You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২০শে জুন, বুধবার, ৫ই আষাঢ়, ১৩৮০

ঢাকা-কায়রো যুক্ত ঘোষণা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও মিশর সরকার কায়রো ঢাকায় উভয় দেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিকদের নেতৃত্বে মিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ দূত জনাব আতাউর রহমান সম্প্রতি মিশর সফর করেন এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর একটি বাণী তার কাছে দেন। মিশরীয় প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর বাণীটি সাদরে গ্রহণ করেন এবং খুব শীঘ্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। জনাব রহমান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর সফর করেছেন।
গত সোমবার ঢাকায় কায়রোতে যুগপৎ ভাবে ঘোষিত এক যুক্ত ঘোষণায় এই মিশন স্থাপনের কথাটির ঘোষিত হয়। মিশরের সাথে বাংলাদেশের মানুষের আত্মিক সম্পর্কটি সুপ্রাচীন। মিশরের মানুষের দুর্দিনে বাংলাদেশের মানুষ সবসময় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সমর্থন যুগিয়েছেন। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধকালে বাংলাদেশের জনগণ মিশরের মহান নেতা জামাল আব্দুন নাসের এর প্রতি মিশরের জনগণের প্রতি নিঃশঙ্কচিত্তে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সারা এশীয় ভূখণ্ডে সেদিন এতোখানি উদারচিত্ত তা নিয়ে মিশরের পাশে আর কাউকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অথচ সেদিন পাকিস্তানি শাসক-শোষক বর্গ বাংলাদেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জ্ঞাপন কেমন করে উপনিবেশবাদী প্রভুদের মনোরঞ্জন করতে কোন কশুর করেনি।
মিশরের পরলোকগত মহান নেতা বাংলার মানুষের সেদিনের এই আন্তরিকতা, এই একাত্মতায় গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তাই ১৯৬০ সালে যখন তিনি পাকিস্তান সফরে আসেন তখন আইয়ুবী সামরিক সরকার একমাত্র তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তার সফর সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নাসের তখন বলেছিলেন ‘আমি ঢাকায় যেতে চাই। ঢাকাবাসীদের শ্রদ্ধা জানাতে না পারলে আমার পাকিস্তান সফর অসমাপ্তই থেকে যাবে।’ সামরিক সরকার তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে ঢাকা সফরে আনে। ঢাকা সফরকালে তিনি স্টেডিয়ামে এক জনসভায় বাংলাদেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেছেন।
১৯৬৭ সালে ইসরাইল কর্তৃক মিশরের উপর হামলা চলাকালেও বাংলাদেশের মানুষ মিশরের প্রতি আবার দ্বিধাহীনচিত্তে সমর্থন জানায়। বাংলাদেশের জনগণ সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যে সম্রাজ্যবাদীদের সৃষ্ট বিস্ফোর ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে এবং প্যালেস্টাইনের মুক্তিযোদ্ধা ও আরববিশ্বের সম্মত সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কালে মিশরীয় নেতৃত্ব হানাদার পাকিস্তানিদের মিথ্যা ও খুচরা মূল্য প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছিল এবং বাংলাদেশের মানুষ তাদের আশানুরূপ সমর্থন নিঃশর্ত আরো বিশ্বের কাছ থেকে পাইনি। কিন্তু এখনই বিভ্রান্তি অপসারিত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তথা মিশর ও আরববিশ্ব বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনা তথা উপমহাদেশের সাবেক তথ্য সঠিকভাবে অবহিত হচ্ছেন।
ইরাক, লেবানন ও দক্ষিণ ইয়েমেন এর আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে তার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এক্ষণে মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে বড় দেশ আরববিশ্বের নেতা স্বীকৃতি দিয়ে মিশন স্থাপনে এগিয়ে আসছেন। এটা বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য এবং মিশর সরকারের বিদেশে বন্ধু লাভের ক্ষেত্রে এক বিরাট পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের মানুষ তাই আজ আশা করবেন মিশরের সাথে সাথে সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান, সৌদি আরব, কুয়েত এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের বাস্তব উপলব্ধি করবেন এবং বাংলাদেশ আরববিশ্বের প্রতি বন্ধুত্বের যে হস্ত প্রসারিত করেছে তাতে সাড়া দেবেন।

ব্রেজনেভ-নিক্সন শীর্ষ বৈঠক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ এর মধ্যকার ঐতিহাসিক শীর্ষ আলোচনা শুরু হয়েছে। উভয় নেতাই স্থায়ী বিশ্বশান্তির সাপেক্ষে কাজ করে যাবার শপথ সহকারে আলোচনা বৈঠকে বসেছেন। উভয় নেতার লক্ষণ হলো মানুষ ও মানবতার জন্য ‘শান্তির পটভূমি’ সৃষ্টি করা।
মিঃ নিক্সন বৈঠক প্রসঙ্গে বলেছেন, এ আলোচনা অধিক তর প্রগতির পথকে প্রশস্ত করে আমাদের উভয়ের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে।
মিঃ ব্রেজনেভ বলেছেন যে মস্কো-ওয়াশিংটন এর মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে। ভৌগলিক ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে।
এ শীর্ষ বৈঠক এর দিকে বিশ্বের জনগণ তাকিয়ে আছেন উৎসুক চিত্তে। কেননা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দুটো বৃহৎ শক্তির উপরে ভবিষ্যৎ বিশ্বশান্তি বিশেষভাবে নির্ভরশীল।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গত বছরে মস্কোতে শীর্ষ বৈঠকে মিঃ নিক্সন ও মিঃ ব্রেজনেভ যে যুদ্ধাস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৭ সালের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কের নতুন সীমিতকরণ এর ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করবেন।
সকলে আশা প্রকাশ করেছেন একটা কিছু হবে। কথা হল আদৌ তেমন নাটকীয় একটা কিছু হবে কিনা। এ প্রশ্ন ওঠার নৈপথ্য কারণ হলো শীর্ষ বৈঠক যে আগেও হয়নি এমন নয়। নেতারা বসেছেন। আলোচনা করেছেন। তারপর যা ছিল তাই রয়ে গেল। শের বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণ নিয়ে আলোচনা আগেও হয়েছে। বিশ্বে আলোচনার পর পরই আবার নতুন সমরাস্ত্র নির্মিত হয়েছে। যুদ্ধের আগুনকে আবার কোথাও জালানো যায় কিনা সে বিষয়ে শলাপরামর্শ হয়েছে। নতুন নতুন জোট গঠনের চেষ্টাও করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
ভিয়েতনাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বটে কিন্তু তা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। লাওস, কম্বোডিয়ায় এখনো যুদ্ধ নলের স্ফুলিঙ্গ বিদ্যমান। যেকোন সময়ে তা আবার ভয়াবহ দাবানল এর সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তান-ইরান এক নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে। এ জোট বাংলাদেশ ভারত উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের লিপ্ত। আরো ভূমিতে তো স্থায়ী বিষফোঁড়ার মতো ইসরাইল রয়েছে।
এ কথা কারো অজানা নয় যে বিশ্বশান্তির এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য প্রধানত দায়ী বৃহৎ শক্তিবর্গ। হদ শক্তিবর্গের অদৃশ্য ইঙ্গিতে নাচের পুতুলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন তাবেদার দেশগুলো।
এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রেজনেভ নিক্সন শীর্ষ বৈঠক এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ব শান্তির জন্য উপযুক্ত পটভূমি সৃষ্টির দায়িত্ব তাই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। দুটো দেশজুড়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন তাহলে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা আশা করি ব্রেজনেভ নিক্সন বৈঠক সাফল্যমন্ডিত হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে

কিছুদিন ধরে দেশে যেন দুর্ঘটনার হিড়িক পড়েছে। লঞ্চ ডুবি ও সড়ক দুর্ঘটনায় তার মধ্যে প্রধান।
গত পরশু এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। ঢাকা-ব ২৭১ নম্বরের একটি বাস টঙ্গী থেকে ঢাকা আসার পথে বনানী চেকপোস্টের কাছে রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে যায়। ফলে ঘটনাস্থলে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি প্রাণ হারায়। কমপক্ষে ষাট সত্তর জন আহত হয়েছেন। তারমধ্যে তিরিশ চল্লিশ জন গুরুতর আহত হয়েছেন বাঘ যাত্রীরা কম বেশি আঘাত পেয়েছেন।
আজকে উল্টে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায়নি। তবে সংবাদসূত্র অনুমান করছেন যে অতিরিক্ত যাত্রীবাহী বাসটি হয়তো বেশ দ্রুত গতিতে চলছিল। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই থাকায় গতির সঙ্গে ওজনের ভারসাম্য না থাকায় এ মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে এর আগেও পত্রিকান্তরে বহু লেখালেখি হয়েছে কিন্তু তাতে কাজ কিছু হয়নি বলেই চলে। একথা সর্বজন গ্রাহ্য যে সকল প্রকার দুর্ঘটনা প্রতিরোধের মূল কথা হলো সাবধানতা। সাবধান হতে পারলে দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমে যেতে বাধ্য।
দেশে পরিবহন ব্যবস্থা বর্তমান জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। হয়তো তাই বাসগুলোতে অতিরিক্ত মানুষের বোঝাই হয়। সেজন্যই সাবধানতার প্রশ্নটা বেশি করে দেখা যায়।
সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে হলে যে সকল সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত তন্মধ্যে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই না করা অন্যতম। এছাড়াও কতকগুলি কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। যেমন যাত্রীভর্তি বাসের গতি কবর সুনিয়ন্ত্রিত করতে হবে এবং শূন্য গতিতে তার মোড় নেওয়া মঙ্গল জনক। বাসচালক গতির এই নিয়ম সর্বদা মেনে চলছে কিনা তা দেখার জন্য অধিক সংখ্যক পুলিশ মোতায়েনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সর্বোপরি বাসগুলো চলাচলের উপযোগী কিনা তা মাঝে মাঝে পরীক্ষা করানোর নির্দেশ থাকা উচিত। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে পরিবহন সংস্থার অন্যতম প্রধান একটি কাজ হলো গাড়িগুলোর যান্ত্রিক অবস্থানাদি পরীক্ষা করে তার চলাচল উপযোগীতা দেখা। যে গাড়িটিকে শত শত লোকের জান ও মাল পরিবহনের দায়িত্ব দিয়ে সড়কে ছাড়া হয় তার চলাচলের যোগ্যতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মহল কে অবশ্যই ওয়াকিবহাল থাকতে হবে।
একটু সাবধানতা ও যুক্তিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের নিত্যদিনের অসংখ্য ঘটনা ও দুর্ঘটনা আজ আমাদের জীবনযাত্রাকে ক্রমশ দুঃসহ করে তুলেছে। ঘটনার মূল গলদ অনুসন্ধান করে প্রত্যেককে আজ সচেতন ও সাবধান হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার মত একটা সমস্যাকে আমরা অতিক্রম করতে পারছিনা এ বড় লজ্জার কথা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!