You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৭ই মার্চ, ১৯৭৩, বুধবার, ২৩শে ফাল্গুন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

সেবার ছিল স্বাধীনতার ডাক এবার দেশ গড়ার

আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। আজ সেই ঐতিহাসিক সাতই মার্চ। যেদিন বাঙালী জাতিকে নতুন সংগ্রামের জন্যে ডাক দেওয়া হয়েছিলো। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালী জাতির প্রতি এটাই ছিলো প্রথম আহ্বান বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে। অন্যদিকে পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর কড়াল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবার জন্যে ১৯৭১-এর সাতই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ডাক ছিলো নতুন সংগ্রামের পথে জাতিকে এগিয়ে নেবার। আজ ১৯৭৩-এর ৭ই মার্চ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভবিষ্যত ইতিহাসে এ দিনটির একটি বিশেষ মূল্য থাকবে। শত শত বছর পরেও জাতি নতুন প্রত্যয় নিয়ে অতীতের এ দিনটি’কে স্মরণ করবে। ঐতিহাসিক রক্তাক্ত বিপ্লবের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। মরণপণ সংগ্রামের বহু পরীক্ষিত রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের এক বিস্ময়কর গণসমর্থিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সারা জীবনের সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলা আর বাঙালীর মুক্তি। এই মুক্তির সংগ্রামের জন্যে তিনি বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। মৃত্যুকে ভ্রুকুটি হেনে বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর সাধনা ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। তাঁর সুমহান আদর্শ ও নেতৃত্বেই হয়েছে বাংলার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত। তাঁর স্বপ্নকে সামনে রেখেই লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ অকাতরে তাদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা আজ স্বাধীন। তাঁর এই স্বপ্নের বাংলার স্বাধীন বিকাশেই তিনি ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর বৃদ্ধ বয়সের সকল অবশেষ শক্তি দিয়ে একে সোনার বাংলা গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। আর সেই কারণেই তাঁর প্রতি দেশবাসীর নিরঙ্কুশ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তিনি স্বাধীন দেশে নতুন নির্বাচন দিয়েছেন। সকল বিরোধী দলগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছেন পরিষদে এসে দেশের সেবা করার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছা দুখী বাংলাকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করার। বহুযুগ ধরে বহু শতাব্দী ধরে বাংলাদেশ শুধু নিজেকে বিলিয়েই দিয়েছে—পায়নি কিছু। এদেশের মানুষ শুধু সেবাই করেছে অপরের—প্রতিদানে পেয়েছে শুধু ঘৃণা-অবহেলা। বাংলার সম্পদ যুগে যুগে লুট করে নিয়ে অন্যরা হয়েছে বিত্তশালী—আর এ জাতিকে সুপরিকল্পিত উপায়ে ভিখেরীতে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। স্বাধীনতার রক্তিম সুর্য হাতে পেয়ে আজ স্বভাবতই দায়িত্ব এসে গেছে—এদেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। একটি আদর্শ জাতি হিসেবে বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর মাঝে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর সে কারণেই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী পার্লামেন্ট। আদর্শবাদী সরকারের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই সরকার ঘোষণা করেছিলেন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুনর্বাসনের কাজ যতদূর সম্ভব ত্বরান্বিত করে দেশে সাধারণ নির্বাচন দেওয়া হবে। সরকার দেশে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মহান ব্রত বাস্তবায়নের জন্যেই নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট আশা করেন। এই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সরকার তাঁর বিগত ক্ষমতাসীন চৌদ্দ মাসের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর একটি অন্যতম সাধ ছিলো জাতির জন্যে সংবিধান প্রণয়ন করা। তিনি তাঁর সাধ বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। বিপ্লবোত্তর নয় মাসের মধ্যেই শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়েছে যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাসের তুলনায় একটি অনন্য ঘটনা। একটি মহান আদর্শকে অনুসরণ করে সংবিধান রচনা করা হয়েছে। এদেশের মানুষের ভাগ্য বর্তমান ও ভবিষ্যতে কি হবে? কোন্ নীতির নিয়মে জাতি পরিচালিত হবে? মানুষের অধিকার ও কর্তব্য কি হবে? আদৌ দেশের অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে গড়ে উঠবে কিনা? ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্নের সুন্দর সমাধান ও নিশ্চয়তা রয়েছে আমাদের সংবিধানে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই চারটি মূল রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তিতে সংবিধান রচিত। আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারী ছাত্র-রাজনৈতিক সংগঠনগুলো একে মুজিববাদ একটি মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এবং তাদের সাংগঠনিক ঘোষণা : যতদিন দেশে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠিত না হয় ততদিন তাদের সংগ্রাম নিরলস গতিতে চলবে। আজকের এই ঐতিহাসিক নির্বাচন তাই তাদের ভাষায়—মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার স্বপক্ষে জাতির ম্যান্ডেটস্বরূপ। এ মহান সংগ্রামের পথে আজকের রায় হবে তাদের চলার পথের অন্যতম প্রধান পাথেয়।
গোটা জাতি আজ তার স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করছে ভোটের মাধ্যমে। এই নব প্রতিষ্ঠিত দেশের সরকার কে বা কারা পরিচালনা করবে আজই দেশের আপামর জনসাধারণ তা নির্ধারণ করছে। আজ তাদের সামনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নৌকা, কুঁড়েঘর, ধানের শীষ, মশাল। বঙ্গবন্ধু দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি—প্রাণের চেয়েও প্রিয় নেতা। তিনি নিজে প্রতিটি অঞ্চলে গিয়ে জনতার সঙ্গে কথা বলেছেন—ভোট চেয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণঢালা সম্বর্ধনা পেয়েছেন—প্রদীপ্ত কন্ঠে বলেছেন—‘আমি আমার নৌকায় ভোট চাই, সোনার মানুষ চাই, সোনার বাংলা আমি গড়তে চাই।’
ইতিপূর্বে নির্বাচনী কমিশনার ঘোষণা করেছেন, দেশে সাধারণ নির্বাচনের জন্যে আবশ্যকীয় সকল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যে সরকার সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন। আমরা আশা করি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন হবে। নির্বাচনে অবতীর্ণ অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রতি আমরা আমাদের আন্তরিকতা প্রকাশ করছি। এই সঙ্গে দেশের দুখী মানুষের কাছে আমরা আমাদের সালাম জানিয়ে বলবো : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনদিন বন্দুকের নলকে ক্ষমতার উৎস মনে করেন না, তিনি জনগণকেই ক্ষমতা উৎস হিসেবে জানেন। তাই আপনাদের রায়ই গণতন্ত্রের শেষ কথা। আজকের এই নির্বাচনে আপনাদের রায়ই হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার যাত্রাপথের পাথেয়। সেদিনের সাতই মার্চের ডাক ছিলো জাতিকে নতুন সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার অবিস্মরণীয় দিন। আর আজকের এই ঐতিহাসিক সাতই মার্চ থেকে শুরু হবে এদেশে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার মহান সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার নতুন পদক্ষেপ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!