You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.06.18 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি চাই | সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে চাঙ্গা রাখতে চীনা মদদ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৮ই জুন, সোমবার ৩রা আষাঢ়, ১৩৮০

উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি চাই

রাজধানীর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ সূত্র বড় অনিয়মিত। এই অনিয়মিত যোগাযোগের দরুন নানা অসুবিধা ও ক্ষয়ক্ষতি ও দেখা দিচ্ছে। তার ফলে জনসাধারণের দুর্ভোগ একদিকে বাড়ছে অন্যদিকে জাতীয় উন্নয়নের অগ্রগতি ও ব্যাহত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী জেলা দিনাজপুর অঞ্চলে প্রচুর আম হয়। যৌথভাবে সরবরাহ করতে পারলে সমস্ত দেশের জনসাধারণের কাছে এই অতি প্রিয় ও পুষ্টিকর মৌসুমি ফলে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা নেওয়া যেত। কিন্তু রাজধানীর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ অব্যবস্থার দরুন তার অসম্ভব হয়নি। এর ফলে একদিকে ক্রেতাদের যথেষ্ট মূল্য আম কিনে খেতে হয়েছে। অপরদিকে লক্ষ লক্ষ টাকার ঝুড়ি বন্দি আম পরিবহনের অভাবে পচে নষ্ট হয়ে জাতীয় অপচয় এর পরিমাণকে বাড়িয়ে তুলেছে। আবার বলা যায় উত্তরাঞ্চল আম উৎপাদনেও সমৃদ্ধ। কিন্তু যোগাযোগ পরিবহনের অভাবে এই দেশের বিশেষ বিশেষ স্থানে যথা সময়ে সরবরাহ করতে না পারায় চিনি শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কেন জাতীয় ক্ষতির পরিমাণ উপেক্ষণীয় নয়।
যোগাযোগ সূত্রটা গড়ে ওঠে পরিবহনের মাধ্যমে। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে বর্তমানে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যাহত হয়েছে সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে। সড়কপথে আছে রেল-বাস ও কোচ। নৌপথে উভয় অঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যাতায়াত খুব কমই। তবে সড়কপথের বাধাস্বরূপ নদীগুলো অতিক্রম করার ব্যাপারেই নৌপরিবহন (লঞ্চ, স্টিমার, বার্জ, ফেরি ইত্যাদি) প্রয়োজন হয়। আকাশপথে আছে বিমান। সেও ঈশ্বরদী পর্যন্ত। চরাঞ্চলের আর কোন জেলার সঙ্গে রাজধানীর বিমান পথে যোগাযোগ নেই।
উত্তরাঞ্চল ও রাজধানীর মাঝখানের সড়কপথের প্রধান বাধা হলো যমুনা নদী। সড়কপথের যোগাযোগকে নিয়মিত ও নির্বিঘ্ন করার জন্য যমুনা নদীর উপর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা একটি সেতু নির্মিত হতে যাচ্ছে। এটা ভালো কথা। তবে এর ফলাফল পাওয়া যাবে বেশ কয়েক বছর পর। তাই এদিকের অচলাবস্থা দূর করবার জন্য আশু পদক্ষেপ কিছু নেওয়া প্রয়োজন বৈকি! সেজন্য নদীপথে পর্যাপ্ত ফেরি পারাপার বন্দোবস্ত যথেষ্ট সংখ্যক কোচ চলাচল এবং রেল গাড়ির সংখ্যা বাড়াতে হবে।
এর পটভূমিতে দেখছি প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ক্ষেত্রে। এই বরাদ্দ দিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে যথাযথ পরিমাণে ও যুক্তিসঙ্গতভাবে সম্পদ বন্টন এর মাধ্যমে রেলপথ, নৌপথ ও বিমানপথ এর সম্মানিত ও অনুপূরক উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এরমধ্যে উত্তরাঞ্চলের সৈয়দপুরে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আগামী বছরের বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে। রেলপথে কুড়িগ্রাম- ভুরুঙ্গামারী, শান্তাহার-রংপুর, নগরবাড়ি-ঈশ্বরদী একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে তাদের প্রাথমিক জরীপ কার্য শেষ করা হয়েছে।
উল্লেখিত পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ সূত্র গড়ে তোলার ব্যাপারে এ প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা ও যথেষ্ট নয়। পরিবহন কর্তৃপক্ষ কে উত্তরাঞ্চলের দিকে অবিলম্বে আরও কার্যকরী দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ একথা সত্য যে দেশ গড়ার কাজে কোনো গাফিলতি চলতে পারে না। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও পুনর্বাসন এর ক্ষেত্রে কোন অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সমর্থিত নয়। সর্বোপরি এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকেও বিপুলভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তোর অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যথার্থ যোগাযোগ সূত্র গঠনের আবেদনটির প্রকৃতপক্ষে একটি মৌলিক প্রশ্ন। অতএব এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন অধিক তর চিন্তা করেন এবং যুক্তিযুক্ত ভূমিকা পালনে তৎপর হোন এই আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা।

সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে চাঙ্গা রাখতে চীনা মদদ

মার্কিনী অস্ত্রে সজ্জিত এবং সি, আই, এর স্নেহভাজন ইরানের শাহ যে ‘স্বাধীন জাতীয় নীতি’ অনুসরণ করে আসছেন তাকে পঞ্চশীলর অনুরূপ বলে অভিহিত করে সমাজতান্ত্রিক চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ চি পেং ফেই- এর প্রতি তাদের দেশের পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই নয় মিঃ চি পেং ফেই রণসজ্জা কে স্বাগত জানিয়ে পারস্য উপসাগরে ইরানের প্রভুত্ব কায়েম সর্বাত্মক সহায়তা দানের আশ্বাস দিয়েছেন।
এসব বড় ঘরের কথা। বড়কর্তা মেজকর্তা ভাগবাটোয়ারা। এতে করে যদি নফর শাহের কোন তরক্কি হয় তবে তাতে আমাদের বাদ সাধবারই বা কি প্রয়োজন রয়েছে। ইরানের শাহ এই সেদিনও আমেরিকান এক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কর জোরে বিনতি জানিয়েছিলেন তার মাধ্যমে আমেরিকান সরকারের কাছে, ‘পারস্য উপসাগরে আমেরিকার শক্তি বাড়ানো হোক’। চীন-মার্কিন নয়া জোট এর প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত শাহ যদি চীনা আশীর্বাদ লাভে সক্ষম হয়ে থাকেন তবে তাতে বিশ্ব বিস্মিত হবে না। কিন্তু অসুবিধা হয়েছে সাধারণ মানুষের যাদের কানের কাছে হরহামেশা চীনা ডঙ্কা পিটিয়ে প্রচার করা হচ্ছে যে মাও-এর চীন সামাজিক প্রগতি এবং বিশ্ব শান্তির স্বপক্ষে সকল আন্তর্জাতিক সম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইরানের কথাই আবার ফিরে আসা যাক। সেখানে রাজতান্ত্রিক শাসন প্রচলিত। বিশ শতকের এসব জগতের যে গুটিকয়েক দেশে সেই মধ্যযুগীয় রাজশাসন প্রচলিত রয়েছে ইরান তাদের অন্যতম। দু’বছর আগে সেখানে রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বৎসর পূর্তি উৎসব খুব আরম্বরে পালিত হল। উজির-নাজির বিদেশি মেহমানরা ইনাম পেলেন। ‘বাড়িয়া’শান শওকত এর যৌন প্রদর্শন করা হলো। ইরানের লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ পর্বত গুহা থেকে বেরিয়ে এসে আধপেটা শেষ শান শওকত দেখলেন। সতর্ক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো হয়তো কারো কারো হৃদয় থেকে।
যে দীর্ঘশ্বাসে কিন্তু হারিয়ে যায়নি সেখানকার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা চেতনা। মোসাদ্দেক নেই তার বামপন্থী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাজা লাল খুন মুছে যায়নি ইরানের ওই রাজপ্রসাদ থেকে। ইরানি প্রেসের শত বিধিনিষেধের পোলিও খবর আসছে দেশ প্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে নিধনের। আজ তিনজনকে, কাল আরো অনেককে ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে ভারত বর্ষ থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া ময়ূর সিংহাসন কে নিষ্কণ্টক করা হচ্ছে। কিন্তু সে সংগ্রামী বিবেককে কি হত্যা করা সম্ভব হবে! নয়া চিনা আশ্বাসের শাহ আরো কত বিলিয়ন হতে পারবেন?
চার ডিভিশন ইরানি সৈন্য ছুটেছে বেলুচিস্তানে। সেখানকার মুক্তিপাগল মানুষকে দাবিয়ে দেবার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে তারা সাহায্য করবে। পাকিস্তান সীমান্তের গোড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে ইরানি সেনানিবাস। সবকিছুতেই রয়েছে একটা রোদ্দুর বাঁধন। চীন-আমেরিকা পাকিস্তান-ইরান মিলে যে সামরিক লুকিয়ে তুলছে তার ভবিষ্যৎ ভেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটা দেশের নাগরিক আমরা উদ্বিগ্ন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী যা বলেছেন সেলাই নেতারা কাজ করে আসছেন বহুদিন ধরে। তাদের সহজ স্বীকৃতি সৎ সাহসিকতা পরিচায়ক। আদর্শের কথা উল্লেখ করে এই তাদের আমরা চোখ খুলবা আহবান জানাবো না। শুধু বলবো আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তথা পতনোন্মুখ প্রতিক্রিয়াশীলতাকে বাঁচবার জন্য যারা হন্যে হয়ে উঠেছেন তাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অমগ পরিণতি স্বীকার করে নিতে হবে। এটা নবজাগ্রত বিশ্বের সংগ্রামের যুগ, এটা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ তথা সকল প্রতিক্রিয়াশীলতার ধ্বংসের যুগ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন