You dont have javascript enabled! Please enable it!

ছেচল্লিশের নির্বাচন ও কম্যুনিস্ট পার্টি

নেত্রকোনা অঞ্চলে ক্যুনিস্টদের মূল শক্তি ছিল হাজং কৃষকরা। আর বালির মতাে দু’একটি গ্রামে বেশ কিছুসংখ্যক মুসলমান কৃষক ছিল কৃষক সমিতি তথা ক্যুনিস্ট পার্টির জঙ্গী কর্মী। এর বাইরে মুসলমান কৃষক তথা জনসাধারণের মধ্যে কম্যুনিস্টদের প্রভাব ছিল খুবই সামান্য। রামেশ্বরপুরের মতাে কিছু গ্রাম ছাড়া অন্যত্র হিন্দু কৃষকদের মধ্যেও ক্যুনিস্টদের সম্পর্কে কোনাে ধারণাই ছিল না। গ্রামের মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মধ্যে তাে মূলত কংগ্রেসী আবেগই ছিল প্রবল, কংগ্রেসী প্রচারের মাদকে তারা পুঁদ হয়ে থাকতাে। তবে বিভিন্ন গ্রাম থেকে দু’চারজন করে সচেতন ক্যুনিস্ট কর্মী ক্রমে ক্রমে বেরিয়ে আসছিলেন বৈকি। এঁদের কারাে কারাে হাতেখড়ি হয়েছিল সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিতে। এরপর জীবনের নানা চড়াই-উত্রাই বেয়ে, নানা রকম ঘা খেয়ে, এবং অনেক ঠেকে তাঁরা শিখেছিলেন : সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে ভ্রান্ত পথ, এ-পথে মুক্তি নেই। এঁদেরই কয়েকজন কমিউনিজমে দীক্ষা নিয়ে নতুন ধরনের রাজনীতিতে নেমেছিলেন। বালির শচীন হােম ছিলেন এ রকমই একজন রাজনীতিক। কৈশােরেই তিনি অনুশীলন পার্টিতে যােগ দিয়েছিলেন। ধনীদের বাড়িতে ডাকাতি করে অনুশীলন পার্টির তহবিল সংগ্রহ করা হতাে। এ রকম ডাকাতিকে বলা হতাে স্বদেশী ডাকাতি। আমার জন্মের বছর (কিংবা তার আগের বছরও হতে পারে) আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিকের কুনিহাটি গ্রামে এক ধনী জোতদারের বাড়িতে দুর্দান্ত স্বদেশী ডাকাতি হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে সে-ডাকাতির অনেক গল্প শুনেছি। স্বদেশী ডাকাতিতে বালির শচীন হােমের ছিল সবচেয়ে বেশি নামডাক। ডাকাতি করতে গিয়েই তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং বিচারে তাঁর দ্বীপান্তর হয়ে যায়—অর্থাৎ তাকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৩৮ সালে আন্দামান থেকে ফিরে এসে তিনি কম্যুনিস্ট হয়ে যান। ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন কুখ্যাত ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট গ্রাহামকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযােগে নেত্রকোনার আরাে দু’জন স্বদেশপ্রেমিক বীর খুশু দত্ত ও শশীন্দ্র চক্রবর্তীকে আন্দামানে পাঠানাে হয়েছিল। এ রকম আরাে একটা কী অভিযােগে সাজা হয়েছিল ভূপেন ভট্টাচার্যের। এঁরা সবাই শচীন হােমের সঙ্গে একই সময়ে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন।
সুসং-এর মহারাজের ভাগ্নে মণিসিংহও সন্ত্রাসবাদী দলেরই সদস্য ছিলেন, তবে তাঁর দ্বীপান্তর হয়নি। তিনি কমিউনিজমের দীক্ষা নিয়েছিলেন মস্কো থেকে বিপ্লবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-নিয়ে-আসা কম্যুনিস্ট গােপেন চক্রবর্তীর কাছে।
সুসং অঞ্চলের এক গণ্ডগ্রামের সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে অক্ষয় সাহা কেমন করে জানি ১৯২৬ সালের দিকে ফ্রান্সে চলে যান। ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে, জার্মানি থেকে সােভিয়েত রাশিয়ায়। রাশিয়ান মেয়ে তাতিয়ানাকে বিয়ে করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। তাতিয়ানা সাহা এদেশে এসে মণিসিংহদের সঙ্গে যােগ দেন, এবং গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে সভাসমিতিতে কমিউনিজম প্রচার করতে থাকেন। কমিউনিজমে দীক্ষা নিয়ে মণিসিংহ প্রথমে কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন, কিন্তু পরে সুসং এলাকারই নির্যাতিত কৃষকদের আহবানে সাড়া দিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন, এবং কৃষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেমে তার জমিদার মামাদের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বিরােধে জড়িয়ে পড়েন। নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব দিয়ে তিনি হাজং ও মুসলমান কৃষকদের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠেন। সুসং এলাকার বাইরেও তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়কার ময়মনসিংহ জেলায় তিনি হলেন অবিসংবাদী কম্যুনিস্ট নেতা।
