You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৮শে জুলাই, শনিবার, ১৯৭৩, ১২ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

রপ্তানী বাণিজ্য নীতি ঘোষণা

আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান গত পরশুদিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে দেশের রপ্তানী বাণিজ্য নীতি ঘোষণা করেছেন। ১৯৭৩-৭৪ সালের আর্থিক বছরে মোট ৫২৪ কোটি টাকার সামগ্রী বিদেশে রপ্তানী করা হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। গত আর্থিক বছরের তুলনায় এবারের রপ্তানী বাণিজ্য নীতি বেশ খানিকটা সম্ভাবনাময়। বিশেষ করে এবারের রপ্তানীর পরিমাণ গতবারের তুলনায় শতকরা ১৯.৫ ভাগ বেশী। রপ্তানী নীতির বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে গত বছরের তুলনায় এবারে বেশ কয়েকটি উল্লেখ বিষয় রয়েছে। যেমন রপ্তানীযোগ্য সকল সামগ্রীর মধ্যে শতকরা পঁচাশি ভাগ পাট ও পাটজ দ্রব্য রপ্তানী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবং কয়েকটি দ্রব্যের রপ্তানী বৃদ্ধির জন্যে শতকরা ত্রিশ ভাগ সাবসিডি দেবার একটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তের কথাও সরকার ঘোষণা করেছেন। এই সাবসিডির পরিমাণ হবে এক কোটি আশি লাখ টাকা। এছাড়া রপ্তানীর ব্যাপারে প্রাইভেট সেক্টরকে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ রপ্তানী করার সুযোগ রাখা হয়েছে। সরকার রপ্তানী বাণিজ্যকে সম্প্রসারিত করার জন্যে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোকে অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেছেন বলেও সাংবাদিকদের কাছে মন্ত্রী জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ ইতিমধ্যেই সুসম্পন্ন হয়েছে বলেও তিনি জানান। যে সব দেশে ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে—মস্কো, জাপান, কানাডা, নিউইয়র্ক, লন্ডন এবং ব্রাসেলস। রপ্তানী বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার জন্যে সরকার বিশেষ ‍সুযোগের ব্যবস্থা রেখেছেন বলেও সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রী জানিয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে এসে বলেছেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়, মুদ্রা পাচার এবং রপ্তানী সামগ্রী পাচারের সমস্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে দেশের স্বার্থই বড় কথা, নিজেদের বাণিজ্যিক লোকসান দিয়ে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব আমরা চাই না।’
বস্তুতঃপক্ষে দেশের ১৯৭৩-৭৪ সালের রপ্তানী বাণিজ্য নীতিকে তুলনামূলকভাবে বেশ সম্ভাবনাময় বলে উল্লেখ করা যায়। কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমরা গোটা বাণিজ্য নীতিকে প্রগতিশীল বলেও আখ্যায়িত করতে পারি। বিশেষ করে দেশের আর্থিক কাঠামো মজবুত করার মানসে রপ্তানীর উপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী। আমদানীর তুলনায় রপ্তানী যদি ন্যূনতম ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তাহলে দেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে নৈরাজ্য নেমে আসে। দেশের নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও সরকার যে রপ্তানী বাণিজ্যে একটি প্রবাহ সৃষ্টির আশ্বাস দিয়েছেন তা অবশ্যই উল্লেখ্য। অনেকের ধারণা ছিলো আমদানীর তুলনায় আমাদের রপ্তানী বাণিজ্যের ভারসাম্য থাকবে না। রপ্তানী বাণিজ্য নীতি ঘোষিত হওয়ার মাধ্যমে সে আশঙ্কা দূরীভূত হয়েছে। এ ব্যাপারে অবশ্য আমাদের বক্তব্য রয়েছে। তা হলো, রপ্তানীর জন্যে আমাদের যে লক্ষ্যসীমা রয়েছে এবারের আর্থিক বছর শেষ হবার পূর্বেই তা যতদুর সম্ভব পূরণ করতে হবে। রপ্তানীর জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তা যদি পূরণ করা না হয় তাহলে তা নিদারুণ নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। এবং এ নিয়ে বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হবারও যথেষ্ট কারণ থাকে। আমরা আশাবাদী, এবারের বাণিজ্য নীতি যেহেতু বেশ প্রতিশ্রুতিশীল সেহেতু রপ্তানীর লক্ষ্যসীমায় পৌঁছানোর ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন। আমরা আরো আশা করি, বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে সকল দুর্নাম রয়েছে সে সবের উৎপাটনের মাধ্যমে বাণিজ্য বিভাগ দেশের আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্যকে কলুষমুক্ত করে দেশের সার্বিক কল্যাণে নিযুক্ত করবেন।

ভুট্টো সাহেব হাঁক ছেড়েছেন

পাকিস্তানের ভুট্টো সাহেব এখন প্যারিসে। প্যারিসে থেকেই গত বৃহস্পতিবার তিনি দু’টো হাঁক ছেড়েছেন। হাঁক দু’টোই তাঁর তিন প্রতিবেশীর উদ্দেশে। প্রথম হাঁক তিনি আফগানিস্তানের বর্তমান বিপ্লবী দাউদ সরকারের বিরুদ্ধে ছেড়েছেন। বলেছেন, আফগানিস্তান যদি পুরোনো দাবী তোলে তবে পাকিস্তান তার সমুচিত জবাব দেবে। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের সাথে তাদের মিল-মহব্বৎ নাকি সাংঘাতিক কড়া—এতো মহব্বতের মাঝে চিড় ধরার কিছুই তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তারপরেও যদি চিড় ধরে-আফগানরা যদি ভুট্টো সাহেবের মহব্বতকে বুঝতে না পারে এবং দাম না দেয় তবে তিনিও একহাত দেখে নেবেন।
উল্লেখযোগ্য যে, সপ্তাহ দু’য়েক আগে সর্দার দাউদ যখন আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র উচ্ছেদের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন, তখন তিনি পাকিস্তান ছাড়া আর কারো সাথে তাঁর দেশ ও সরকারের কোন শত্রুতা নেই বলে ঘোষণা করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণেও তিনি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের পাঠান জাতির পুরোনো ও প্রাণের দাবী পাখতুনিস্তানের প্রতিও তাঁর দেশের ও সরকারের সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছিলেন এবং তাঁদের সাহায্য দেবেন বলেছিলেন। সর্দার দাউদের এই ঘোষণা ভুট্টো সাহেবের নতুন করে ভিরমী খাবারই কথা। কেননা তথাকথিত দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান নাম যে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন সেই পাকিস্তানে এই দেশটির জন্মের পর থেকেই পাঞ্জাব চক্রই শাসন আর শোষণের স্টীমরোলার চালিয়েছিলো। বাংলাদেশ প্রায় দু’ বৎসর আগে জিঞ্জির মুক্ত হলেও পাঠান-সিন্ধি-বেলুচীরা তার হাত থেকে এখনো নিস্তার পায় নি। পাঠানদের পাখতুনিস্তান দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে বেলুচীরা। সেজন্যে ভুট্টো সাহেব ইরানের শাহের সাথে আঁতাত করে বেলুচিস্তানকে ইরানের হাতে তুলে দিতে চক্রান্ত করেন। সর্দার দাউদের ঐ ঘোষণায় ভুট্টো-শাহের সে চক্রান্ত হয়তো কার্যকরী হতে পাচ্ছেনা। কাজেই ভুট্টো সাহেব এখন বেসামাল। হাঁক ছাড়ছেন আবোল-তাবোল।
ভুট্টো সাহেবের দ্বিতীয় হাঁক : বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবো—কিন্তু কাশ্মীরকে ছাড়বো না। অনেকটা ‘নীচে পড়ে রোদ খাচ্ছে কে’র মতো শোনায় না কি! কাশ্মীর যে এখন আর ভুট্টো সাহেব আর তাঁর পাকিস্তানের তাঁবে নেই—সেটা বিশ্ববাসী যেমন জানেন—তেমন তার চাইতেও ভালো করে জানেন ভুট্টো সাহেব ও পাকিস্তানীরা। অন্যদিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে পাকিস্তানের যে আর বাঁচোয়া নেই। সেটাও ভুট্টো সাহেব ভালো করেই জানেন। তবুও হাঁক ছাড়াটা যাঁদের অভ্যাস হাঁক তারা ছাড়েই। সে হাঁকের মূল্য থাক বা না থাক। অতএব ভুট্টো সাহেবও হাঁক ছেড়েছেন। এই যা!

আণবিকীকরণ দেশে দেশে, আমরা যাই কোথায়

সম্প্রতি এক নিবন্ধে প্রাক্তন গলপন্থী প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিঃ দেবরে নিরাপত্তা পরিষদে তার স্থায়ী পদ অক্ষুন্ন রাখবার প্রয়োজনেই ফ্রান্সের আণবিকীকরণের স্বপক্ষে ওকালতি করেছেন। ইতিমধ্যেই ফ্রান্স বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মুখ প্রশান্ত মহাসাগরের বায়ুমন্ডলে আণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বেতার সাক্ষাতকারে বলেছেন, ফ্রান্স উক্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরো আণবিক পরীক্ষা চালাবে। কোন কিছুই ফ্রান্স সরকারকে এই আণবিক পরীক্ষা বিরত করতে পারবেনা বলে তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন।
শুধু ফ্রান্স নয়, সম্প্রতি চীনও আণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ আণবিক পরীক্ষা চালানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মুখে। উদ্দেশ্য আণবিক শক্তিধারী দেশ হিসেবে বিশ্ব সমাজে একটু খাতির যত্ন লাভ। অস্ত্রের বলে দুনিয়ার উপর প্রভুত্ব করার একটা খেয়াল প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এই দেশসমূহকে প্রভাবিত করছে। পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কথা গুণতির ভিতরে না এনে যতি আমরা ‘মহান সমাজতান্ত্রিক দেশ’ চীনের সামরিক সজ্জার দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে অবাক হতে হয় বৈকি!
চীন ১৯৬৩ সালের পর তার সামরিক ব্যয়ভার তিনগুণ বৃদ্ধি করেছে। চলতি বৎসরে সে তার জাতীয় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় করছে সামরিক খাতে। এই ব্যয় তার জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থকেও ছাড়িয়ে গেছে, শিল্পখাতে বরাদ্দকৃত অর্থের চাইতে চীনের সামরিক খাতে ব্যয় বর্তমানে বেশ কয়েকগুণ বেশী। তথ্য থেকে যতটুকু আঁচ করা যায় তাতে সামরিক সজ্জার দিকে চীনের আগ্রহ অতীতের সকল সীমাকে ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার ফলে চীনা জনসাধারণের মনে যে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে তাকে অন্য পথে প্রবাহিত করার কৌশল হিসেবে চীনা নেতৃবৃন্দ আজ তাদের দেশবাসীকে অনবরত রুশ-জুজুর ভয় দেখিয়ে চলেছেন। বলা হচ্ছে রাশিয়া যে কোন মুহূর্তে উত্তর সীমান্তে চীনকে আক্রমণ করতে পারে এবং সম্ভাব্য সে আক্রমণকে মোকাবেলা করবার জন্যেই সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের ‘কৃচ্ছ্রতা সাধন’ করতে হবে।
বৃহৎ শক্তির কাতারে নিজের জন্যে একটা স্থান করে নেবার খায়েশ চীনের বহুদিনের। এজন্যে দেশের আশি কোটি মানুষকে খেসারত দিতে হচ্ছে, খেসারত দিতে হবে আরো কতদিন কে জানে? চীনা জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা তারাই ভাববেন, সে নিয়ে চিন্তা করবার অবসর আমাদের নেই। কিন্তু ঘরের দোরে যে দেশ সে দেশে আণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো অথবা ব্যাপকহারে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!