকে সামনে রেখে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় মেতে উঠেছিলেন।
ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীরা একদিকে সাম্প্রদায়িকতার স্বপক্ষে ও শিল্প জাতীয়করণের বিপক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই সাম্প্রদায়িকতার কবর রচিত হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণীর অতিবিপ্লবীরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে একদিকে এ অবস্থা অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চলছে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র।
সাম্যবাদী (!) চীন এখনো বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়নি। চীন একদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ‘কাগজের বাঘ’ বলে চিহ্নিত করলেও বর্তমানে চীন-মার্কিন কোলাকুলি চলছে। আর তারই সঙ্গে পোঁ ধরে পাকিস্তান এগিয়ে যাচ্ছে একটা ভয়াবহ পরিণতির দিকে। পাকিস্তানও প্রভুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়নি। একটা না একটা ঠুনকো অজুহাত সৃষ্টি করে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এ উপমহাদেশের একটা চাপা উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো গালভরা বুলি আওড়ালেও তলে তলে চীন ও মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আবার ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে মেতে উঠার স্বপ্ন দেখছে। একই কারণে ইরান মার্কিন অস্ত্র আমদানী করে পাকিস্তানের মুরুব্বি সেজে বসে আছে।
সবকিছু জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও ভারত এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখে যুক্ত ঘোষণা প্রকাশ করেছেন। যুক্ত ঘোষণায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাবার বিষয়ে কোন বক্তব্যই রাখা হয়নি। এ উদারতার পরিচয় বাংলাদেশ দিয়েছেন এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই। পাকিস্তান কিন্তু তবু এগিয়ে আসেনি। পাকিস্তান এখনো মুসলিম বাংলার স্বপ্নে মশগুল। পাকিস্তানী শাসনতন্ত্রে এখনো ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি রয়েছে।
ঘরে-বাইরে এ হলো আজকের বাস্তব অবস্থা। এ অবস্থার মোকাবেলা করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে একতাবদ্ধ হতে হবে। সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে অতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে নস্যাৎ করা সম্ভব হবে—অন্যথায় নয়।

অমীমাংসিত মামলাগুলোর নিষ্পত্তি চাই

সমগ্র বাংলাদেশে তিন লক্ষ একশত আটচল্লিশিটি মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলছে। গত পরশু আইনমন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধর জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। সংসদ সদস্য জনাব আলী আশরাফের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী ফৌজদারী কোর্ট, জজকোর্ট ও জনাব সিরাজুল হকের এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সংসদকে সুপ্রীম কোর্টে বিচারাধীন মামলার একটি পরিসংখ্যান প্রদান করেছেন। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, সুপ্রীম কোর্টে পাঁচ বছর ও তার ঊর্ধ্বকাল যাবত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা হলো নয় হাজার ছত্রিশটি। মন্ত্রী মহোদয় আরো জানিয়েছেন যে, স্বাধীনতার পর সুপ্রীম কোর্টে দু’হাজার আটশ’ চৌত্রিশটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, হাইকোর্ট ডিভিশনে দৈনিক গড়ে একুশটি মামলা দায়ের করা হয় এবং দৈনিক এগারোটি মামলা শুনানীর পর নিষ্পত্তি হয়। বর্তমানে হাইকোর্ট ডিভিশনে এগারো জন বিচারক রয়েছেন এবং এর মধ্যে একজন বিচারক শ্রম আপীল আদালতে সদস্য হিসেবে নিযুক্ত আছেন বলে মন্ত্রী মহোদয় জানিয়েছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি সহ পনেরো জন বিচারপতি ছিলেন। তুলনামূলকভাবে বর্তমানে হাইকোর্টে ডিভিশনে বিচারকের সংখ্যা কম।
সারাদেশের বিভিন্ন কোর্টে প্রায় তিন লক্ষ মামলা অমীমাংসিত রয়েছে। এইসব অমীমাংসিত মামলায় যারা জড়িত রয়েছেন, তাদের যে যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, দেশের বিভিন্ন কোর্টে বিচারাধীন মামলার মধ্যে জজকোর্টে অমীমাংসিত মামলার সর্বোচ্চ সংখ্যা ২৭,৭১২টি হলো ঢাকা জেলায়। এরপরেই ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায়। অমীমাংসিত মামলাগুলোর বিচার শেষ করতে কতদিন সময় লাগবে এ প্রশ্নে জবাবে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, বিচারকদের সংখ্যা, মামলা নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, মামলা পরিচালনাকারী এ্যাডভোকেটদের প্রস্তুতি এবং মামলার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে। আইনমন্ত্রীর জবাবের মধ্যে একটি জিনিস সুস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে যে, দেশে বিচারকের সংখ্যার স্বল্পতা রয়েছে এবং যে কোন মামলার বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য এ্যাভভোকেটের তৎপরতা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া বিষয়বস্তুর জটিলতার কারণেও অনেক সময় অনেক মামলা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলতে থাকে। কিন্তু বেশীরভাগ মামলাই যদি দিনের পর দিন এমনি করে বিচারের অপেক্ষায় দিন গুণতে থাকে, তাহলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। মামলায় জড়িত ব্যক্তিরা অহেতুক হেস্তনেস্ত হয়। এমনও দেখা যায় যে, আসামী শেষ পর্যন্ত লঘুদন্ড পেলেও, দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাকে নানা রকম অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। সেজন্যেই, কোন মামলাই দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা উচিত নয়। মামলা জিনিসটা এমনই যে, যতো তাড়াতাড়ি এর নিষ্পত্তি করা যায়, ততোই মঙ্গল। কারণ, মামলায় জড়িত ব্যক্তিরা এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার শিকারে পরিণত হন—যা কেবল ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে সক্ষম। জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী শ্রী মনেরঞ্জন ধর সারাদেশের বিচারাধীন মামলার যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তাতে আমরা অবাক বা বিস্মিত হইনি। তবে তিন লক্ষাধিক মামলার বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে রয়েছে এটাকে আমরা খুব একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার বলে অভিহিত করতে পারি না। আমরা আশা করি, দিনের পর দিন মামলার জঞ্জাল আর না বাড়িয়ে বিচারাধীন মামলাগুলো যতো তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করা সম্ভব সে জন্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। নইলে দেশের বিচার বিভাগের জটিলতা বাড়বে ছাড়া কমবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!