You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.03.14 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | আদর্শ বাস্তবায়নের সংগ্রাম | ফ্রান্সের নির্বাচন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১৪ই মার্চ, ১৯৭৩, বুধবার, ৩০শে ফাল্গুন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

আদর্শ বাস্তবায়নের সংগ্রাম

গত পরশুদিন সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বসেছিলো। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেছেন। নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁদের প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধুকে পরিষদের নেতা ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ডেপুটি নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। সদস্যগণ বঙ্গবন্ধুকে চীফ হুইপ ও ডেপুটি চীফ হুইপ মনোনীত করার দায়িত্বও দিয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীপরিষদের সদস্যগণ স্ব স্ব পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নবনির্বাচিত পরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর নতুন মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের নাম পেশ করার জন্যে অনুরোধ করেছেন। জানা গেছে আগামী ১৬ই মার্চ নতুন মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করবেন। বঙ্গবন্ধুই একথা ঘোষণা করেছেন।
গত পরশুদিন সংসদীয় প্রথম অধিবেশনে বসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি নবনির্বাচিত সদস্যদের প্রতি দেশের দুখী মানুষের দারিদ্র মোচনের জন্যে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সভায় অন্যান্য বক্তারাও দেশের দুঃখ নিরসনের জন্যে প্রাণপণ সংগ্রাম করে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি কঠোর ভাষায় সংসদের সদস্যগণকে চরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে নিরলস কাজ করে যাওয়ার প্রতি জোর দিয়ে অভিমত প্রকাশ করেছেন। দারিদ্রক্লিষ্ট বাংলার মানুষের ভবিষ্যত নির্ধারণের মহান দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগের উপর অর্পিত হয়েছে। যে কোন মূল্যেই হোক জাতির দুঃখ মোচন করতেই হবে। আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মী অবশ্যই তাঁদের মহান নেতার স্বপ্ন বাস্তবায়ানের জন্যে দৃঢ়সংকল্প। তাদেরকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে সংগ্রাম করে যেতে হবে। কোন প্রকার দ্বিধা বা দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই এ ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আরো দৃঢ় ও মজবুত হয়ে ক্ষমতাসীন হতে চলেছে তাদের ‍উপর এক বিরাট দায়িত্ব অর্পিত আজ। ঐতিহাসিক বিজয়ের একটা গর্ব তাদের থাকলেও উচ্ছ্বাস থাকা উচিত নয়। কেননা দায়িত্ব এতো বেশী যে উচ্ছ্বাস প্রকাশের অবকাশ নেই আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ এতোদিন সংগ্রাম করেছে একটা পাহাড় ভেদ করে বেরিয়ে আসার জন্যে। আজ তাকে সংগঠিত হয়ে নতুন দেশে ও জাতিকে নবপ্রত্যয়ে নির্মাণ করতে হবে। এই নির্মাণ কাজে যদি ব্যর্থতা আসে তাহলে গোটা জাতির ভবিষ্যত অবশ্যম্ভাবীরূপে এক অনিশ্চয়তার মাঝে হারিয়ে যেতে বাধ্য। আর সেটা হলে এতো কালের সংগ্রাম সম্পূর্ণ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে হারিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা যেমন চায়না নিজেদের সংগ্রামী অবদান হারিয়ে ফেলতে তেমনি তাঁরা চাইবেনা বঙ্গবন্ধুর সাধের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যাক। বঙ্গবন্ধুর যে রাজনৈতিক আদর্শ বা মতবাদ তাকে যদি বাস্তবায়িত করা যায় তাহলে সম্ভব কাল-কালান্তরে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখা। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শকে মুজিববাদ বলেছে, আর এই মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁরা জনগণের রায় চেয়েছে। শেখ মুজিবের প্রিয় জনগণ সে রায় প্রদান করেছে। এবার মুজিববাদীদের আত্মত্যাগের পালা। মুজিববাদী কর্মীরা যদি তাদের নিরলস পরিশ্রম ও সাধনা দ্বারা এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়ী হতে না পারে তাহলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই হবে তাদের স্থান। এই মহান সত্য কথাটি সম্মুখে রেখে আগামী শপথ দিবসে আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মীকে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করতে হবে। এ ব্যাপারে সংগঠনের রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। সংগঠন কর্তৃপক্ষকে তার দলীয় আদর্শ ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে অত্যন্ত দৃঢ় ও সুস্পষ্ট হতে হবে। অপরিচ্ছন্ন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে মেন মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সৈনিক হওয়া যাবেনা তেমনি যাবেনা শৃঙ্খলাভঙ্গকারীকে নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া। এতোদিন মিছিলের সারিতে বহু মানুষ সমাবেশের প্রয়োজনীয়তা ছিলো এখন কাজের সারিতে লোক চাই। কাজের সারিতে যখন সত্যিকার কর্মীদের সমাবেশ হবে তখন জনসমাবেশ এমনিতেই হতে বাধ্য। নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু তাই দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেছেন—যে কোন মূল্যেই হোক না কেন জাতির দুঃখ মোচনের সংগ্রামে জয়ী হতেই হবে। আর এ জন্যে প্রতিটি কর্মীকেই তাঁদের সকল ত্যাগ ও সাধনা নিয়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

