You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৬শে জুলাই, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ১০ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শান্তির সন্ধানে

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশ যাচ্ছেন। প্রথমে যুগোশ্লাভিয়া অতঃপর কানাডা। কানাডা যাবার এবং কানাডা থেকে দেশে ফেরবার পথে যথাক্রমে তিনি লন্ডন এবং রোমে স্বল্পকালের জন্যে অবস্থান করবেন। যুগোশ্লাভিয়ায় তিনি যাচ্ছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং প্রধানমন্ত্রী মিঃ বিজেদিকের আমন্ত্রণে। সেখানে তাঁর সফরসূচী ছ’দিনের। যুগোশ্লাভিয়ায় অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু মার্শাল টিটোর সঙ্গে ব্রায়নী দ্বীপে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মিলিত হবেন। সেখান থেকে তিনি যাবে কানাডায়। কানাডার অটোয়ায় অনুষ্ঠিতব্য কমনওয়েলথ দেশসমূহের প্রধানমন্ত্রীদের সম্মেলনে তিনি যোগদান করবেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এ জটিল অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর এ সম্মেলনে উপস্থিতি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হচ্ছে। এ সফরে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সচিব বঙ্গবন্ধুর সাথে যাবেন।
ক’দিন আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ ক’টি দেশ সফর করে ফিরে এসেছেন। সে সকল দেশের সঙ্গে আমাদের নীতি লক্ষ্য নিয়েও বিশদ আলোচনা হয়েছে। প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রসমূহ আমাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছে। অভিনন্দন জানিয়েছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ঘোষণা এবং যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রশ্নে আমাদের ঘোষিত নীতিকেও। যতই দিন যাচ্ছে ততই বিশ্ববাসীর সম্মুখে আমাদের অবস্থানটা স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। শান্তিকামী মানুষ আমাদের প্রতি সমর্থনের হস্ত সম্প্রসারিত করেছেন আর অন্যদিকে পাকিস্তান বিভিন্ন মহলের নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখোমুখি হচ্ছে। এমনি অগ্রযাত্রার মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথ সম্মেলনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের নীতি ও আদর্শ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবার সুযোগ পাবেন।
বঙ্গবন্ধুর এ সফর শুভ হোক। বিশ্বশান্তি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় কমনওয়েলথ রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশের আন্তরিকতার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসুক এটাই সবাই কামনা করে। আমরা শান্তি চাই কারণ আমরা বিশ্বাস করি নিরবচ্ছিন্ন শান্তিই সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সৎ সম্পর্কে বিশ্বাসী। কারণ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই আমাদের মতো উন্নতশীল রাষ্ট্রের কল্যাণ সম্ভব। উত্তেজনা প্রশমন করে নয়া দুনিয়া গড়ার শপথই হোক আজকের মূল লক্ষ্য।

ভারত-পাকিস্তান বৈঠক

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্যে এবং আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে উপনীত হবার উদ্দেশ্য নিয়েই এই আলোচনা বৈঠক শুরু হয়েছে—এটা বলাই বাহুল্য। রাওয়ালপিন্ডিতে বর্তমানে অনুষ্ঠানরত এই বৈঠকে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব করছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা শ্রী পি.এন. হাকসার আর পাকিস্তানী দলের নেতৃত্বে রয়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সেক্রেটারী মিঃ আজিজ আহমদ।
ভারত ও পাকিস্তানের এই আলোচনায় জম্মু ও কাশ্মীর থেকে শুরু করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দান, ভারতের বন্দী শিবিরে আটক পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি, পাকিস্তানস্থ আটক বাঙালীদের বাংলাদেশে আসার ও বাংলাদেশস্থ পাকিস্তানীদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ঘোষণা এসব বিষয়ই আলোচিত হতে পারে। বৈঠকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কে যে অহেতুক অচলাবস্থা বিরাজমান রয়েছে সেটা নিরসনের জন্যে একটা উদ্যোগও গ্রহণ করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আর যদি সঠিক অর্থেই এহেন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং সেটা কার্যকরী করার জন্যে অতীতে ভারত যে সদিচ্ছামূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো এবং পাকিস্তান বার বারই পিছিয়ে গিয়েছিলো, তা না করে ভারতের মতোই সদিচ্ছা নিয়ে যদি পাকিস্তান এগিয়ে আসে তবে সব সংকট আর অচলাবস্থার নিরসন হওয়া খুবই স্বাভাবিক—অন্ততঃ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তা-ই আশা করেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে পাকিস্তান সে মনোভাব দেখাবে কিনা। কেননা পাকিস্তানের সৃষ্টি থেকে—লিয়াকত আলী খান থেকে জনাব ভুট্টো পর্যন্ত প্রায় সকল সরকারের আমলেই বেশ কয়েকটি অন্ততঃ ডজন দুয়েক ভারত-পাক আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। অথচ এর মাঝে এ দু’টি দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধও হয়েছিলো (অবশ্য তিনটি যুদ্ধের জন্যে পাকিস্তানই দায়ী)। ডজন দুয়েক আলোচনার ফল ছিলো কিন্তু একটাই। আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। কেননা আলোচনাকালে হয় পাকিস্তানীদের একগুঁয়েমির জন্যে আলোচনা ভেঙে গেছে, না হয় আলোচনাকালে সব কিছু মেনে নিয়ে পাকিস্তানীরা ঠিক উল্টো কাজগুলোই করেছেন। যাহোক এবারকার এই আলোচনা বৈঠক উপমহাদেশের তো বটেই বিশ্বের শান্তিকামী জনগোষ্ঠীর জন্যেও কিছু আনন্দের বার্তা বয়ে আনবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

পরীক্ষা ছাড়া প্রমোশনের আবদার!

বার্তা সংস্থার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খবর এসেছে—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পূর্বভাগ শ্রেণীর ফেল করা ছাত্ররা পরীক্ষা ছাড়াই প্রমোশনের আবদার জানিয়েছেন। তাঁদের দাবী শুধু কথার কথা বা মৌখিক নয়, রীতিমতো প্রকাশ্যে সভা করে সভাতে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সতেরোই জুলাই শহীদ জোহা হলের প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভায় এম.এ. পূর্বভাগ পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্ররা দুই দফা প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। গৃহীত প্রস্তাব দুটো হচ্ছে এক—মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে তাঁদের দ্বিতীয় পর্বে প্রমোশন দিতে হবে অথবা অটো-প্রমোশন দিতে হবে অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। দুই—কর্তৃপক্ষ তাঁদের এই দাবী না মানলে উপাচার্যের বাড়ীর সামনে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করা হবে। তাঁদের এই দুই দফা দাবী উপাচার্য এবং পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রকের কাছে পেশ করা হয়েছে বলেও খবরে প্রকাশ। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে রাজশাহী চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের এম.বি.বি.এস. পরীক্ষার্থীরা সকলেই যাতে পরীক্ষায় পাশ বলে ঘোষিত হয় সে জন্যে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালান বলে একটি দৈনিকে খবর বেরিয়েছিলো।
আমরা জানি, স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে মৌখিক ও লিখিত উভয় প্রকার পরীক্ষা পদ্ধতি এখনো চালু রয়েছে। অবশ্য মৌখিক পরীক্ষা মাত্র পঁচিশ নম্বরের। মোট পাঁচশ’ নম্বরের মধ্যে বাকী পরীক্ষা লিখিত এবং টিউটোরিয়াল ওয়ার্কের। সুতরাং মাত্র পঁচিশ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে কি করে একবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রমোশনের জন্যে বিচার করা যায় তা আমরা বুঝতে পারছি না। অবশ্য এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসৃত নীতি সম্পর্কে শুনেছি বিগত যুদ্ধের সময়ে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দরুণ ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালের এম.এ. পূর্বভাগ শ্রেণীতে অকৃতকার্য ছাত্রদেরকে ফেল করা বিষয়গুলোকে রেফার্ড হিসাবে গণ্য করে নাকি প্রমোশন দিয়ে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ পৃথক সত্তায় পরিচালিত। কাজেই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তবু মৌলিক বিষয়ের মতো কতকগুলো বিষয়ে একই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন ভিন্ন রীতিনীতির প্রচলন কতখানি যৌক্তিকতাপূর্ণ সে বিষয়ে ভাববার অবকাশ আছে বৈকি! অবশ্য তাই বলে পরীক্ষা না দিয়ে পাশের আবদার পূরণ করাকে আমরা কোন যুক্তির আলোকেই সমর্থন করি না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!