You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.06.17 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | এবারের বাজেট | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৭ই জুন, রোববার, ২রা আসাঢ়, ১৩৮০

এবারের বাজেট

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ। রাজস্ব খাতে ৪১১,৩কোটি টাকা আয়। ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯৫,৩০কোটি টাকা। ৫২৫,৩৫কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে উন্নয়ন ও পুননির্মাণ হাত মিলিয়ে। রাজস্বখাতে উদ্বৃত্ত ১১৬,০১ কোটি টাকার মধ্যে ১০০,৭৬ কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয় এর একাংশ পূরণ করবে। একহাতে বাকি টাকার মধ্যে ৩৫২,০০ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে বলে অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন। তারপরও যে ঘাটতি থাকে তা পূরণ করার জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর করে, প্রাইজবন্ড সেভিংস সার্টিফিকেট ইত্যাদি বিক্রয় করে এবং রাষ্ট্রে ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান হতে পাওয়া যাবে। তবু যে ঘাটে থাকবে তা পূরণের জন্য বিভিন্ন কর আদায়ের চেষ্টা করা হবে। আর এ প্রচেষ্টার সাফল্যমন্ডিত নাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংক সমূহ থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হবে।
বাজেটকে উদ্বৃত্ত আখ্যা দেওয়া হলেও আসলে ঘাটতি বাজেট অর্থমন্ত্রী সংসদে পেশ করেছেন। রাজস্ব খাতে ৭৯,৬ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত দেখানো হলেও এর সাথে উন্নয়ন বাজেট যোগ করলে সামগ্রিক বাজেট ১৮,৬০ কোটি টাকা ঘাটতি পাওয়া যাবে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা শিল্প বাণিজ্য ও পরিবহন ক্ষেত্রে অধিকতর প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জন, আত্মনির্ভরশীলতার পদক্ষেপ গ্রহণ, অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বন্টন ব্যবস্থার উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ক্রম দ্রব্যমূল্যের গতিও প্রবণতাকে নিম্নমুখী অস্থিতিশীল করার সর্বোপরি সর্বক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলন এর প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন।
পার্লামেন্টে প্রথম বাজেট পেশের পূর্বে পরিকল্পনা কমিশন বা অর্থমন্ত্রণালয় দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন রিপোর্ট পেশ করেন। এরূপ একটি রিপোর্ট এর অভাবে বাজেট নিয়ে আলোচনা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কোন মতামত ব্যক্ত করা বিপদজনক ব্যাপার। সেই বিপদের ঝুঁকি নিয়েই আমরা বাজেট সম্পর্কে আলোচনায় লিপ্ত হচ্ছি।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বাজেট প্রণয়ন একটা জটিল কাজ। করনীতির মারপ্যাঁচের মধ্যে দিয়ে যে সেখানে রাষ্ট্রপরিচালনার মাশুল তুলে আনতে হয়। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন শ্রেণীর জনগণের গায়ে অতিরিক্ত চর্বি খুলে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামো খরচ মেটাতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বাজেট নীতি সহজতর।
সামাজিক উৎপাদনের লভ্যাংশ থেকে সেখানে রাষ্ট্রের ব্যয় বহন ও উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের চেষ্টা চালানো হয়ে থাকে। এক স্মৃতির কলা-কৌশলের সুযোগ দেখিয়ে জনগণকে বোকা বানাবার অবকাশ সেখানে কম। আমাদের বাজেটের দিকে গভীর ভাবে দৃষ্টি দিলে একটা জিনিস সহজে ধরা পড়বে যে অর্থমন্ত্রীর জটিল পুঁজিবাদী বাজেটের নিয়ম অনুসারে কর আরোপের মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবেন, না জাতীয় উৎপাদনের লভ্যাংশের মাধ্যমে এগুবেন এমন কোনো সুস্পষ্ট সীমারেখাটা না হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য টাল্যোর উপর শতকরা ৩০ ভাগ থেকে ৪০ ভাগ শুল্ক বাড়িয়ে অতিরিক্ত ৪৭ লক্ষ টাকা আদায় হবে বলে তা প্রকাশ করা হয়েছে। তেমনি ৫ টাকার অনূর্ধ্ব মূল্যের প্রতি পাউন্ড কাঁচা তামাকের ওপর আমদানি শুল্ক এক টাকা করে বাড়িয়ে দুই কটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ট্যালো ও কাঁচা তামাকের উপর কর ধার্য এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাবান ও সিগারেটের দাম বৃদ্ধি পাবে। নতুন কর আরোপের ফলে যে পরিমাণ অর্থ সরকার পাবেন তা সরাসরিভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে ও পাওয়া যেত। তাতে করে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলো লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানো যেত।
বাজেটে যন্ত্রাংশ সহ নানা ধরনের কাঁচামাল এর উপর কাজ কর ধার্য করার নীতি অব্যাহত রাখা হয়েছে। বস্তুত এর কোন প্রয়োজন ছিল না। সরকার প্রদত্ত হিসাব মতে দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ শিল্প সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়েছে। আমদানি করা কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ এইসকল কারখানায় ব্যবহার করা হবে। সুতরাং এই নীতি অব্যাহত রেখে সরকার নিজের উপরই নিজে কর ধার্য করেছেন। কেবল আয়ের খাত পরিবর্তন হয়েছে। কারখানাগুলির সুলভে কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ পেলে তার লভ্যাংশ বেড়ে যেত। এ উৎপাদনের লভ্যাংশ দেখিয়ে অর্থ পেতে পারতেন। ট্যাক্স দেখিয়ে আয় বৃদ্ধির এই শুভঙ্কর এর অর্থ মন্ত্রী কেন খুললেন বোঝা মুশকিল। বার্ষিক পরিকল্পনা বার্ষিক উন্নয়ন বার্ষিক।
বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার আকার কমিয়ে আনার সত্বেও কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন-প্রকল্পসমুহ বাস্তবায়নের পথে যাতে অসুবিধা সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে সরকার সজাগ রয়েছেন। অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় ৩৫০০০ পাওয়ার পাম্প এর কথা উল্লেখ করেছেন। এ পাওয়ার পাম্প স্থাপনের লক্ষ্য গত বছরই নির্দিষ্ট ছিল। এবারে অন্তত ৫০০০০ পাওয়ার পাম্প স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি। কেননা সবুজ বিপ্লব কে সার্থক করে তুলতে হলে চাষের অন্যান্য আনুষাঙ্গিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
বাজেটের শতকরা কুড়ি ভাগের শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে রা আমূল পরিবর্তন না করে যদি অর্থ ব্যয় করা হয় তাহলে তাতে ডিগ্রিধারী (অশিক্ষিত?) বেকার দের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
মোটা সুতি কাপড়ের উপর কর মওকুফ প্রশংসার যোগ্য। এতে জনসাধারণ উপকৃত হবেন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে আমদানিকৃত মোটা কাপড়ের গাইটে যেন মিহি কাপড় না আসে। কারণ বাংলাদেশে ইধার কা মাল উধার করার মত লোকজনের অভাব নেই।
বাজেটের রেশন চালের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবটি সময়োচিত হয়নি। আমরা জানি যে সরকারকে যথেষ্ট সাবসিডি দিতে হচ্ছে। তবে রেশনের চালের দাম বেতন কমিশনের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বর্ধিত বেতন ঘোষণার সঙ্গে বাড়ানো উচিত ছিল। তাহলে তেমন কোনো সমালোচনার সম্মুখীন হতে হতো না। বাংলাদেশের রেশন পাচ্ছে মোট ৪০ লক্ষ মানুষ। তাদের মধ্যে সবাই শহুরে। সুতরাং এ নিয়ে আর হয়েছে অতটা হত না।
পরিশেষে আমরা এ কথাই বলবো যে, কর আরোপের মাধ্যমে আয় দেখানোর চেয়ে উৎপাদন থেকে আয় দেখানো উচিত। কেননা তাহলে জনগণ এত উৎসাহিত হবে। জাতীয় মনোবল ফিরে পাবে। দেশ দেশ স্বয়ংসম্পূর্নতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে পারবে। আর্মন বলি হলো একটি দেশ ও জাতির জন্য বিশেষ সম্পদ। বাজেটে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়নি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন