বাংলার বাণী
১৭ই মার্চ, ১৯৭৩, শনিবার, ৩রা চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
নেতার এ শুভ জন্মতিথিতে
আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিপান্নতম জন্ম বার্ষিকী। সারা দেশব্যাপী আজ আওয়ামী লীগ, যুব লীগ, ছাত্র লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগ এ দিবস পালন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও বঙ্গবন্ধুর জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন। তাঁর জন্ম যে বাংলার ভাগ্যাকাশে এক বিরাট ঘটনা ছিলো তা আজকের স্বাধীনতার মাধ্যমে সুস্পষ্ট। মহামানুষের জন্মের আবশ্যকতা যে কত বেশী তা তাঁর যুগ ও কালের প্রেক্ষিতে বিচার্য। বঙ্গবন্ধু যেদিন জন্মেছিলেন সেদিন বাংলার আকাশে বাতাসে কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়া না হলেও আজ এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, বঙ্গবন্ধুর জন্মের ঘটনা বা প্রয়োজনীয়তা কত বেশী ছিলো। তাঁর জন্মের দিনকে স্মরণ করার পেছনে তাই রয়েছে এক বিরাট ইতিহাস—যা কিনা বাংলার উত্থান-পতনের নানা ঘটনার সঙ্গে জড়িত। দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। একটি জাতি বিশ্ব জাতি গোষ্ঠীর মাঝে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। এই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সারা জীবনের সাধনা ছিলো বাংলাকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলার মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক গোষ্ঠীর কড়াল গ্রাস থেকে মুক্তি দেওয়া। সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরের অক্লান্ত সংগ্রামের পর দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। অতুলনীয় জনপ্রিয়তা রয়েছে তাঁর। বিশ্ব ইতিহাসে যা বিরল। এমনি এক মহাপুরুষ শেখ মুজিব। আজ তাঁর শুভ জন্মদিনে গোটা দেশের মানুষ তাঁকে আশীর্বাদ করবে—করুণাময়ের কাছে তাঁর দীর্ঘায়ুর জন্যে দোয়া চাইবে। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ যাতে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠে তার জন্যে জনগণ তাঁকে শুভেচ্ছা জানাবে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষের এতো নিবিড় অকৃত্রিম শ্রদ্ধা রয়েছে যা তুলনাহীন। বিশ্বের যে কোন জননেতার সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। তিনি একটি জাতির শুধু ত্রাণকর্তাই নন—প্রতিপালক, পরিচালক এবং সর্বোপরি অভিভাবক। বাঙালী জাতির নিজস্ব ইতিহাসে কোন স্বাতন্ত্রের স্বরূপ নেই। চিরকাল বিভিন্ন বিজাতীয় শক্তির প্রভুত্বের শিকার হিসেবে তাঁর ক্রমবিবর্তন ঘটেছে। স্বতন্ত্র দেশ বা জাতিসত্তার বিকাশ ঘটাতে গিয়ে এ জাতি বার বার পরাধীনতার শৃঙ্খল পরেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র নেতা যিনি এই গোটা জাতিকে একটি জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভিত্তিতে সংগ্রামী ঐক্যে বেঁধেছিলেন। এবং সংগ্রামের ধাপে ধাপে একটি বৃহৎ ইস্পাত কঠিন ঐক্যে এনে ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বন্দী ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে কিন্তু বাংলাদেশের আপামর মানুষের প্রতি ছিলো তাঁর অমর বাণী—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয়বারের মতো জন্মবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে তাই তাঁর নিজের জীবনের সংগ্রামী ইতিহাস জাতি আজ স্মরণ করছে। সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিবৃত্ত। জাতি আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে নতুন শপথ নেবে নেতার আদর্শ অনুসরণের জন্যে। বঙ্গবন্ধুর নিজ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারী রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো আজ তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার জন্মদিনে একগুচ্ছ ফুলের মালা উপহার দিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করবে। নেতার ঐতিহাসিক সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তারা শপথ নেবে তাঁর আদর্শকে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার। বঙ্গবন্ধুর আমরণ স্বপ্ন বাংলাকে সোনার দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। এই সোনার বাংলা গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা আজ শপথ নেবে তাঁর সোনার ছেলে হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আমরাও এই শুভদিনে বাংলার নিতান্তই সাধারণ ঘরের অসাধারণ মহান নেতার দীর্ঘায়ু কামনা করি দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে। কামনা করি তাঁর স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার পদক্ষেপ প্রশস্ত হোক।
অশুভ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে হবে
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জনগণকে তাদের প্রায় অর্ধেক অভাব মেটাতে হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে। অথচ বর্তমানে সরকারী, আধাসরকারী ও বেসরকারী সংস্থা কর্তৃক আমদানীকৃত বিপুল পরিমাণ নিত্যব্যবহার্য পণ্যদ্রব্য দেশের বন্দরের জেটিগুলোতে পড়ে রয়েছে। এগুলো খালাস করার কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে জনগণের মাঝে এই সকল পণ্য সময়মত সরবরাহ না হওয়ায় দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আরো আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে।
একমাত্র চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতেই নাকি বিপুল পরিমাণ আমদানীকৃত পণ্যদ্রব্য পড়ে রয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, টি.সি.বি., কৃষি উন্নয়ন সংস্থা, ত্রাণ বিভাগ ও খাদ্য বিভাগ কর্তৃক আমদানী করা বহু প্রয়োজনীয় মালামাল ও খাদ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে রয়েছে। যে সকল আমদানীকারকগণ এই মালামাল আমদানী করেছেন তাঁদের মাল খালাস করতে কোনরূপ ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে উপযুক্ত তদারকের অভাবে বন্দরের জেটিতেই অনেক মাল বিনষ্ট হচ্ছে এবং অনেক পণ্য গায়েবও হয়ে যাচ্ছে।
এ সকল মালামাল খালাস না হওয়ার দরুণ বন্দর কর্তৃপক্ষকে আরো কতকগুলো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একদিকে যেমন বন্দরের অন্যান্য কাজ ব্যাহত হচ্ছে অন্যদিকে অনেক বিদেশী পণ্যবাহী জাহাজ জেটিগুলোতে জায়গার অভাবে তাদের পণ্যদ্রব্যাদিও খালাস করতে পারছে না। এভাবে সমস্যা বেড়েই চলেছে। জেটিগুলোতে পড়ে থাকা মাল খালাস না হওয়ায় ও আমদানীকৃত পণ্যদ্রব্য জাহাজ থেকে খালাস করতে অসুবিধা হওয়ায় একইরূপ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে—নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যাদির অপ্রতুলতা বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটাচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বার বার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও আমদানীকারকগণ মাল খালাসে উদাসিন্যতা দেখাচ্ছে।
তথ্যাবিজ্ঞ মহলের ধারণা, মাল খালাসে উদাসিন্যতা দেখানোর পিছনে বিশেষ এক চক্রান্ত কাজ করছে। এবং এ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র পাকিস্তানী মনা কিছুসংখ্যক মহারথী দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে। এরূপ চক্রান্তের উদ্দেশ্য বন্দরের মালামাল খালাস না হলে বাজারে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের অপ্রতুলতা ঘটবে এবং দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক নিয়মেই বৃদ্ধি পাবে। ফলে জনমনে সৃষ্ট অসন্তুষ্টি কার্যতঃ সরকারের বিরুদ্ধে যাবে এবং এতে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী নস্যাৎ করা সহজ হবে।
এহেন হীন উদ্দেশ্য ও ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। নতুনা এ চক্রান্ত শুধু সরকার নয় গোটা জাতির জন্য অমঙ্গলজনক হয়ে দেখা দিবে। কর্তৃপক্ষের উচিত এ অশুভ পাঁয়তারা সমূলে বিনষ্ট করার সাথে সাথে অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপও নেওয়া। যেমন যে সকল সংস্থা বা আমদানীকারকগণের মালামাল বন্দরের জেটিতে পড়ে রয়েছে ঐসকল আমদানীকারকগণকে অবিলম্বে নির্দেশ দেওয়া যেন তারা তা যথাস্থানে পৌঁছানোর জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষকেও এ ব্যাপারে নজর রাখতে হবে যেন বিশেষ মহল অথবা খুঁত ধরে মালামাল খালাসে কোনরূপ বিপত্তি না ঘটায়।
আমরা আশা করি কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। এবং এটা সত্য যে, বন্দরে বর্তমানে পড়ে থাকা মালামাল খালাস করে জনগণের মাঝে পৌঁছাতে পারলে অন্ততঃ ছয় মাসের জন্য দেশের নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যের অভাব মেটান সম্ভব হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক