You dont have javascript enabled! Please enable it!

১০ মে ১৯৭১ সর্বশেষ কম্যান্ডার মেজর নাজমুল হকের সাক্ষাতকার প্রকাশিত

এই দিনে মার্কিন পত্রিকা নিউজ উইক এ সেই সময়ের ৪ নং পরবর্তীতে ৭ নং সেক্টর কম্যান্ডার মেজর নাজমুল হকের সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। একে একে যখন সকল জেলা এবং মহকুমা শহরের পতন হয়েছিল ঠিক সেই সময়ে এই প্রতিবেদন সারা বিশ্ব এ আলোড়ন তুলেছিল। মিলান জে কিউবিক এর প্রতিবেদনটি ছিল হকস রেবেলিওন নামে। সেই নিবন্ধে কিউবিক বলেন, গেল সপ্তাহে আমি ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন ৪ কিলোমিটার ভিতরে একটি গ্রামে এক কৃষকের বাড়িতে সাধারন বাঙালি পোশাক পরিহিত অবস্থায় বাঙালি লিবারেশন আর্মির কম্যান্ডার মেজর নাজমুল হকের দেখা পাই। তার সঙ্গে এটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ। প্রথম সাক্ষাতেই তাকে আমার কাছে বুদ্ধিদীপ্ত, দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং আশাবাদি মনে হয়েছে। তার রন কৌশলের বর্ণনা এবং সহজ আলাপচারিতায় বার বার উথে এসেছে চূড়ান্ত বিজয়ের ছক। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি শঙ্কামুক্ত এবং পাক হামলায় তিনি ভিত নন। হকের মুক্তাঞ্চল আমি পরিভ্রমন করেছি তার উইলিস জীপের দীপ্ত পদচারনায় মনে হয়েছে এ যেন বিজয়ী মুক্তাঞ্চল। এই এলাকার বেশীর ভাগ নারী পুরুষ শিশু ভারতে শরণার্থী। এদেশে এখন নিত্য পণ্য এর গুদাম জাত চলছে। কদিন পর কোন ঔষধ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তার সাথেই ছিল তার রিক্রুট প্রধান ২৪ বছর বয়সী শাহ আব্দুল মালেক। তাকেও হকের মতই মনে হল। তার বাহিনীতে আছে সেকেলে ৩০০০ রাইফেল আর শ খানেক মর্টার। ভারতীয় করতিপক্ষের সাথে তখনও হকের সংযোগ হয়নি। তিনি অবশ্য জেনেছেন ভারত ইতিমধ্যেই সাহায্য দেয়া শুরু করেছে। তার (তিনি সাপাহার থানায়) নিকটতম কম্যান্ডারের (ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহী) দুরত্ত ৩৫ কিমি। তিনি এখনই ভারত চলে গেলে মুক্তিযুদ্ধে ভাটা পড়বে। হক তাকে বলেছিলেন আপনি ৪ মাস পরে আসলে এ চিত্র আর দেখতে পাবেন না। হক বুজাতে চেয়েছিলেন ৪ মাস পরেই স্বাধীনতা অর্জন হবে।

নোটঃ
মেজর নাজমুল হক, (১৯৩৮-১৯৭১) সামরিক কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার। জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামের লোহাগড়া থানার আমিরাবাদ গ্রামে। পিতা হাফেজ আহমেদ ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। মাতা জয়নাব বেগম। নাজমুল হক কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নকালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর ৪৩ লাইট এন্টি-এয়ারক্র্যাফট রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। চাকুরিকালে তিনি বিভিন্ন আর্টিলারি ইউনিট, সেনাসদর ও গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
নাজমুল হক ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ রাজশাহীর নওগাঁস্থ ৭নং উইং ইপিআর-এর উইং কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৬ মার্চ নওগাঁতে তাঁর নেতৃত্বে সৈন্যরা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। তখন থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মূলত তাঁর নির্দেশনায় রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় ইপিআর ও জনগণ পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মেজর নাজমুল হককে রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলের আঞ্চলিক অধিনায়ক নিযুক্ত করে। জুলাই মাসে সেক্টর গঠন করা হলে তিনি ৭নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ১০ মে নিউজ উইক পত্রিকায় Haq’s Rebellion শিরোনামে নাজমুল হকের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এটি প্রচারের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপক প্রচার লাভ করে। নাজমুল হক ও তাঁর সাব-সেক্টর কমান্ডারগণ ৭নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত সোনা মসজিদ এলাকা, কানসাট, শিবগঞ্জ, আরগরারহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় অপারেশন চালিয়ে সাফল্য অর্জন করেন।
মেজর নাজমুল হক ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোরের সদর দফতর শিলিগুড়িতে ভারতীয় ও বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তাদের এক সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনে তিনি ৭নং সেক্টরের অপারেশনের সাফল্য, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সেক্টরের সমস্যাগুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেন। সম্মেলন শেষে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ফেরার পথে জীপ দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। ঐতিহাসিক সোনা মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মেজর নাজমুল হকের নামে ১৯৮৭ সালে তাঁর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ নাজমুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাঁর নামে ঢাকায় গুলশানের ৭১ নং সড়কের নতুন নামকরণ হয়েছে। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!