বাংলার বাণী
২৭শে জুলাই, শুক্রবার, ১৯৭৩, ১১ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
পাট নীতি : কিছু প্রশ্ন
নতুন মওসুমের পাট যখন বাজারে কেনা-বেচা শুরু হয়েছে তখন পাট মন্ত্রী আমাদের পাট নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি মওজুত পাটের হিসাব, এ বৎসরের পাটের উৎপাদন মাত্রা, কত পাট রপ্তানী করা হবে এবং সবশেষে আবার কত পাট উদ্বৃত্ত থেকে যাবে তার নানা অংক পেশ করেছেন। বলেছেন উৎপাদনকারীরা আগের মতোই পাট বেচে মণপ্রতি পঞ্চাশ টাকা লাভ করবেন। এবং এ টাকা যাতে সরাসরি তাদের হাতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে সে জন্যে গত বছরের তিন শ’টি ক্রয় কেন্দ্রের স্থলে এবার পাঁচ শ’রও বেশী ক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য যা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং যা চলতি মওসুমেরই পাট নীতির অংশবিশেষ তাও নাকি ধানের বাজার দর এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের আলোকে আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পুনরায় বিবেচনা করা দেখা হবে।
পাট নীতি ঘোষণা করা হয়েছে অন্ততঃ দেশে পাটের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা এখন গ্রহণ করা যাবে। পাট উৎপাদন এবার কম হবে এবং প্রায় আড়াই লাখ একর জমিতে যে পাট বোনা হয়নি তা মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য থেকেই জানা গেছে। গত বছরের পাট উদ্বৃত্ত থেকে গেছে বাইশ লাখ বেল। এবার উৎপন্ন হবে পঞ্চান্ন লাখ বেল। সব সমেত এ মওসুমে সরকারের হাতে সাতাত্তর লাখ বেল পাট জমবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ থেকে তেত্রিশ লাখ বেল কাঁচা পাট সরাসরি বিদেশে রপ্তানী করা হবে। তেত্রিশ লাখ বেল যাবে কারখানায়। দেড় লাখ বেল গ্রাম ব্যবহৃত হবার পর এ মওসুমে উদ্বৃত্ত পাট থাকবে ন’ লাখ বেল। পরিষ্কার হিসাব, সাদা-মাটা আশা।
কিন্তু এত কিছুর পরও প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে গত বছরে উদ্বৃত্ত এত পাট থাকলো কি ভাবে। বাইরের বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কেন সে পাট রপ্তানী করা হয়নি? উদ্বৃত্ত পাটের যে হিসাব দেখানো হয়েছে তার ভিতর গত বারো মাসে জলে ভিজে অযত্নে যে পাটগুলো নষ্ট হয়েছে তা ধরা হয়েছে কি না? সরকারের সঠিক পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণের অভাবে কত পাট গোপনে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে। এবং এবারের পাট নীতিতে সেই কানা গলিগুলো বন্ধ করবার কতটুকু বাস্তবানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাটের মূল্য নির্ধারণে বাংলাদেশ এবং ভারতের এক সঙ্গে বসে আলোচনা এবং সমঝোতায় আসার প্রয়োজনীয়তা পাট মন্ত্রণালয় অনুভব করেছিলেন কি না? পশ্চিমবঙ্গে পাটের যে নয়া মূল্য সম্প্রতি নির্ধারণ করা হয়েছে আমাদের দেশের পাটের মূল্য নির্ধারণে তা বিবেচনা করা হয়েছে কি না?
মন্ত্রী খারাপ আবহাওয়া, বন্যা প্রভৃতিকে পাট উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি যে বিষয়ে এক্কেবারে কিছু না জানা কচি শিশুটির মতো ভান করেছেন তা হলো কেন গত বছরে যে পরিমাণ জমিতে পাট চাষ করা হয়েছিলো তা থেকে দু’লাখ আটান্ন হাজার একর জমিতে এবার পাট চাষীরা পাট বুনলো না? মন্ত্রী মহোদয় আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পাটের মূল্য পুনর্বিবেচনার যে আশ্বাস দিয়েছেন তাতে করে আদৌ যদি মূল্য বৃদ্ধি ঘটে তবে তা কাদের পকেটে গিয়ে পৌঁছবে সেটা কি পাট মন্ত্রণালয় ভেবে দেখেছেন। অতদিন পাট ধরে রাখবার মতো আর্থিক যোগ্যতা ক’জন পাটচাষীর রয়েছে? সবকিছু দেখেশুনে এ মওসুমের পাট নীতি কোন অবস্থায়ই সুষ্ঠু, সুপরিকল্পিত অথবা বাস্তবানুগ বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি।
ভিয়েতনামী আমাদের সংগ্রামী বন্ধু
বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত পরশুদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একথা ঘোষণা করা হয়েছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেলগ্রেড যাওয়ার প্রাক্কালে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্তটি অনুমোদন করেছেন। উত্তর ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের বাংলাদেশের এ স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে অর্থবহ। এবং বিশ্বের শান্তি আন্দোলনে একটি বিজয়। ভিয়েতনামের বিপ্লবী মানুষের, আমাদের সরকারের এবং জনগণের একাত্মতা ঘোষণাও বটে। ফ্যাসিবাদী ও পরে সাম্রাজ্যবাদের বর্বর শিকারে ক্ষত-বিক্ষত ভিয়েতনামের সংগ্রামী জনগণ। সুদীর্ঘকাল ধরে তারা অকাতরে জীবন দিয়ে আসছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে। বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের কাছে ভিয়েতনাম তাই একটি জ্বলন্ত বিপ্লবী প্রতীক। মানুষের মুক্তির আন্দোলনের শিক্ষণীয় প্রতীক। বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী শক্তি তাদের ন্গ্ন থাবা বিস্তার করেছিলো ভিয়েতনামের মাটিতে। বাংলাদেশও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষ এতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামের সময়সীমা আমাদের বেলায় স্বল্প হলেও আমাদের সংগ্রামী তিতিক্ষা ও সাধনা ভিয়েতনামের মানুষের সঙ্গে তুলনীয়। বহুদিন ধরে ভিয়েতনাম তার আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে মরণপণ সংগ্রাম করে আসছে। ফ্রান্সের উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসনের নিগড় ভেঙে বেরিয়ে এলেও ভিয়েতনাম সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ থেকে মুক্তি পায়নি। একদিন তারা আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের অঘোষিত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। এবং তাঁবেদার সৈন্যের মাধ্যমে আমেরিকান সাম্রাজ্য উত্তর ভিয়েতনামের মানুষের উপর হামলা চালায়। এরপর থেকে আজ দীর্ঘদিন ধরে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে সংগ্রাম করে চলেছে। আমেরিকান সাম্রাজ্য বিশ্বের সকল নিয়মশৃঙ্খলা এবং মানবতার ন্যূনতম পরিচয় না দিয়ে ভিয়েতনামের উপর বোমাবর্ষণ করেছে। হাজার হাজার বার তারা বিমান ও স্থলপথে আক্রমণ চালিয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে ভিয়েতনামের মানুষের সংগ্রাম বিশ্বের জ্বলন্ত উদাহরণ। অনতিবিলম্বে ভিয়েতনামে শান্তিচুক্তি কার্যকরী হোক এটাই আমরা কামনা করি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সকল প্রভাব সেখান থেকে দূরীভূত হোক এটাও আমাদের কাম্য। আমাদের বিশ্বাস, ভিয়েতনামের মানুষের সঙ্গে আমাদের সংগ্রামী ঐক্য ও সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক