You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৭ই জুন, বুধবার, ২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০

কাগজের দাম কমাতে হবে

কাগজের অভাব নেই বাংলাদেশে। কর্ণফুলী পেপার মিল এর কাগজ বিদেশেও রপ্তানি করা যেতে পারে। কাগজের অভাব নেই তবু দাম কমছে না। চক্রবৃদ্ধি হারে দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও যে কাগজের দাম ছিল পঁচাত্তর পয়সা এখন তা বেড়ে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে তিন টাকায়। তাও সব সময় পাওয়া যায় না।
লেখার ও ছাপার কাগজের মূল্য বৃদ্ধিতে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন বইপত্রের প্রকাশকেরা। দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য। অন্যদিকে কাগজের মত সহজলভ্য জিনিসের মূল্য বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত ও চিন্তান্বিত সবাই।
গতকাল বাংলার বাণীতে কাগজের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কিত সংবাদে বলা হয়েছে, ঢাকার বাজারে এখন ৭০ টাকার ডবল ডিমাই ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লেখার ও ছাপার কাগজ সহ বিভিন্ন রকমের কাগজ বর্তমানে কোম্পানীর নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দেড় গুণ ওদ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের লেখার ও ছাপার কাগজের মূল্য বৃদ্ধির কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই. এক দিস্তা কাগজের উৎপাদন মূল্য পয়ত্রিশ পয়সা থেকে ছত্রিশ পয়সা। অথচ সেই কাগজে নানান হাত ঘুরে বাজারে বিক্রি হয় তিন টাকা দিস্তা। এহেন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রহস্য কোথায়?
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কাগজ বোর্ড কর্পোরেশনের জৈনিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আজ কাগজের ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। এইসব অব্যবসায়ী ও অসাধু ব্যবসায়ী বর্তমানে কাগজ মজুদদারির মাধ্যমে কাগজের বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সুযোগমত তার দেড়গুণ দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছে। উক্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, কাগজের মূল্য বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন আসতে পারে না। কারণ কর্ণফুলী পেপার মিল বর্তমানে দৈনিক ৮০ টন কাগজ উৎপাদন করছে। এই ৮০ টন এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ৬০ থেকে ৬৫ টন মাত্র। বাকি কাগজ আমাদের উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, কাগজের ঘাটতি বাংলাদেশের না থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই কাগজের বাজারে কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। এই অসাধু ব্যবসায়ীরা কাগজ মজুদ করে সংকট বাড়িয়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিগত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত খোলাবাজারে যতদিন কাগজের ব্যবসা চলেছে কতদিন কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে সাময়িকভাবে ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর প্রথা চালু করার পর থেকে বর্তমান অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া কাগজ বিতরণ সম্পর্কে আজও কোনো স্থায়ী সরকারি নীতি নির্ধারিত হয়নি।
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে যে, কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে টিলার ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছেন।
কার পাপে লেখার বা ছাপার কাগজ এর অবস্থা স্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে এ নিয়ে চুলচেরা বিচার আমরা করবো না। আমরা বলব, কাগজের উদ্ধৃতি যখন বাংলাদেশের রয়েছে তখন যেকোন উপায়ে সরকারকে কাগজের দাম কমাতে হবে। প্রয়োজন হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে কাগজের ন্যায্যমূল্যের দোকান খুলতে হবে। শুধু তাই নয় কাগজ বিতরণ সম্পর্কিত সরকারি সিদ্ধান্ত যথাশীঘ্র সম্ভব গ্রহণ করতে হবে। সব কথার শেষ কথা হল যে- কোন উপায়েই হোক না কেন কাগজের দাম কমাতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সংকট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সঙ্কট এবার যেন অতীতের সকল রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। বিভিন্ন অনুষদে অনার্স কোর্সে ভর্তির জন্য প্রতি সীটে গড়ে ৫০ খানা করে আবেদন পত্র পেশ করা হয়েছে। সবচাইতে ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে প্রকাশ, বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের প্রতি ৫০ টি আসনের জন্য গড়ে তিন হাজার খানা করে আবেদন পত্র পেশ করা হয়েছে। অবশ্য আবেদনপত্রের এই ভয়াবহ বর্ধিত সংখ্যা হ্রাসকল্পে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে আগে থেকে ব্যবস্থা নেননি তা নয়। তারা এর জন্য একটি নিয়মকানুনও বেঁধে দিয়েছিলেন। এতে বলা হয়েছিল যে, স্কুল সার্টিফিকেট ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় শতকরা ৪৫ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণদের চলতি সমাজ বিজ্ঞান, বাণিজ্য আইন অনুষদে এবং শতকরা ৫০ ভাগ নম্বর পেয়ে বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তির জন্য আবেদন পত্র পেশ করা যাবে। মজার ব্যাপার, এই ভর্তিচ্ছু আবেদনকারীরা সকলেই কিন্তু কর্তৃপক্ষ এসব বিধিনিষেধ মেনে আবেদনপত্র পেশ করেছেন। কতৃপক্ষ এখন কি করবেন সেটাই ভাবার কথা।
এই হাজার হাজার দরখাস্তকারীর মেধা সম্পর্কে সম্পূর্ণ যাচাই করার পর পরই তাদের ভর্তি করা যেতে পারে। কেননা গত দু’বছর স্কুল সার্টিফিকেট ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা গুলোতে যে হারে গণটোকাটুকি চলেছে, পরীক্ষক, গার্ড এবং অন্যান্যদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে যেভাবে পরীক্ষায় পাশ করার গেছে-সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার পরিবেশে এবার মেধার পরিচয়টাই বড় হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
আমরা মনে করি, এই হাজার হাজার দরখাস্তকারীর ভর্তির জন্য সঠিক ভাবে পরীক্ষা নেয়া হোক এবং এতে দেখা যাবে যে এমন অনেক ছাত্রও আছেন যারা গণটোকাটুকি বদৌলতে হয়তো বা ওই সব পরীক্ষায় বেশ ক’টা ডিভিশন এমনকি লেটারও পেয়ে থাকলে লেখাপড়া ও জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে ডুডু। আবার অন্যদিকে এমন সব ছাত্রও রয়ে গেছেন যারা গণ টোকাটুকির সুযোগ পাননি বা পেয়েও অনেকে নেননি, এক্ষেত্রে সঠিক মেধার যাচাইকালে তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো বা ভর্তি হবার সুযোগও লাভ করবেন।
এছাড়াও দেশ স্বাধীন হবার পর দেশের সাধারণ মানুষের মনে শিক্ষার স্পৃহাও বেড়েছে। সেই স্পৃহা কেও কর্তৃপক্ষ এবং সরকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতে হবে। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ সর্বত্রই শিক্ষার পাদপীঠে ভর্তিগ্রহণেচ্ছুদের আরো সুযোগ দেয়ার জন্য আসন সংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা অপরিহার্য।

বস্ত্র শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে

অবাধ সাধারণ বাণিজ্য লাইসেন্সে কাপড় আমদানি করার সিদ্ধান্ত গঠিত হবার পর গুদামজাতকারী ব্যবসায়ীরা বাজারে কিছু কিছু করে কাপড় ছাড়তে আরম্ভ করেছে। এতে করে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকায় গত সপ্তাহে কাপড়ের দাম শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ কমে এসেছে।
এ মাসের মধ্যেও ও, জি, এল এর দশ কোটি টাকার মত কাপড় দেশে পৌঁছে গেলে এই দাম আরো কমবে বলে আশা করা যায়। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের বস্ত্র সঙ্কট ক্রমশঃ কঠিনতর হয়েছে এবং বস্ত্র সমস্যা বর্তমানে আমাদের অন্যতম মুখ্য সমস্যা বলে গণ্য হচ্ছে। দেশকে বস্ত্রশিল্পের স্বয়ংসম্পূর্ণ না করে তোলা পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে ওঠা যাবে না। সেক্ষেত্রে ও, জি, এল, মারফত কাপড় আমদানি করে বস্ত্র সঙ্কটকে হালকা করা যেতে পারে মাত্র, তবে স্থায়ীভাবে বস্ত্র সমস্যার সমাধানে ভিন্ন পথে অগ্রসর হতে হবে।
আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ তাঁত চালু আছে। ঠিকমত সুতা সরবরাহ করা গেলে তার দ্বারা আমরা আমাদের চাহিদার প্রায় অর্ধেক কাপড় পেতে পারি এছাড়া বস্ত্র কলগুলির মোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ৭ কোটি গজ। উৎপাদন আরো ৫ কোটি বাড়ানো যায়। অবশ্যই সবক্ষেত্রে সুতার ওপর নির্ভর করতে হয়। বাকি চাহিদা মেটানোর জন্য ২১ কোটি গজ কাপড় আমদানি করা আবশ্যক হবে। এতে করে দেশের সৎবাৎসরিক চাহিদা মেটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হচ্ছে একশত ত্রিশ থেকে একশত পঞ্চাশ কোটি টাকা। এরই প্রেক্ষিতে দেখা যায় দেশে সুতা আমদানি খুবই অনিয়মিত এবং তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তদুপরি সুতা বন্টনের ব্যাপারে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে।
সুতা আমদানির ব্যাপারে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা মুনাফায় বিনিময় তা প্রথম দফার হস্তান্তর করেন। অতঃপর সুতা আমদানিকারকগণ সুতা আমদানি করে মুনাফা লুটতে চায় এবং কয়েক হাতবদল হয়ে তা যখন তাঁতীদের হাতে পড়ে, তখন সেই সুতার মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে কাপড়ের দাম তাকে বাড়িয়ে দিতে হয়। সে কাপড় যখন বাজারে যায় তখন তা আর ক্রেতাসাধারণের ক্রয়-সীমার মধ্যে থাকে না।
অন্যদিকে সহসা গজিয়ে ওঠা নতুন একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে প্রচুর মুনাফা লুটে খায়।
বস্ত্র শিল্পের ব্যাপারে আমাদের এই পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে গেলে বিশেষভাবে কতকগুলি কার্যকরী পন্থা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। প্রথমতঃ অত্যন্ত কঠোর হস্তে সুতা আমদানিও বন্টনের নিয়ম এবং দুর্নীতি দমন করতে হবে তাহলে চাহিদার অর্ধেক বস্ত্র এখান থেকেই পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়তঃ বস্ত্রশিল্প প্রসারের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে সেজন্য বস্ত্র শিল্প কারখানা আরও উন্নত ও প্রসারিত করতে হবে। বস্ত্রশিল্প প্রসারের ব্যাপারে সম্ভাব্য দেশীয় কাঁচামাল এর ওপর নির্ভর করতে হবে। বিশিষ্ট গবেষক মহল থেকে পূর্বাহেই জানানো হয়েছে যে এদেশে কোন কোন অঞ্চলে বেশ ভালো তুলার চাষ হতে পারে। সেই সম্ভাবনাকে বর্ধিত করে বস্ত্রশিল্প সমপ্রসারণের জন্য কাঁচামাল তথা তুলা চাষের প্রয়াস নিতে হবে। সামনে একটা সুপরিকল্পনা রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সততার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। অন্যথায় এই সংকট আমরা কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারব না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!