ফ্রান্সের নির্বাচন

গত এগোরোই ফ্লান্সের চূরান্ত পর্যায়ে সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেলো। নির্বাচনে দাগলপন্থী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট পম্মিদ্যুর কোয়ালিশন কোনমতে শেষ রক্ষা করতে সক্ষম হলেও এবার কিন্তু পামেন্টের ভেতরে ও বাইরে তাদের সবচাইতে বড় শত্রু বামপন্থী বিশেষ করে কম্যুনিষ্টদের তীব্রভাবেই মোকাবিলা করতে হবে।
এই নির্বাচনের যে ফলাফল গতকালকের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সরকারী কোয়ালিশন দলগুলো পেয়েছে শতকরা প্রায় ৪৭ ভাগ ভোট। আর বামপন্থী যুক্তফন্টের বক্সে গেছে শতকরা ৪৫ ভাগ ভোট। গতকাল পর্যন্ত ৪২৫টি নির্বাচনী এলাকার ফলাফল জানা গেছে। বামপন্থী যুক্তফন্টেরদল গুলোর ফ্রাঙ্কো মিতারোন্ডের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিউনিষ্ট পার্টি গতবারের চাইতেও প্রায় দিগুন ৭৩টি আসন, সোস্যালিস্ট পার্টি ৮৯ আসন, র‌্যাডিকেলদের ভাগে গেছে ১১ টি আর রিকনিষ্টরা ২৮টি নিজেদের দখলে রেখেছেন।
অন্যদিকে দগলপন্থী ইউডিআর এই নির্বাচনে গতবারে তুলনায় প্রায় একশতটি আসন হারিয়ে পার্লামেন্টের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো হারালোই সাথে দারুণ ভাবে বিপর্য়য়ের পথে এগিয়ে গেল। অবশ্য মিলিতভাবে এবার হয়ত তারা কোন মতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে পারবেন বলে অনুমিত হচ্ছে।
বামপন্থী কম্যুনিষ্ট সোস্যালিষ্ট মাওবাদী ট্টটঙ্কী পন্থী আঁতাতের এহেন বিজয় ফ্রান্সের রাজনীতিতে একটি বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেছে, সন্দেহ নেই। অনেকের মতে এটা কেবল দাগলবাদকেও নয়, ‘স্তগলের পঞ্চম প্রজন্ত্রকে’ও বিপন্ন করে তুলেছে। তবে দাগলপন্থীরা ক্ষমতাসীন হবেন, এই আশাটুকু এখনো সর্বত্র বর্তমান থাকায় দাগলবাদও ফরাসী রাজনীতিতে নিজের আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকছে। ভবিষ্যতের আরেকটি নির্বাচনের ওপরও নির্ভর করছে দাগলবাদ ও দাগলবাদীরা নিজেদের ভিত কতখানি শক্তি শালী করে রাখতে পারেন।
অন্যদিকে মাঁসিয়ে জর্জ পম্পিদ্যু এর আগে আগে ৭ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। দাগলের ডান হাত হিসেবে এককালে বিবেচিত এবং তারই উত্তরাধিকারী জর্জ পম্পিদ্যুর মেয়াদ ১১৭৬ সাল পর্যন্ত হয়েছে। ফ্রান্সের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী এই দেশের প্রেসিডেন্টে ক্ষমতা মার্কিন প্রেসিডেন্টে ক্ষমতার চাইতে কোন অংশে কম নয়। এক্ষণে তিনি কাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব দেবেন বা মন্ত্রিসভায় কাদেরই বা রাখবেন সেটা তাঁর ইচ্ছের ওপর নির্ভশীল। কেননা প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলে পার্লামেন্টের যে কোন সিদ্ধান্তের ওপর ভেটো দিতে পারেন। তবে তার দলীয়রা এবারও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ট, সেইহেতু তাকে সম্ভবতঃ আর সেই ভেটোর ঝকমারীতে যেতে হবেনা। স্তগল পন্থীদের এহেন বিপর্যয় আকস্মিক হলেও অস্বাভাবিক নয়। ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে দাগল পদত্যাগ করার পর জর্জ পম্পিদ্যু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের পদ লাভ করেন। তারপর থেকে ক্ষমতাসীনদের কিছু কুকীর্তি আর কেলেঙ্কারীই এর জন্য প্রধানতঃ দায়ী। এই দলের প্রথম সারীর নেতা চবন-দেলমাবের আয়কর ফাঁকি, অন্য কয়জন নেতার সরকারী কোষাগারের অর্থে নিজ বাড়ী তৈরী এবং সর্বোপরি বিগত নির্বাচনে প্রদত্ত ওয়াদার বরখেলাপই এবারের নির্বাচনের ফলাফলের এমন পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
অন্যদিকে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর কম্যুনিষ্ট ও সোস্যালিষ্টরা একত্রিত হয়ে বামপন্থী ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় দাগল পন্থীদের জন্য এই দুঃসহ ফলাফল বয়ে আনতে সাহায্য করেছে। তবে এবার সোস্যালিষ্টদের নিয়ে ঐকফ্রন্ট গঠন করতে কম্যুনিষ্টদের বেশ কিছু কনসেশন দিতে হয়েছে। এই কনসেশনে এতটুকু ভাটা পড়লে ঐক্যফ্রন্টও দ্বিধা বিভক্ত হওয়া এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। দাগল পন্থীরা তখন হয়তবা আত্মশুদ্ধির সাথে সাথে সেটাকে কাজে লাগিয়ে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে পাবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন