বাংলার বাণী
১লা মার্চ, ১৯৭৩, বৃহস্পতিবার, ১৭ই ফাল্গুন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী গত মঙ্গলবার লোকসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সম্মতি ব্যতিরেকে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিদানের প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন।
লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর পাঁচ দিনব্যাপী আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়া সম্পর্কিত যে কোন অজুহাত অযৌক্তিক ও অবাস্তব হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং তাকে সেভাবেই বিবেচনা করতে হবে। যারা পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের কথা বলছেন তারা পাকিস্তানে আটক চার লক্ষ বাঙালীর কথা ভাবছেন না।
শ্রীমতী গান্ধী সিমলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার পর পরই ঠিক একই কথা বলেছিলেন। শ্রীমতী গান্ধীর বক্তব্য স্পষ্ট। কোন ঘোর প্যাঁচ নেই। বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নাও। তারপর সব সমস্যার সমাধান হবে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও জল্লাদ শিরোমণি ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, আগে স্বীকৃতি তারপর আলোচনা। এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়া প্রয়োজন।
কথায় বলে চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। ভুট্টো সাহেবের অবস্থাও হয়েছে তাই। ভুট্টো সাহেব অনেকবারই অনেক কথা বলেছেন। এমনকি বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে না নিলে বিশ্বের চোখে ‘একঘরে’ হতে হবে একথাও ভুট্টো সাহেব বলেছিলেন। সেই ডিগবাজী বিশারদ ভুট্টো সাহেব সর্বশেষ যে বক্তব্য পেশ করেছেন তা হলো—বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারি তবে দু’টো শর্ত। এক, পাক যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দিতে হবে। দুই, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা চলবে না।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে ভুট্টো সাহেব ইদানীং আবার তাঁর বোলচাল বদলেছেন। বর্তমানে অন্য সুরে গান গাইছেন। অবশ্য সানাইয়ের অদৃশ্য সুরের কেন্দ্রবিন্দুটি হলো পিকিং। ভুট্টো সাহেবের স্ত্রীর পিকিং সফরের পরই কিন্তু অন্য সুর ধরেছেন। বলা যায়না হয়তো চীনের কাছ থেকে কোন কিছুর আভাসও পেয়ে থাকবেন।
মার্কিন মুল্লুকের টাইম পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুট্টো সাহেবের যে বক্তব্য বেরিয়েছে, তার উল্লেখ করে ওয়াকেবহাল মহল থেকে বলা হয়েছে যে, পাক-প্রেসিডেন্ট বহুদিন ধরেই পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা বলে আসছেন।
ভুট্টো সাহেব ঝোপ বুঝে কোপ মারতে চান। কিন্তু কোপ মারার আগে যে তিনি নিজেই কোতল হয়ে যাবেন সে কথা ভেবে দেখার সময় তাঁর নেই। পাকিস্তান আজ ঘরে-বাইরের সমস্যা সংকটে জর্জরিত। পাকিস্তানী শান্তিকামী জনসাধারণের পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে বাংলাদেশের সঙ্গে সকল বিরোধ মিটিয়ে ফেলার। তাছাড়া পাকিস্তানী জনসাধারণ একাত্তর সালের নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞের জন্য খুনী ইয়াহিয়ার বিচার দাবী করছে। তাঁরা মনে করছেন এতে অন্ততঃ তারা জাতীয় কলংকের হাত থেকে রেহাই পাবেন।
ভুট্টো সাহেব অবশ্য সোজা পথে চলার পাত্র নন। তিনি যুদ্ধবন্দীর প্রশ্নটিকে একটি মানবিক সমস্যার রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতকে হেয়প্রতিপন্ন করতে উদগ্রীব। অথচ এটা তিনি বুঝতে পারছেন না যে, পাকিস্তানে চার লক্ষ নিরীহ ও নিরপরাধ বাঙালীকে ‘জিম্মি’ রূপে আটকে রেখে মানবতা বিরোধী কাজটুকুই করে যাচ্ছেন।
ভুট্টো সাহেব শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যতই চেষ্টা করুন না কেন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। তাছাড়া চার লক্ষ নিরীহ নিরপরাধ বাঙালীকে আটকে রাখার ক্ষমতা ভুট্টো সাহেবের নেই।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুবার বলেছেন, যারা বাংলাদেশের বুকে গণহত্যা চালিয়েছে তাদের ক্ষমা করা যায় না।
একথা শুধু প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নয়—একথা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর।
এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভারত ইচ্ছে করলেই যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিতে পারেন না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী সে কথাই পুনরায় দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন।
আরো একটি আব্দার তার
না ওদের বিচার করা যাবে না, এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে ওদের সুকোমল অনুভূতিতে এতটুকু আঘাত লাগে। ঘি-অন্নে মানুষ। চিরদিন সেই ঘি-অন্নের সংস্থানেই নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন, যারা বাংলার মানুষের অস্থিচর্মসার দেহটাকে খতিয়ে-খুচিয়ে যতটুকু সারপদার্থ বেরিয়েছে তাতে ওদের ঠাট-বাট, চলন-চালন ঠিকই চলেছে। গোল বেঁধেছে ইদানিং। ওনারা এখন শ্রীঘরে। ঘি-অন্নের ব্যবস্থা নেই, নেই সুরা-সাকীর ‘অনাড়ম্বর’ আয়োজন। কিন্তু তাতেও গোস্বা তার। এতদিনকার জানি দোস্তদের তিনি এতটুকু অসম্মান হতে দিতে রাজী নন।
মার্কিন মুল্লুকের কাগজ টাইমসে একথা বয়ান করেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। বিগত স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, মদদ জুগিয়েছেন ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে, দু’লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানি করতে যাদের সুকোমল হৃদয়ে এতটুকু বাঁধার সৃষ্টি হয়নি সেই সবুর খান, ফজলুল কাদের গংদের বিচার না করার জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। ভুট্টো বন্ধুবৎসল। বন্ধুর দুঃখে তিনি অশ্রু ঝরিয়েছেন, বিপদের দিনে যে বন্ধু তার ইয়ারদোস্তদের কথা স্মরণে রাখেন তিনি নিঃসন্দেহে একজন কীর্তিমান পুরুষ।
তাঁর কথাই বা বলি কেন? বাংলাদেশেও সেই সবুর, ফজলুল কাদের গংদের বন্ধু রয়েছেন, রয়েছেন রাজনৈতিক দোসর। এরা যে অপরাধে অপরাধী সেই একই অপরাধের অভিযোগ রয়েছে এমন অনেকের মুক্তি চেয়ে বাংলাদেশেরই কোন কোন বয়ঃবৃদ্ধ নেতা তারস্বরে চীৎকার করছেন। দাবী জানাচ্ছেন মশিউর রহমান, ফজলুল হক প্রমুখের মুক্তিদানের। ভুট্টোর সাথে এই সকল বয়ঃবৃদ্ধ নেতার নানা চুক্তি-যুক্তি চলতো সেই অতীত কালে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালেও এদের চিন্তা-চেতনা, দাবী-দাওয়ার যে অদ্ভূত সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা সত্যি চমকপ্রদ।
যে গণদুশমনদের বিচার হবে, হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেকের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অন্যথা হবার কথা নয়। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছেও তেমন। সে ইচ্ছের বিপরীতে কাজ করতে পারেন এমন শক্তিশালী দেবতার সন্ধান রয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ভুট্টো সাহেব আব্দার করেছেন। এমন আব্দার তিনি হরহামেশাই করেন। কিন্তু বাংলাদেশে বসে সে আব্দারের রসদ জোগানে সেটা যে কতটুকু লজ্জাকর সে কথাটা কি প্রবীণ অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতারা একবার ভেবে দেখবেন?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন