You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১০ই জুন, শনিবার, ২৬ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০

যুদ্ধাপরাধী বিচার ও উপমহাদেশীয় শান্তি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত ৭ই জুন ব্লিংস পত্রিকার একজন প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যুদ্ধবন্দী ও উপমহাদেশীয় রাজনীতি সম্পর্কে তার অভিমত প্রকাশ করেছেন। পুনরায় তিনি জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন- জনাব ভুট্টো যাই বলুন আর করুন না কেন যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশের মাটিতে বিচার হবে। সম্প্রীতি জনাব ভুট্টো বিশ্ব আদালতে ধর্না দিয়েছেন। সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন- ভুট্টো সাহেব যেখানে ধর্ণা দেন না কেন বাংলার মাটিতে যারা গণহত্যা চালিয়েছে, নারী নির্যাতন করেছে, শিশু হত্যা করেছে, সম্পদ ধ্বংস করেছে তাদের বিচার হবে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নয় বরং তারা যে জঘন্য অপরাধ করেছে তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে এই দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সেজন্যই আমরা বিচার করছি। পাকিস্থানে বাঙালিদেরকে আটকে রেখে জনাব ভুট্টো যে নির্যাতন চালাচ্ছেন সেকথাও প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সঙ্গে উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে তিনি বিশ্ব বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উপমহাদেশীয় রাজনীতি উত্তেজিত করার জন্য ভুট্টো সাহেবের বাঙালি নির্যাতনের নীতি মূলত দায়ী। পাকিস্তানি জনসাধারণের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন- ‘আপনারা সুখে থাকুন-জানিনা আপনাদের ভাগ্যে কি রয়েছে’। ইতিপূর্বে উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান এর জন্য ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা বিশ্বের সকল জাতির কাছে সমাদৃত হয়েছে কিন্তু পাকিস্তান আজও সে প্রস্তাব থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। অথচ পাকিস্তান যদি এ প্রস্তাব সুস্থ মস্তিষ্কে বিবেচনা না করে দেখে তাহলে উপমহাদেশীয় সমস্যাবলীর সমাধান সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখিত এর সাক্ষাৎকার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। উপমহাদেশের তিনটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হোক এটা সকলেরই আশা বাংলাদেশে যে আজ বাস্তব সত্য একথা পাকিস্তানকে মেনে নিতে হবেই।
কোন প্রকার অভিসন্ধি নিয়ে উভয় দেশের মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন শান্তির স্বপক্ষে। তারা পারতপক্ষে কোন্দল এড়িয়ে সহাবস্থানের নীতিতে বসবাসের আগ্রহী। এ ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা ও উল্লেখযোগ্য কিন্তু পূর্বাপর পাকিস্তান তার অনমনীয় মনোভাব ব্যক্ত করে চলেছে। ফলে উপমহাদেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। যুদ্ধবন্দী বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ অত্যন্ত যুক্তিও উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশ নব্বই হাজার যুদ্ধবন্দীকে বিচার করার কথা বলেনি তারা এই বিপুলসংখ্যক এর মধ্যে থেকে মাত্র একশত পঁচানব্বই আকার জনকে যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে মনোনীত করেছে। প্রতিটি বিপ্লবোত্তর দেশে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার করা হয়। বাংলাদেশ বিরাটসংখ্যক যুদ্ধবন্দীকে বিচার করার জন্য মনোনীত করেনি। ন্যয়ত ও উদারতাবসতো বাংলাদেশ মুষ্টিমেয় অপরাধীকে বেছে নিয়েছে। তবু পাকিস্তান বাহানা তুলেছে বিনাবিচারে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির জন্য। ভুট্টোর এ কান্নাকে বাংলাদেশ কোনদিনই প্রশ্রয় দেবে না। এবং পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। বঙ্গবন্ধু ব্লিৎস এর প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে কথাটাই পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। আমরাও তাই পুনরায় আমাদের অভিমত পোষণ করব যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এবং বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী তা হবে। আর উপমহাদেশের নিরবিচ্ছিন্ন শান্তির জন্য আমরা অক্লান্ত কাজ করে যেতে প্রস্তুত।

প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ার ডাক

ঐতিহাসিক সাতই জুন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বৃন্দ সারাদেশব্যাপী দুর্বার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্রকারী, গুপ্তঘাতক, চোরাকারবারি, মুনাফা শিকারি এবং সর্বপ্রকার সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। নেতৃবৃন্দ মন্তব্য করেছেন যে, রাজাকার, আল-বদর, আল- শামস এবং ভিন্ন মুসলিম লীগের পাত্তারা মওলানা ভাসানীর ছত্রছায়ায় চীন এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় বাংলার স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে। আন্দোলন আর অনশনের দোহাই দিয়ে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে বলে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। নেতৃবৃন্দ গুপ্তহত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী, মুনাফাখোর ও সমাজবিরোধীদের কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্য দেশবাসীকে প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে স্বাধীনতাবিরোধী যেকোন আঘাতে আসুক না কেন তা প্রত্যক্ষ করতে বাংলার মানুষ এগিয়ে আসবে এতে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই।
বাংলাদেশ আজ সংকটে আকীর্ণ। দুর্নীতিতে ভরপুর। স্বাধীনতার ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন পতাকা উড়ানোর মওকা খুঁজছেন। অতিবিপ্লবী স্লোগান উচ্চকিত করছেন। গুপ্ত হত্যাকারীদের অস্ত্র প্রতিনিয়ত ঝলসে উঠছে। দেশ প্রেমিক নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা আজ চরম ভাবে বিপর্যস্ত। পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন আমলারা মুজিবের শাসন ব্যবস্থা বানচাল করার জন্য সদা তৎপর। এমতাঅবস্থায়, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে আজ সর্বপ্রথমে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে শামিল হতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম এবং দেশ গড়ার সংগ্রাম রয়েছে আমাদের সামনে। আমাদের প্রতিটি মানুষকে আজ দুর্নীতিবাজদের উৎখাত করার জন্য স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্তকে নির্মূল করার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত দরকার। স্বাস্থ্য ও বস্ত্র সমস্যা সন্দেহ নেই আমাদের এক চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় নিমজ্জিত করেছে। দেশের এবং দেশের মানুষের শত্রুরা এই সুযোগে মুসলিম বাংলার ধুয়া তুলে এক অরাজক অবস্থার উদ্রেক করেছে। কিন্তু এদের অরাজকতার অবসান না করতে পারলে স্বাধীনতার শত্রুরা ক্রমাগত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। গুপ্তহত্যা বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল হবে না। তাই আসুন আমরা দেশব্যাপী ঐক্যের প্রাচীর গড়ে তুলি। যাতে স্বাধীনতার শত্রুরা কোনক্রমে নাক গলাতে না পারে। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে আজ এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সাতই জুনের সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ একটি সমালোচিত আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ডাক সফল হোক।

ইরান-পাকিস্তান কোলাকুলি

ইরানের সহায়তায় পাকিস্তান তার পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানে তিনটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে বলে বেলুচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সরদার আতাউল্লাহ খান জানিয়েছেন। সরদার মেঙ্গল গত বুধবার করাচিতে এক জনসভায় বলেছেন যে, বেলুচিস্তানের পশ্চিমাংশে তুর্বাট এবং খাড়ান এলাকায় ঘাঁটি নির্মাণের স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। তৃতীয় ঘাঁটি নির্মিত হবে খুজতারে। ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপে এই ঘাঁটিগুলো নির্মাণের ফলশ্রুতি বলেও তিনি জানিয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার ক্রীড়নক ভুট্টো সরকারের অনিয়মতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বেলুচিস্তানের সর্বত্র বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ভুট্টা সরকার আইয়ুবী একনায়কত্বের কায়দায় এই প্রদেশের নির্বাচিত সরকারকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে নিতান্ত অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বরখাস্ত করে। এরপর থেকেই সেখানটায় বিক্ষোভ বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিক্ষোভ বিদ্রোহ দমন করে ভুট্টো তার নির্যাতনমূলক কার্যের দোসর ও বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা চালানোর প্রধান নায়ক টিক্কা খানের সহায়তায় এই প্রদেশ বেপরোয়া বোমাবর্ষণ এর মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে নির্বিবাদে হত্যা করে। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে উন্মেষ বেলুচদের দমন করার জন্য ভুট্টো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় ইরানের শাহের কাছেও ধর্না দেন এবং বেলুচিস্তান কে ইরানের হাতে তুলে দেবার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন বলে নে প্রধান জনাব আব্দুল খান অভিযোগ করেছেন।
বেলুচিস্তানে বর্তমানে এ হেন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের ঘটনা কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক রাজনীতির অতীতের সাথে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং তার সাথে সাথে আইয়ুব খানের পতন এরপর পাকিস্তানি পাঞ্জাবি সামরিক চক্র তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জাগ্রত জনতা ও স্বাধিকার আদায়ের দাবিতে অগ্নিশপথ যুক্ত বাঙ্গালীদের চক্রান্তমূলক কাজের আশ্রয় নিয়েছিল।
ইরানের সাহায্যে এই সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের আরো গভীর উদ্দেশ্যটা হচ্ছে ইরানের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে পাকিস্তানের নতুন গাঁটছাড়া বন্ধন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারত-বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর পার্শ্বচাপ সৃষ্টি করার জন্য এই এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে আগ্রহী ছিল। এ খনে ক্রীড়নক ভুট্টো সাহেবের সাহায্যে ইরানের মাধ্যমে সেটাই ফলপ্রসূ করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে। কাজেই এই সামরিক ঘাঁটি কেবল উপমহাদেশকে ক্ষতবিক্ষত করবে না পাকিস্তান কেউ ছিন্নভিন্ন করে ছাড়বে। ভুট্টো সাহেব, সময় থাকতে সাবধান হোন!

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!