৪৭
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কম্যুনিস্ট পার্টি তাঁকে প্রার্থী মনােনীত করে। তখনকার নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী তাকে প্রার্থী হতে হয় বর্ণহিন্দু আসন থেকে। অথচ বর্ণহিন্দুরা তাে তার ঘাের বিরােধী। মণিংসিংহের কোনাে জাতি’ নেই, সে ব্রাহ্মণের ছেলে হয়েও হাজংদের বাড়িতে পড়ে থাকে। এমন কি মুসলমানদের হাতেও ভাত খায়। নির্বাচনের সময় কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার তাে হয়েছেই, গ্রামের নিভৃতে তার চেয়েও বেশি রটানাে হয়েছে মণিসিংহ ও তাঁর সহযােগী হিন্দু নেতাদের ‘জাত যাওয়া সম্পর্কীয় কুৎসা। জাত গেলে যে একজন মানুষের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না গ্রামের হিন্দুদের মধ্যে ছেচল্লিশ সালেও এ সংস্কার ছিল প্রচণ্ড। তাই, জাত-যাওয়ার প্রচার দিয়ে মণিসিংহ সম্পর্কে বহু হিন্দু ভােটারের মনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করা অনেকটাই সহজ হয়েছিল। তা ছাড়া সে-সময়কার নির্বাচনে বর্ণ হিন্দুদেরও তাে সবাই ভােটার ছিল না। সকল প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের আইন তখনাে চালু হয়নি। ১৯৩৫ সালের নির্বাচন-পদ্ধতির বিধানে সে-সময়কার মাত্র সাড়ে তেরাে ভাগ মানুষের ছিল ভােট দেয়ার অধিকার। ভােটার হওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হতাে তারাই যাদের একটা নিম্নতম শিক্ষাগত যােগ্যতা ছিল অথবা সরকারকে ট্যাক্স দিতাে। কাজেই, গরীব কৃষক-মজুর জনসাধারণের পক্ষে ভােটার হওয়া সম্ভব ছিল না।
এ-অবস্থায় কংগ্রেসী গ্ল্যামারের সামনে কম্যুনিস্টরা যে দাঁড়াতেই পারবে না এমনটাই তাে ছিল স্বাভাবিক। আমাদের রামপুর বাজারে কংগ্রেসীরা প্রচণ্ড প্রতাপে নির্বাচনী সভা করেছে, কিন্তু কম্যুনিস্টদের কোনাে সভা হতে দেখিনি। সিংহেরগাঁওয়ের পবিত্র দাশ ছিলেন আমাদের আশপাশের গ্রামগুলাের মধ্যে প্রধান কম্যুনিস্ট কর্মী। তখন তিনি ছাত্র। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই তিনি আসতেন। তাঁর বাবা ও কাকা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। সেই সুবাদে পবিত্ৰদাকে বাবা খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর বিদ্যা, বিনয়, বুদ্ধি, সততা ও সাহসের জন্যে তার প্রশংসাও করতেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক মতকে সমর্থন করতেন না। তবু, বাবার সঙ্গে তাকে অনেক সময় ধরে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। পবিত্রদা আমাদের বাড়িতে কম্যুনিস্ট পার্টির অনেক চটি বই রেখে যেতেন। সেগুলাে পড়তে চেষ্টা করেছি, তেমন কিছুই বুঝিনি। একটি বই ও তাঁর লেখকের নাম অবিশ্যি আজো আমার মনে আছে। বইটি ভাঙনের মুখে বাংলা’, লেখক–ভবানী সেন। ভবানী সেন নামটি বােধ হয় তখনই আমার চৈতন্যের সঙ্গে গাঁথা হয়ে যায় এবং সে কারণেই সম্ভবত বড়াে হয়ে তাঁর লেখা যখনই হাতে পেয়েছি তখনই গভীর আগ্রহের সঙ্গে পড়েছি।
১৯৪৬ সালে আমরা ক্যুনিস্টদের কথা কিছুই বুঝতে চেষ্টা করিনি। কিন্তু কংগ্রেসীরা ক্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে যা যা বলেছে, তা সবই বিশ্বাস করেছি। ইংরেজ আমাদের শত্রু, তারা আমাদের দেশটিকে দখল করে রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা স্বাধীনতার জন্যে লড়ে যাচ্ছি। সেই ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে জাপানী আর জার্মানরাও। কাজেই জাপান ও জার্মান তাে আমাদের বন্ধু । শত্রুর শত্রু যে বন্ধু হয়, এই সহজ হিসেবটা তাে পাগলেও বােঝে। শুধু বােঝে
ওই জ্ঞানপাপী কম্যুনিস্টরা।…আরে, জার্মানির হিটলার হচ্ছে বাপের বেটা, তার বুদ্ধির কোনাে তুলনাই হয় না। (‘হিটলারী বুদ্ধি’ কথাটা তখন আমাদের মুখে মুখে। যে কোনাে মানুষের মধ্যে বুদ্ধির ঝিলিক দেখলেই ‘হিটলারী বুদ্ধি’ বলে তার তারিফ করি ।)…ওই কম্যুনিস্টরা কি-না হিটলারের বিরুদ্ধে, জার্মানির বিরুদ্ধে, জাপানের বিরুদ্ধে কথা বলে। বলে। কি-না হিটলার হচ্ছে মানবতার দুশমন। হিটলার-মুসােলিনি-তােজোরা ফ্যাসিবাদী। ফ্যাসিবাদ
৪৮
সভ্যতাকে ধ্বংস করবে। কাজেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে, তাদেরকে আমাদের অবশ্যই সমর্থন দিতে হবে। এ যুদ্ধ হচ্ছে জনযুদ্ধ। ইংরেজরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাই এ ক্ষেত্রে আমরা ইংরেজদের পক্ষে।…এভাবেই তাে দেশের মানুষের সঙ্গে বেঈমানি করেছে মীর জাফরের দল কম্যুনিস্টরা।
কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে এসব কথা বিকৃত মুখভঙ্গী করে বলে যেতেন আমাদের গাঁয়ের ধীরু দাস। বলতে বলতে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠতেন।…‘সেই কম্যুনিস্টরা এসেছে আমাদের কাছে ভােট চাইতে, ঝাটা মারি ওদের মুখে।
চন্দপাড়ার ধীরু দাস, নগেন্দ্র দত্ত কিংবা চন্দনকান্দির সুরেন্দ্র চক্রবর্তী, এবং এ-রকম আরাে অনেকে, গায়ের কোনাে গাছতলায় কিংবা পুকুর পাড়ে বসে এমন অনেক কথাই বলতেন। কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে। কম্যুনিস্টরা জনযুদ্ধ’ বলে বলে ইংরেজদের দালালী করেছে, আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের পিঠে ছুরি মেরেছে, ব্রিটিশ আর রাশিয়ানদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে খেয়ে নিজেরা মােটাতাজা হয়েছে—এ-ধরনের অনেক কথাই তারা অবিরাম বলে যেতেন। জাপানজার্মানির সঙ্গে যুদ্ধে ইংরেজরা যখন জেরবার হচ্ছে, তখনই তাে ওদের কাবু করে ফেলার মােক্ষম সুযােগ দেখা দেয়। সেটি বুঝেই তাে ১৯৪২-এ মহাত্মা গান্ধী ইংরেজদের চরমপত্র দিয়েছিলেন : কুইট ইণ্ডিয়া—এই মুহূর্তে ভারত ছেড়ে চলে যাও। কিন্তু ওই ব্যাটা কম্যুনিস্টরা তখন করলাে কী? ইংরেজের নির্লজ্জ দালালী শুরু করে দিলাে। সমস্ত কংগ্রেসী নেতাদের ইংরেজরা জেলে পুরলাে যখন, তখনই কম্যুনিস্টরা ইংরেজদের একেবারে কোলে উঠে বসলাে। নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে ভারতের দিকে এগােলেন, আর কম্যুনিস্টরা দেশের মানুষদের জাপানী জুজুর ভয় দেখাতে লাগলাে। এই তাে কম্যুনিস্টদের চরিত্র!
এ-সময়ই ঘটলাে এক দুর্ঘটনা। শােনা গেলাে : ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারের সময় কংগ্রেস ও ক্যুনিস্ট কর্মীদের কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে মারামারি শুরু হয়ে যায়, এবং কম্যুনিস্টদের এক ভলান্টিয়ারের লাঠির আঘাতে কংগ্রেসের এক ভলান্টিয়ার মারা যায়। ওর নাম ছিল মহেন্দ্র। সে ছিল সুসংয়ের জমিদার বাড়ির এক ধাপার ছেলে।
এই ঘটনাটাকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কংগ্রেসীরা এমনভাবে কাজে লাগালাে যে মধ্যবিত্ত ভােটারদের মধ্যে কম্যুনিস্ট বিদ্বেষ একেবারে তুঙ্গে উঠে গেলাে। প্রমাণ করা হলাে : ক্যুনিস্টর শুধু রাশিয়া আর ব্রিটেনের দালালই নয়, ওরা গুণ্ডাও। কংগ্রেসীরা মহেন্দ্রের লাশের একটা বীভৎস ছবিসহ ইশতেহার ছাপিয়ে লাখ লাখ কপি ছেড়ে দিলাে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও। কম্যুনিস্টরা কিরূপ নৃশংসভাবে মহেন্দ্রকে হত্যা করেছিল ইশতেহারটি ছিল তারই বানােয়াট বর্ণনায় ভরপুর। মহেন্দ্র হত্যা সম্পর্কে একটি পদ্য লিখে সেটিও ইশতেহার আকারে ছেপে হাটে-বাজারে বিলি করেছিল। ওই পদ্যটির দুটো ছত্র এখনাে আমার মনে পড়ে যেমন ইদুর মারে, সেই মতাে ধীরে ধীরে করিল তাহারে খুন। এই হলাে কমিউনিস্টের গুণ।
মহেন্দ্র হত্যার ঘটনাটিকে পুঁজি করে মণিসিংহের প্রতিদ্বন্দ্বী জমিদার আত্মীয়রা নির্বাচনের সময় যে নাটকের অবতারণা করেছিলেন তার বর্ণনা দিয়ে মণিসিংহ তাঁর স্মৃতিকথা জীবন সংগ্রাম’-এ লিখেছেন, “জমিদার বাড়ির মেয়েরা কখনাে ভােট দিতে যেতাে না। তারা ধােপা প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীকে অত্যন্ত হেয় চোখে দেখতাে। তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর ও দরিদ্র লােকেরা জমিদারদের সামনে কখনাে টুলে পর্যন্ত বসতে পারতাে না। কিন্তু কথায় বলে গরজ বড়াে বালাই। আশ্চর্যের বিষয়, নির্বাচনের দিন দেখা গেলাে, জমিদার বাড়ির মেয়েরা স্কুলের বারান্দায়
৪৯
(ভােটকেন্দ্রে) মহেন্দ্রের মাকে একটি চেয়ারে বসিয়েছে, আর জমিদারের এক মেয়ে তাঁকে সন্দেশ খাওয়াচ্ছে।…আমি এই দৃশ্য দেখে ভাবলাম—শ্ৰেণীস্বার্থে সব কিছুই সম্ভব। আর উচ্চবিত্তের তাে বটেই, মধ্যবিত্তেরও সাধারণ চরিত্র যেমন ভঙ্গুর তেমনি বেসামাল। সুসং অঞ্চলে অবশ্য প্রকৃত মহেন্দ্রের মাকেই আনা হয়েছিল, কিন্তু পাহাড় অঞ্চলের অন্যান্য কেন্দ্রেও এক একটি জাল মহেন্দ্রের ‘মা’কে উপস্থিত করা হয়েছিল।”
পবিত্র দাশ তাঁর গ্রামের কয়েকজন ছাত্র-যুবককে কম্যুনিস্ট সমর্থক কর্মী বানিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিল তাঁরই খুড়তুতাে ভাই গােপাল দাশ, আমাদের দুই আত্মীয় কালিদাস পাল ও অনিল পাল এবং সিংহেরগাঁওয়ের আরেক যুবক সুবােধ কর। সংখ্যায় মুষ্টিমেয় হলেও এরাই কংগ্রেসী জোয়ারের মুখে আমাদের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে কম্যুনিস্ট পার্টির গর্বিত অস্তিত্ব ঘােষণা করছিল।
ইলেকশনে, স্বাভাবিকভাবেই, ক্যুনিস্ট পার্টি হেরে গেলাে। কংগ্রেসী অমূল্য অধিকারী ক্যুনিস্ট মণিসিংহের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ভােট পেয়ে জিতে গেলেন। অবিভক্ত বাংলায় কম্যুনিস্ট পার্টির তেরােজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, জিতেছিলেন মাত্র তিনজন—জ্যোতি বসু, রতনলাল ব্রাহ্মণ ও রূপনারায়ণ রায়।
ইলেকশনের পরও বেশ কিছুদিন আমার বালকবাহিনীকে নিয়ে কংগ্রেসী জোশ জিইয়ে রেখেছিলাম। এবং সেই কমুনিস্ট-বিদ্বেষও। সুবােধ কর আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই চলাফেরা করতেন। তাকে দেখলেই আমরা এক সঙ্গে চিৎকার করে স্লোগান দিতে থাকতাম কম্যুনিস্ট পার্টি ধ্বংস হােক। তিনি কিছুই বলতেন না। মিটি মিটি হেসে চলে যেতেন।
আমার চৈতন্যকে তখন অধিকার করে রেখেছে বড়ােদের মুখ থেকে শােনা গান্ধীজীর কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের বীরত্বগাঁথা। ম্যালেরিয়া এবং কাব্যরােগে আক্রান্ত হয় সকল বাঙালি সন্তানই; দৈবাৎ কেউ ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলেও পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু কোনাে না কোনাে সময় কাব্যরােগে ধরেনি এমন কোনাে বাঙালিকে খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব—এ রকম একটি কথা বলেছিলেন ‘লৌহ কপাট খ্যাত কথাশিল্পী জরাসন্ধ । তাঁর কথা সত্য হলে আমি তাে শতকরা এক শত ভাগ খাটি বাঙালি। কারণ ছেলেবেলায় এই দুটো রােগেই আমি ভুগেছি। ১৯৪৬ সালে ক্লাস ফোরের ছাত্র-থাকা-কালে আমি কম্যুনিস্ট নিন্দায় ভরপুর করে কুইট ইন্ডিয়া’ নামে একটি মস্ত বড়াে পদ্য লিখেছিলাম। এখনাে তার প্রথম দু’ছত্র আমার মনে আছে।
১৯৪২-এ কংগ্রেস বলে উঠলাে—কুইট ইণ্ডিয়া
তার বিরুদ্ধে উত্তর হলাে—না দিব ভারত ছাড়িয়া।

চল্লিশের দশকের ‘মুসলমান কম্যুনিস্ট হিন্দুদের মধ্যে কংগ্রেসের ও মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম লীগের জোয়ার যখন তুঙ্গে, তখন যারা এই জোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা হিন্দু বা মুসলমান যে-সম্প্রদায় থেকেই উঠে আসুন না কেন, তাঁদের বুকের পাটা যে খুবই শক্ত ছিল—এ-কথা স্বীকার করতেই হবে। এবং এ-কথাও বলত হবে যে, বুকের পাটা অনেক বেশি শক্ত না হলে মুসলমান কম্যুনিস্ট’ হওয়া ছিল খুবই কঠিন। তুলনায় ‘হিন্দু কম্যুনিস্ট’ হওয়া সহজতর। কারণ হিন্দুদের মধ্যে তখন রাজনীতির নানা বিচিত্রমুখী তরঙ্গলীলা চলছিল, এমনই একটি তরঙ্গ ছিল কম্যুনিজমের।
৫০
কংগ্রেসী জোয়ার যতাে প্রবলই হােক, কম্যুনিস্টদের অস্তিত্বকে মুছে দেয়া বা অস্বীকার করা কংগ্রেসীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে তাদের জোর লড়াই চালাতে হয়েছিল, এবং তার জন্যে আশ্রয় নিতে হয়েছিল মারি অরি পারি যে কৌশলের কৌটিল্যনীতির। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে প্রধানতম এবং প্রবলতম স্রোতটি ছিল মুসলিম লীগের—অর্থাৎ পাকিস্তানের সেই স্রোতের সামনে খড়কুটোর মতাে ভেসে গিয়েছিল নিতান্ত দুর্বল সব প্রতিপক্ষ শক্তি। আর ক্যুনিস্টদের ঘায়েল করার মােক্ষম অস্ত্রটি তাে মুসলিম লীগের হাতে ছিলই। সেটির নাম ধর্ম। হিন্দুরা ধর্ম সম্পর্কে উদার, তাদের যতাে সংকীর্ণতা জাত’ নিয়ে। কোনাে কিছুতেই হিন্দুদের ধর্ম নষ্ট হয় না, কিন্তু জাত যায় অতি সহজেই। চল্লিশের দশকেও, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে, ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ ছিল অতি প্রবল। বিশেষ কোনাে ধর্মীয় ক্রীড হিন্দুদের নেই, এমন কি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও হিন্দুত্বে প্রতিষ্ঠিত থাকা যায়। কিন্তু জাত না মেনে কোনাে হিন্দুর পক্ষে গ্রাম-সমাজে তিষ্ঠানাে ছিল অসম্ভব। তাই, কম্যুনিস্টরা ধর্ম মানে না এমন প্রচার হিন্দুদের মধ্যে কোনাে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না করলেও নির্বাচনী প্রচারে কম্যুনিস্ট প্রার্থী মণি সিংহের ‘জাত যাওয়ার প্রসঙ্গটি তুলে গ্রামীণ হিন্দুদের অনেকের ভেতরে বিরূপতা জন্মানাে সম্ভব হয়েছিল। তবু, বলা প্রয়ােজন, জাত-ধর্মের ব্যাপারটাই সে-সময়কার হিন্দুদের রাজনীতিতে মুখ্য বিবেচনা হয়ে আসেনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা-সংকটের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলাের মােকাবেলা করেই সেদিন তাদের রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছিল।
অন্য দিকে, ছেচল্লিশ সনে মুসলমানদের রাজনীতি হয়ে গিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম।
মুসলমানের মধ্যে জাতের বালাই নেই, অন্তত থিয়ােরেটিক্যালি তাে নেই-ই। তাদের আছে ধর্ম, আছে ক্রীড। ধর্ম বিষয়ে কিছুই যে জানে না, সে-ও তা মানে। আমল’ যার যেরকমই থাকুক, ঈমানের গুরুত্ব সবার কাছেই সমান। কম্যুনিস্টদের কোনাে ঈমান নেই—এ প্রচার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আকাশে-বাতাসে। ধর্মসম্পৰ্কীয় স্পর্শকাতরতাকে অতি সহজে কাজে লাগায় রাজনীতিকরা। ক্যুনিস্টদের ঘায়েল করার জন্যে মুসলিম লীগাররা তা-ই করেছিল। সভা-সমিতিতে তারা প্রচার করতাে : কোনাে মুসলমান কখনাে ক্যুনিস্ট হতে পারে ।
তবু, সে সময়েও মুসলমান কম্যুনিস্টরা ছিলেন। তখন অবিশ্যি আমি তাদের দেখিনি। কিন্তু পরে তাঁদের অনেকের নিবিড় সান্নিধ্যে আসার সুযােগ পেয়েছি। কারাে কারাে সঙ্গে একত্র কারাবাসও করেছি। তখন জেনেছি, কী রকম উজান স্রোতে তাদের নৌকা বাইতে হয়েছে সারা জীবন।
অগ্রণী কমুনিস্ট কর্মী হান্নান মৌলবীর কথা নেত্রকোনার সবাই জানে। তবে মৌলবী সাহেবের মুখেই শুনেছি, মােহনগঞ্জ থানার জহিরউদ্দিন মুন্সী ছিলেন মুসলমান কম্যুনিস্ট হিসেবে তাঁর পূর্বসূরী। সম্ভবত, জহিরউদ্দিন মুন্সীই নেত্রকোনার প্রথম মুসলিম কম্যুনিস্ট।
হান্নান মৌলবীর কম্যুনিস্ট হওয়ার ইতিহাসটি খুবই কৌতূহলােদ্দীপক। বলা যায়, কমিউন্যালিজম দিয়ে শুরু করেই তিনি ক্যুনিজমে’ পৌছে গিয়েছিলেন।
হান্নান মৌলবীর বাবা আব্বাস মাস্টার যখন মারা যান, তখন তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন। জমিদারের খাজনা পরিশােধের জন্যেই তাঁকে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়েছিল। বালি
৫১
গ্রামটি ছিল গৌরীপুরের জমিদারের মালিকানায়। সেই জমিদারের নেত্রকোনা কাছারির সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন একজন মহাজন। বলা হয়তাে নিষ্প্রয়ােজন : ওই জমিদার ও সুপারিন্টেনডেন্ট দু’জনই হিন্দু, এবং এলাকার অর্থলগ্নিকারী মহাজনদেরও সকলেই হিন্দু। মহাজনদের খাতকদেরও সকলে না হলেও অধিকাংশই আব্বাস মাস্টারের মতাে মুসলমান। সেই সুপারিন্টেনডেন্ট ও আরাে যে ক’জন মহাজনের কাছ থেকে আব্বাস মাস্টার ঋণ নিয়েছিলেন, তারা তাঁর মৃত্যুর পরই আদালতে মামলা দায়ের করে তার সম্পত্তি নিলাম করে নিতে থাকে। সুপারিন্টেনডেন্ট বাবু আব্বাস মাস্টারের সমস্ত চাষের জমি নিলামে কিনে নেন। গাঁয়ের মানুষের করুণার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাে প্রয়াত আব্বাস মাস্টারের পরিবারটি।
খান বাহাদুর কুবীর উদ্দিন খান, ইনাম উদ্দিন ও আবদুস সামাদ—নেত্রকোনার এই তিন জন এ্যাডভােকেট ছিলেন আব্বাস মাস্টারের বন্ধুস্থানীয় । এঁরা সকলে কাছারিতে গিয়ে আব্বাস মাস্টারের জমি তাঁর পরিবারকে ফেরত দেয়ার জন্যে সুপারিন্টেনডেন্ট বাবুর কাছে অনুরােধ রাখেন। কিন্তু সুপারিন্টেনডেন্ট অনড়। তার যুক্তি : আইনের বলে তিনি যে-জমি পেয়েছেন, সে-জমি তিনি ছাড়বেন কেন?
কিন্তু তাঁর এই আইনের যুক্তিকে বালি গ্রামের আব্বাস মাস্টারের কৃষক প্রতিবেশীরা পুরােপুরি অকেজো করে দিয়েছিল। আইনের বলে বলীয়ান হয়েও সুপারিন্টেনডেন্ট নিলাম করা জমির দখল নিতে পারলেন না। সুপারিন্টেনডেন্ট যদি হন বুনাে ওল, তাে বালির কৃষকরা বাঘা তেঁতুল। আব্বাস মাস্টারের নিলাম করা জমির ওপর সুপারিন্টেনডেন্টের আইনি অধিকার কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধের মুখে একেবারেই মিথ্যে হয়ে গেলাে।
তখন মুসলিম লীগের প্রতাপ বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। গ্রামে গ্রামে মুসলিম লীগাররা সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। হিন্দু জমিদার-মহাজনরা মুসলমান আব্বাস মাস্টারের জমি দখল করে নিয়েছে—এ বিষয়টিও তাদের সাম্প্রদায়িক প্রচারের একটি উপাদান হয়ে গেলাে। মুসলমান কৃষকদের তারা পুরাে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাে। সেউস্কানির ফল যে একেবারে ফললাে না, তা-ও নয়।
১৯৪০ সালে, পাকিস্তান-প্রস্তাব পাসের বছর, বালির আব্বাস মাস্টারের বড়াে ছেলে হান্নান মৌলবী সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পাকিস্তানি ও মুসলমানি জোশকে কাজে লাগিয়েই তিনি তাঁর পিতৃ সম্পত্তি উদ্ধার করবেন। মহরম উপলক্ষে প্রতি বছরেই তাে মিছিল বের করা হয়। তাতে হায় হাসান হায় হােসেন বলে মাতম করা হয়, জারিগানের তালে তালে বাজনা বাজে, নাচ হয়। কিন্তু এবারের মিছিলটির ধরন-ধারণ একেবারেই আলাদা। মহরম হলাে এ-মিছিলের উপলক্ষ, লক্ষ্য আব্বাস মাস্টারের সম্পত্তি পুনরুদ্ধার। মুসলমান কৃষকদের জঙ্গী মিছিল দিয়ে হিন্দু জমিদার-মহাজনদের অন্তরে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দেয়ার মতলব আঁটলেন তরুণ হান্নান মৌলবী। একটি ঘােড়ায় চড়ে তিনি মিছিলের আগে আগে চললেন। মিছিলে গান হচ্ছিল— ‘ঘােড়ার পৃষ্ঠ শূন্য দেখি, ফুলের বিছানা/হায় মদিনার খবর পেলাম না। গানের ফাঁকে ফাঁকে হাজারাে কণ্ঠের স্লোগান—“পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’।
প্রমাদ গুণলাে নেত্রকোনা শহরের হিন্দুরা। গুজব রটেছিল : মুসলমানরা মিছিল করে শহর লুট করতে আসছে। বহু হিন্দু নারী-পুরুষ, বিশেষ করে ব্যবসায়ী গােষ্ঠীর লােকেরা, গৌরীপুরের জমিদারের কাছারিতে এসে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ভীড় করলাে।
সে-সময়েই কমরেড মণি সিংহর নেতৃত্বে নেত্রকোনা শহরে কম্যুনিস্ট পার্টির একটা বৈঠক বসেছিল। জঙ্গী মিছিলের খবর পেয়েই বৈঠক স্থগিত রেখে কমরেড খুশু দত্ত রায় বেরিয়ে
৫২
এলেন। মিছিলটি তখন মগরা নদীর পাড়ে এসে পড়েছে। খেয়া পেরােলেই নেত্রকোনা শহর। খুশু দত্ত রায় মিছিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হান্নান মৌলবীর সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরেই তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন ও মিছিলের উদ্দেশ্য জেনে নিয়ে জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। মৌলবী আবদুল হান্নান তাঁর স্মৃতিকথায় সে-বক্তৃতার কথাগুলাে সংক্ষেপে উল্লেখ করছেন। খুশু দত্ত রায় বলেছিলেন, “অন্যায়ের প্রতিবাদ করে ইমাম হােসেন কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন। মহররমের দিন শপথ নেয়ার দিন। দুর্বলের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার দিন নয়। মৌলবীর জমি নিয়ে জালেম জমিদার একটা পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কম্যুনিস্ট পার্টির তরফ থেকে আমি কথা দিচ্ছি—কম্যুনিস্ট পার্টি এ জমি উদ্ধারের সংগ্রাম করবে। কোনাে ধর্মের জনসাধারণ মৌলবীর এ দুর্দশা সৃষ্টি করেনি। এভাবে মিছিল করলে দাঙ্গাকারী বলে চিহ্নিত করে জমিদার মামলা করবে। এ শােক মিছিল। এ-মিছিলের সঙ্গে আমিও থাকবাে।”
বক্তৃতা শেষ করে খুশু দত্ত রায় নিজেই মিছিলকারীদের একজন হয়ে গেলেন। হান্নান মৌলবীর পাশে পাশে চলতে চলতে অনর্গল বলতে লাগলেন শ্ৰেণীসগ্রামের কথা, জমিদারের শ্রেণী চরিত্র আর শােষকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা। মিছিলটি জমিদারের কাছারির সামনে এসে দাঁড়ালাে। হান্নান মৌলবী মিছিলকারীদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “ভাই সব, হিন্দু নর-নারী আমাদের শত্রু নয়। জমিদার মহাজন আমাদের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম। এ মিছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধে শাস্তির মিছিল, ঐক্যের মিছিল।”
মুহূর্তের মধ্যে নতুন স্লোগান উঠলাে—“হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ সারা শহর এই স্লোগানে মুখরিত করে মিছিলটি গিয়ে থামলাে মােক্তারপাড়া মাঠে। সকলে মাঠের ঘাসের ওপর বসে গেলাে, আর শহরের ব্যবসায়ীরা তাদের মুড়ি-বাতাসা দিয়ে আপ্যায়ন করলাে। এসব কিছুরই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কম্যুনিস্ট নেতা খুশু দত্ত রায়।
নেত্রকোনা শহরের হিন্দুরা স্বস্তি পেলাে। আর, মৌলবী আবদুল হান্নান নিজেই লিখেছেন, “আমি একটা নতুন জন্ম পেলাম। আমি সেদিন সেই মুহূর্ত থেকেই কম্যুনিস্ট পার্টির একজন হয়ে গেলাম।…
“১৯৪০ সালের মহররম মাসের দশ তারিখ আমার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন হয়ে আছে। পারিবারিক শিক্ষার প্রভাবে এতােকাল মানুষের কাছে দাঁড়িয়েছি ভাবাবেগে পরিচালিত হয়ে সেবার মনােভাব নিয়ে। সমাজ-বিকাশের ধারাটি কি, শ্ৰেণীদ্বন্দ্ব কাকে বলে, এর পরিণতিইবা কি, এ সম্বন্ধে কোনাে ধারণাই তখন ছিল না। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এর সমাধানের পথ খুঁজেছি। ক্যুনিস্ট পার্টি আমাকে নতুনভাবে সৃষ্টি করলাে ।…।
“আমি সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে গেলাম। প্রায় প্রত্যেক দিনই পার্টির নেতাদের কেউ না কেউ আমাকে সঙ্গে করে কোনাে না কোনাে এলাকায় বেরিয়ে যেতেন। যে-সমস্ত এলাকায় কৃষক সমিতি সংগঠিত হয়েছিল, প্রথম দিকে সে-সমস্ত এলাকাগুলােতে যেতাম। আমাকে পাশে বসিয়ে রেখে আলােচনা হতাে। এতে আমি দু’দিক দিয়ে লাভবান হয়েছিলাম। জনতাকে অধিকার সচেতন করে তাকে নিয়ে সমাজ বদলের সংগ্রামে কিভাবে অগ্রসর হওয়া যায় সে শিক্ষা যেমন আমার হয়েছিল, আমার সমস্যাটিও যে এ-সমাজের সামগ্রিক সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয় সে বোেধও আমার ক্রমে জন্মেছিল। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলনের
৫৩
সঙ্গে ও আন্দোলন মিশে গেলাে। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবি কৃষক সমিতির অন্যতম দাবি। কৃষক সমিতির মারফৎ কম্যুনিস্ট পার্টি এ-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে কৃষক সমিতিতে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হলাে।”
১৯৪৫ সালের মধ্যেই বালি গ্রামের ৩৮ জন মুসলমান কৃষক কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হলেন। আর পুরাে গ্রামের সব মানুষই হয়ে গেলাে কম্যুনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির জঙ্গী কর্মী। কিন্তু ছেচল্লিশের নির্বাচনে তাদের কিছুই করবার রইলাে না। নেত্রকোনার মুসলিম আসনে কোনাে কম্যুনিস্ট প্রার্থী নেই। অন্য অন্য গ্রামের মুসলমানদের কাছে মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানের প্রশস্তি ছাড়া অন্য কোনাে কথা উচ্চারণই করা যায় না।
বর্ণ হিন্দু আসনে কম্যুনিস্ট প্রার্থী মণি সিংহের সমর্থনে কাজ করতে গিয়ে হান্নান মৌলবী আর তার সাথীরা নানা ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। কংগ্রেস-সমর্থক বর্ণ হিন্দুদেরও তখন সাম্প্রদায়িকতার ভূতে ভালাে করেই পেয়ে বসেছে, তারা কোনাে মুসলমানের কথা শুনতেই রাজি ছিল না।।
কিশােরগঞ্জের মুসলিম আসনে অবিশ্যি একজন কম্যুনিস্ট প্রার্থী ছিলেন। তিনি কমরেড ওয়ালি নেওয়াজ। অবিভক্ত বাংলার তেরােজন কম্যুনিস্ট প্রার্থীর মধ্যে মুসলমান ছিলেন তিনজন। দু’জন পশ্চিম বাংলায়—মােহাম্মদ ইসমাইল ও চতুর আলী, আর পূর্ব বাংলায় একজন—ওয়ালি নেওয়াজ। কমরেড ওয়ালি নেওয়াজকে আমি দেখিনি, তবে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলাম কিশােরগঞ্জের আরেকজন ক্যুনিস্ট নেতা কমরেড জমিয়ত আলীর। ছিয়াত্তরসাতাত্তর সালে এক বছরেরও বেশি সময় আমি ময়মনসিংহ জেলে জমিয়ত ভাইয়ের সহবন্দি ছিলাম। সে সময়ে তার মুখে ওয়ালি নেওয়াজের কথা অনেক শুনেছি। এবং শুনেছি ছেচল্লিশের নির্বাচনে ওয়ালি নেওয়াজের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে জমিয়ত ভাইয়ের নিজের অভিজ্ঞতার কথাও।
ওয়ালি নেওয়াজের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন হাবিব মিঞা নামে এক ব্যক্তি। তিনি না-কি ছিলেন ছােট-খাটো একজন জমিদার। ছােট হলেও শরৎচন্দ্রের মহেশ’ গল্পের কাশীপুর গ্রামের জমিদারটির মতােই দাপটে তার প্রজারা টু শব্দটি করিতে পারিত না— এমনই প্রতাপ।’ সেই প্রতাপ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি জোশে। মুসলিম লিগাররা তখন ইসলামের স্ব-ঘােষিত হেফাজতকারী, যে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে সেই হয়ে যেতাে ইসলামের দুশমন। কাজেই ওয়ালি নেওয়াজ এবং তাঁর দলের সব লোেক যে ইসলাম বিরােধী বলে চিহ্নিত হবেন—এ আর এমন বিচিত্র কি! কিন্তু কম্যুনিস্টদের কেবল ইসলামবিরােধী অপবাদ দিয়েই মুসলিম লীগ ভােটের ব্যাপারে পুরাে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। কম্যুনিস্টরা যে বর্গাচাষী কৃষকদের তেভাগার কথা বলতাে, জমিদার-জোতদার-মহাজনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত হওয়ার জন্যে আহ্বান জানাতাে, পাকিস্তান কায়েম করার মধ্যেই গরিবের আসল সমস্যার সমাধান নেই বলে কৃষকদের সচেতন করে তুলতে চাইতাে—সেসবের মােকাবেলা করার জন্যে মুসলিম লীগ প্রার্থী তার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির বুলি একেবারে উজাড় করে দিয়েছিলেন। তিনি না-কি ওয়াদা করেছিলেন: পাকিস্তান কায়েম হয়ে গেলে নিজের জন্যে কিছুই রাখবেন না, তার সব জমিজমা কৃষকদের বিলিয়ে দেবেন। (কমরেড খােকা রায় তাঁর সংগ্রামের তিন দশক’ গ্রন্থেও এ-বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।) ইসলাম বিরােধী’ ওয়ালি নেওয়াজকে হারিয়ে দিয়ে হাবিব মিঞাই নির্বাচনে জিতেছিলেন, এবং ইসলামী
৫৪
রাষ্ট্র পাকিস্তানও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর তিনি তাঁর ওয়াদা রক্ষা করেছিলেন কি-না, জমিয়ত ভাইকে তা জিজ্ঞেস করার কোনাে প্রয়ােজন বােধ করিনি।
কমরেড ওয়ালি নেওয়াজ ছিলেন নির্ভীক ও লড়াকু কর্মী। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুব বেশি ছিল না, মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি ইস্কুলে পড়েছিলেন। তবে পার্টি করতে এসে কম্যুনিজমের তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা তিনি করেছিলেন। এমন কি, তরুণ পার্টি কর্মীদের তত্ত্বীয় প্রশিক্ষণ দানের কাজও তিনি করেছেন। এ ব্যাপারে জমিয়ত ভাইয়ের কাছে একটা মজার গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি এ রকম :
কমরেড ওয়ালি নেওয়াজ একদিন পার্টির কৃষক কর্মীদের তত্ত্বীয় ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি তাদের ডায়ালেকটিকসের ‘থিসিস এন্টিথিসিস সিনথেসিস’ বােঝাতে চেষ্টা করছিলেন। নিরক্ষর কৃষকদের মাথায় এসব তত্ত্ব ঢুকবে কী করে? কিন্তু ওয়ালি নেওয়াজ নাছােড়বান্দা। তিনি তাদের বুঝিয়েই ছাড়বেন! কিছুতেই যখন তাদের বােঝাতে পারছিলেন না, তখন ভীষণ রেগে গেলেন! একজন প্রশিক্ষণার্থীকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, “আরে গর্দভ, এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে পারছিস না। মনে কর—তাের বাপ হলাে থিসিস, তাের মা এন্টিথিসিস, আর তুই হলি গিয়ে সিন্থেসিস। এবার বুঝেছিস, হতভাগা?”
সেই হতভাগা কী বুঝেছিল জানি না, তবে আমরা সেদিন জমিয়ত ভাইয়ের মুখে ওয়ালি নেওয়াজ-ব্যাখ্যাত ডায়ালেকটিকসের অভিনব দৃষ্টান্তের কথা শুনে ময়মনসিংহ জেলের তেরাে নম্বর ওয়ার্ডে বসে প্রাণ খুলে হেসেছিলাম।
তবু, যতােই হাসিঠাট্টা করি না কেন, ওয়ালি নেওয়াজের মতাে কম্যুনিস্টদের ত্যাগ, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতাকে খাটো করে দেখতে পারি না কিছুতেই। এঁরা অনেকেই শেষ পর্যন্ত হয়তাে পুরাে আদর্শনিষ্ঠ থাকতে পারেননি। তবু মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-ঝরানাের সেই দিনগুলােতে কম্যুনিজমের মানবিক মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে কম্নালিজমের অমানবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অবদানকে ভুলে যাই কী করে?

Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!