বাংলার বাণী
৫ই মার্চ, ১৯৭৩, সোমবার, ২১শে ফাল্গুন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
ভোটাধিকার প্রয়োগের গুরুত্ব
নির্বাচন সমাসন্ন। সময় বাকী একদিন। পরশু স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছেন দেশের সবকটি রাজনৈতিক দল। জোরে শোরে প্রচার চলেছে। নিজ নিজ দলের প্রার্থীদের নিয়ে সমর্থকরা মিছিল, শোভাযাত্রা এবং জনসংযোগের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। অধিকাংশ আসনের ফলাফল সম্পর্কে মোটামুটি একটা আঁচ পাওয়া গেলেও এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে নির্বাচনী ফলাফলের প্রতি দেশবাসীর বেশ সাগ্রহ প্রতীক্ষা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক কথায় নির্বাচন স্বাভাবিকতা ও সুষ্ঠুতার সীমা সরহদ্দের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো উন্মুখ হয়ে রয়েছে গণদেবতার রায় জানবার জন্য।
অথচ বাংলার বাইরে তাবৎ দুনিয়ার মানুষের কাছে এটা বেশ বিস্ময়কর বলে অনুভূত হচ্ছে। এ ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণে প্রায় নিঃস্ব একটা জাতি এই সেদিন যুদ্ধের ভয়ঙ্কারিতা প্রত্যক্ষ করে স্বাধীনতা লাভ করলো। ত্রিশ লক্ষ শহীদ সেই বীভৎস যুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়ে জনগণের যে মুক্তি সোপান রচনা করলো সেই বিধ্বস্ত দেশটি যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে কেমন করে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ বেছে নিলো। স্বাধীনতা সংগ্রামকালে যেখানে ছিলো স্বাধীনতা বিরোধী ধ্বংসাত্মক শক্তি, হাতে হাতে ঘুরতো যেখানে স্বয়ংক্রিয় সব মারাত্মক অস্ত্র সেখানে বুলেটকে তুচ্ছ করে ব্যালটের উপর নির্ভরশীলতা কেমন বেমানান নয় কি? সব দেশে সব স্থানে সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে যে একনায়কত্ব অস্ত্রের মহাজনী নিয়ে ক্ষমতার আসনে জেঁকে বসে বাংলাদেশের ব্যাপারেও তেমনটি হবে—একটা ছিলো অনেকের কল্পনা। কিন্তু তা হয়নি, ইতিহাসের সকল নজীর, পূর্বসুরীদের সকল আশঙ্কাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের শুভক্ষণেই ঘোষণা করলেন একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণের কথা। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রণীত হলো শাসনতন্ত্র। আর সেই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশ মুক্ত হবার মাত্র চৌদ্দ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন।
আসল কথা জনগণের উপর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের আস্থা ও সম্মানবোধ। জনগণই দেশের মালিক; একবার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলেই যারা নিজেদের দেশের মালিক মোক্তার মনে করেন তারাই ভয় করেন গণতন্ত্রকে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা তথা গণরায়কে। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বরাবর ছিলো জনগণের সাথে, জনগণের পাশে। জনগণ এ দলের শক্তি, জনচেতনার প্রতিফলনই এ দলের মৌলিক আদর্শ। এর সকল কর্মসূচী জনগণের অগ্রযাত্রাকে সামনে রেখে, তার সমৃদ্ধতর ভবিষ্যত গড়ার প্রয়াসই তার ব্রত। যাদের নিয়ে তার পথচলা, যারা এ দলের শক্তি বিপ্লবোত্তরকালে তাদের কাছেই আবার আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে, এ দলের চরিত্র সম্বন্ধে যারা পরিপূর্ণভাবে ওয়াকেবহাল তাদের কাছে এটা বিস্ময়কর ঠেকবেনা।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ স্বাদ বাংলার মানুষ উপভোগ করতে পারেনি কিন্তু নির্বাচনী অভিজ্ঞতা তাই বলে এদের কম নেই। তা নির্বাচনের মাধ্যমে তারা তাদের রায় জানিয়ে দিয়েছিলো চুয়ান্নতে, সত্তরে। গণদেবতার সে নির্দেশকে যারা পদদলিত করার প্রয়াস চালিয়েছিলো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে তারা নিক্ষিপ্ত করেছে। এবারও নির্বাচন হবে সেই গণরায়কে যাচাই করবার জন্যই। তারা যে রায় দেবেন দেশপ্রেমিক গণসংগঠনসমূহ তা মেনে নেবেন। শুরু হবে নতুন পথে চলা। সামনে বিপদসঙ্কুল পথ, এ পথে পাড়ি জমিয়ে আমরা পৌঁছবো সমৃদ্ধতর জগতে। শোষণহীন সুখী সে সমাজ, যা গড়ার দায়িত্ব আমাদের উপরে।
ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে তাই আমাদের অধিকতর কর্তব্য-সচেতনতা প্রদর্শন করতে হবে। অতীতে অবশ্যই আমরা যে কর্তব্য পালন করেছি সফলতার সঙ্গে, এবারও করবো। ঐক্যবদ্ধ একটা জাতির ভাবমূর্তি আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বহির্জগতে। স্থিতিশীলতা এবং একতা যা জাতির বর্তমান সময়ে সবচাইতে বেশী প্রয়োজন। এর প্রয়োজন রয়েছে বিদেশে আমাদের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্য, এর প্রয়োজন রয়েছে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতির পুনর্গঠন ত্বরান্বিতকরণ এবং নতুন সমাজ গঠনের স্বার্থেই। নির্বাচন তাই আগ্রহ সৃষ্টি করেছে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই। তাদের প্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনের মনোনীত প্রার্থী অনায়াসে জয়লাভ করছেন এমনটি ভেবে যদি কেউ নির্বাচনী কেন্দ্রে যাবার উৎসাহটুকু হারিয়ে ফেলেন তবে তা মারাত্মক ক্রুটি বলে বিবেচিত হবে। কারণ এবারের নির্বাচন শুধু জয়লাভ এবং পরাজয়ের নির্বাচন নয়, গণতান্ত্রিক বিকাশে জনচেতনার অংশীদারিত্বের পরীক্ষাস্বরূপ। নির্বাচনে কি জিতলো অথবা হারলো শুধু নেই টুকুর মধ্যেই তাকে সীমাবদ্ধ না রেখে কত বেশী সংখ্যক লোক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো অথবা জাতীয় নীতি নির্ধারণে কতজন তাদের রায় প্রকাশ করলো সেটাকেও অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং অতীত নির্বাচন থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগের গুরুত্ব এবার বেশী। আমরা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে বাইরে প্রকাশ করতে চাই। গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের শুধু আস্থাই নয়, এর লালনে আমরা কতটুকু সক্রিয় তাবৎ দুনিয়ার লোক তা দেখে যাক্। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মানসিকতাকে গণতন্ত্রপ্রিয় সকল মানুষ শ্রদ্ধা করতে শিখুক। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই হোক আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
সে অন্ধকে পথ দেখাবে কে?
সারা বিশ্বের একশ’টি দেশ স্বীকার করে নেবার পর জাতিসংঘে বাংলাদেশের আসন সংরক্ষিত হয়নি। একাধিকবার আবেদন করা হয়েছে. বসেছে রথী-মহারথীদের নিয়ে নানা অধিবেশন কিন্তু ফয়সালা হয়নি। মহাশক্তির প্রভাব খাটিয়ে ‘মহান চীন’ বাংলাদেশকে তার যোগ্যতম আসনে উপবিষ্ট হতে দেয়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাৎ করবার ব্যর্থ প্রয়াস শেষে আক্রোশের তীব্র অনলে নিজেকে দগ্ধীভূত করছে মাও-এর দেশ। কারো কোন কথা নয়, কোন কিছু ভাববার নেই, ছোট ঘুলঘুলি দিয়েও যদি দিনের আলো তার আবদ্ধ ঘরে প্রবেশ করে সেই আশঙ্কায় তিনি শেষ ছিদ্রটুকুও বুজিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু কেন? গত ২রা মার্চ নয়াদিল্লীতে প্রকাশিত ভারত-মঙ্গোলিয়ার যুক্ত ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘বাস্তবতাকে অস্বীকার করবার যে কোন প্রচেষ্টা এতদাঞ্চলে উত্তেজনা ও অস্থিরতাকেই কেবল কেবল বাড়িয়ে তুলবে।’ বলাবাহুল্য উল্লেখিত ঘোষণাপত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের কথাই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে ভারত এবং মঙ্গোলিয়া এই দু’টি দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তি ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি ও সহযোগিতাকে সংহত করবে। শুধু ভারত এবং মঙ্গোলিয়াই বা কেন আজ পর্যন্ত শান্তিকামী অসংখ্য দেশ ঐ একই বক্তব্য পেশ করেছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নে তারা শুধু সমর্থন ও সহযোগিতার হস্তই সম্প্রসারণ করেননি বরং চীনের একগুয়েমি নীতির পরিবর্তনের জন্যই নানা আবেদন-নিবেদন করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? চীন ড্রাগনের ঘুম ভাঙাবে এমন সামর্থ কার?
অথচ সেই দেশই নির্যাতিত মানুষের পরম সুহৃদ হিসেবে নিজেদের অহরহ চিত্রিত করবার প্রয়াস চালাচ্ছে। মুক্তি আন্দোলনের বহু বিঘোষিত কান্ডারী কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে মুক্তিকামী লক্ষ-কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে ঔপনিবেশিক শক্তির মদদদার হিসাবে এগিয়ে এসেছিলো। জুগিয়েছিলো অস্ত্র-সম্ভার, যার নির্মম আঘাতে প্রাণ দিতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে। ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিলো লক্ষ লক্ষ পরিবার।
স্বাধীনতা উত্তরকালে আশা করা গিয়েছিলো পিকিং তার চন্ডনীতি পরিহার করে যুক্তির পথে অগ্রসর হবে। ন্যায় নীতির যে অবশেষটুকুও শান্তিকামী বিশ্বের মানুষ পিকিং নেতাদের কাছ থেকে আশা করেছিলো তারা তাকে প্রথম সুযোগেই পদদলিত করে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে এক সুরে গাইতে শুরু করেছিলো। নানা বিতর্কের পর জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়েছিলো বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নটি। কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করে মাওবাদী নেতৃত্ব ভেটো প্রয়োগের মাধ্যমে সেই শুভ উদ্যোগকে বানচাল করে দেয়। একদিন ‘কাগুজে বাঘ’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে চীনের অন্তর্ভূক্তির ব্যাপার নিয়ে যে কুৎসিত খেলায় মেতে উঠেছিলো আজকের মাওবাদী চক্র সেই একই খেলায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। কাল পরিক্রমায় কাগুজে বাঘ হয়েছে তাদের পরম সুহৃদ আর সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ী একটা জাতি—হয়েছে তাদের উন্মত্ততার শিকার।
কিন্তু কেন? উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক এটা কি পিকিং নেতৃত্বের কাম্য নয়। এতদাঞ্চলের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি কি তাদের মাতব্বরী মোড়লীর প্রতি কোন চ্যালেঞ্জ হিসেবে তারা মনে করেন? পাকিস্তানকে জঙ্গীবাদী একটা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলে এই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে অশান্তির বীজ বপনে তাদের কি উদ্দেশ্য সফল হতে পারে? আজ সাময়িককালের জন্য হয়তো তাদের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। হঠকারী প্রতিক্রিয়াশীলতা যে ইতিহাসের ছেঁড়া পচা পাতাগুলো আঁকড়ে থাকতে চায়, তা শুধু তাদের পশ্চাৎমুখী করে তোলে। জাগতিক গতি সামনের দিকে। সে পথ আঁধার থেকে আলোয় ফেরার পথ। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত হতে না পারলেও এর বেশ ক’টি সংস্থার সদস্যপদ বাংলাদেশ লাভ করেছে। বিশ্ব সংস্থার দুয়ারও দিন দিন খুলে যাচ্ছে। কতদিন আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে মাওবাদী নেতৃত্ব আবদ্ধ ঘরে অবস্থান করবে? চীনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কূটকৌশল সফল হয়নি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চীনের সেই একই কৌশল সফল হবে এমনটি তারা আশা করেন কিভাবে?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক