You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.06.06 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বাণিজ্য চুক্তি পূরণ করা হোক | যক্ষ্মা থেকে রক্ষার লড়াই | সকলকেই ভাবতে হবে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৬ই জুন, মঙ্গলবার, ২২শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০

বাণিজ্য চুক্তি পূরণ করা হোক

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হতে চলেছে বলে গতকালের বাংলার বাণীতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে উভয় দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর স্বাক্ষর দানের চেয়ে ১ বছর মেয়াদী বাণিজ্যচুক্তি ঘোষিত হয়েছিল তা রক্ষা করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ এপ্রিল মাস পর্যন্ত ভারতে তিন কোটি ৭৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩ টাকার মাল রপ্তানি করেছে অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের রপ্তানি করেছে ১৮ কোটি ৭৮ লাখ ৯৮ হাজার ৬০০ টাকার মাল। ভারসাম্য রক্ষার জন্য সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়া সত্বেও রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। চুক্তির অধীনে ভারতকে ২৫ কোটি টাকার মাল দেওয়ার কথা ছিল। একটি তথ্য পরিবেশন করে বলা হয়েছে যে ভারত বিশ কোটি টাকার বেশি মাল রপ্তানির জন্য গত এপ্রিলে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে এল সি খোলার সুযোগ পেয়েছে প্রায় ১৯ কোটি টাকার মতো। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে একই সময়ের মধ্যে কন্ট্রাক্ট পেয়েছে ২৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার উর্ধে অথচ ভারতে পরিমাণ থেকে বেশি হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ এলসি খোলার সুযোগ পেয়েছে মাত্র প্রায় ১২ কোটি টাকার মতো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এ ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে? রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে যেখানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত সেখানে চুক্তির অধীনে ২৫ কোটি টাকার মাল রপ্তানি করার সুযোগ পেয়েও আমরা কেন তার সদ্ব্যবহার করতে পারলাম না?
বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য দারুন সংকটাপন্ন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে এমনিতেই দেশের রপ্তানি বাণিজ্য মোটেই নয় সেখানে সুযোগ পেয়েও যদি তার সদ্ব্যবহার না হয় তাহলে তা নিতান্তই দুর্ভাগ্য। উল্লেখিত সংবাদ ও তার তথ্য অনুযায়ী যে বিষয়টি পাঠক সাধারণের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল তা আজ ভঙ্গ হতে চলেছে। চাহিদা সত্বেও ভারতকে আমরা মাল রপ্তানি করতে পারিনি এলসি খোলার ব্যাপারে একটা সুস্পষ্ট নীতির অভাবে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় ও সেইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক এই এলসি খোলার অনুমতি যথাসময়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে সরকারের বহি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও চুক্তি কেন বাস্তবায়িত হয়নি সে ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা আজ আমাদের আর্থিক মেরুদন্ড মজবুত করার জন্য অন্যতম লক্ষ্য। দেশের উন্নয়ন নির্ভর করছে রপ্তানি বাণিজ্যে উন্নয়নের উপর। দেশের রপ্তানিযোগ্য জিনিসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা আজ একটি জাতীয় কর্তব্য সরকার এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে বলে আমরা মনে করি। দেশের উন্নতির জন্য সরকার সর্বদা নিয়োজিত প্রাণ বলে আমরা বিশ্বাস পোষণ করি তা সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য কেন এভাবে ব্যর্থ হলো সেটা জনমনে প্রশ্ন আমরা উদ্বিগ্ন এধরনের ব্যর্থতায় আর সে কারণে আমরা সরকারকে আসুন চুক্তি পূরণের জন্য অনুরোধ করি। দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করে গড়ে তোলার এই প্রাথমিক পর্যায়ের সংগ্রামকে সার্থক করার প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশি। যে কোনভাবেই হোক না কেন পূরণ শর্ত করতেই হবে। আমরা আশা করি সরকার বিষয়টি পূর্বাপর বিবেচনা করবেন।

যক্ষ্মা থেকে রক্ষার লড়াই

‘যার হয় যক্ষ্মা তার নেই রক্ষা’ গ্রামবাংলার সরলমতি সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে এই রকম একটি ধারণা এখনো বৃদ্ধ মূল রয়েছে। যক্ষ্মা এটি অতিশয় মারাত্মক ক্ষয়রোগ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে আজকাল যক্ষ্মা রোগের নিরাময় সাধন করা তেমন কোনো দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে এই রাজ রোগ থেকে অনায়াসে আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন যক্ষ্মা শুধু দেহের ব্যাধি নয় তেমনি একটি মানসিক ব্যাধি ও বটে সেজন্যই কেউ যদি চোখ আক্রান্ত হন তাহলে তাকে মনের দিক থেকে হতাশায় নিমজ্জিত না হয় বিধেয়। সেবা-শুশ্রূষা যথাপোযুক্ত চিকিৎসার ফলে এই করাল ব্যাধির কবল থেকে রোগে আক্রান্তদের রক্ষা পাওয়ার খবরটি দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে উঠিয়ে দেয়া দরকার। নইলে এই রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষের সনাতন চিন্তাধারার পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০ লক্ষ লোক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর আক্রান্ত হয়ে এক লক্ষ লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এবং আরো ১ লক্ষ লোককে নতুন করে এই সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত করছে। বাংলাদেশের ৪০ লক্ষ যক্ষ্মা রোগীকে নিরাময় করার জন্য হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা রয়েছে মাত্র ন্য় শত ছেচল্লিশটি। প্রয়োজনের তুলনায় যক্ষ্মা রোগীদের শয্যা সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। এই অপ্রতুল শয্যা সংখ্যা দিয়ে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে যত দুর্বার অভিযান পরিচালনা করা হোক না কেন নিকেতনের শয্যা সংখ্যা না বানানো পর্যন্ত যক্ষ্মা নিবারণী অভিযান সার্থকতা সমৃদ্ধ হবে না। প্রতিবছরের মতো এবারও যক্ষ্মা নিরোধ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে যক্ষ্মার নিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভয়াবহ পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু এই অভিশাপ থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্য সরকারের সঙ্গে প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও মনে করি দেশের জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর আহবানে প্রতিটি নাগরিককে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করা দরকার। গত পরশু যক্ষ্মা নিরোধক অর্থ সংগ্রহ অভিযান সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান সমিতির অর্থ সংগ্রহ অভিযানে সহযোগিতার জন্য দেশের সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহবান এর প্রতি সাধারণ ও বিত্তশালী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক বলে আমরা মনে করি। যক্ষ্মা সমতির সভাপতি ডক্টর নুরুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন যে, রোগ হিসেবে যক্ষ্মাই দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। বসন্ত এবং কলেরা সম্পর্কে জনগণ সচেতন বলে এ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে কিন্তু যক্ষ্মা রোগ সম্পর্কে জনসাধারণ সচেতন নন বলেই এই রোগটি মানুষের মনের অগোচরে বিস্তৃতি লাভ করে চলেছে।
আমরা জানি, প্রতিটি উন্নয়নকামী এবং অনুন্নত দেশে যক্ষ্মা একটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিরাজমান। বাংলাদেশের অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য যক্ষ্মার প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা সম্প্রসারণ করা দরকার। দেশকে যক্ষ্মামুক্ত করা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে এখন আর দুঃসাধ্য কর্ম নয়। যক্ষ্মা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাই আজ সম্মিলিত অভিযান করা জরুরি হয়ে পড়েছে প্রতিবছর যক্ষ্মা উচ্ছেদের জন্য সপ্তাহ পালন করলেই যক্ষ্মা নির্মূল হবে না। যক্ষ্মাক্রান্তদের উপযুক্ত চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা একান্ত বাঞ্ছিত এবং জনসাধারণের মন থেকে যক্ষ্মা সম্পর্কিত ভীতি নিরসনের প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আশা করি কাল ব্যাধি যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াই ক্রমাগত জোরদার হবে এবং সার্বিক সহযোগিতার মন্দির উদয় বলে যক্ষ্মার গ্রাস থেকে এদেশের মানুষ মুক্তির আলোক স্পর্শে ধন্য হবে।

সকলকেই ভাবতে হবে

ঢাকা ওয়াসা ও ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন তাদের আট দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য বিলম্বিত প্রতীক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত রবিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন প্রতীক ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে শহরের সমস্ত এলাকায় পয়ঃপ্রণালিসহ অফিসের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন।
নগরীতে দুঃসহ জল কষ্টের মুখে কর্মচারী ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্ত জন জীবনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পথে বহুবিধ সমস্যার মধ্যে পানি সরবরাহ সমস্যার অন্যতম। তাছাড়া ঢাকা নগরীতে পানি সরবরাহের সমস্যাটির দীর্ঘদিন যাবত একটি প্রকট সমস্যা রূপে বিরাজ করছে। সকলের অভিযোগ প্রার্থিত পানির সরবরাহ ব্যাপারে দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। জনসাধারণ পানির জন্য দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এবং এই গ্রীস্মের মৌসুমে দুর্ভোগ আরো দুঃসহ হয়েছে। প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকায় পানি সরবরাহ বন্ধ থাকার অভিযোগ আসে। অর্থাৎ স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, প্রয়োজনের তুলনায় সকল এলাকায় পানি সরবরাহ করা স্বাভাবিক অবস্থায় সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এমন অবস্থায় ওয়াসার কর্মচারীরা প্রকৃত প্রতীক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ধর্মঘট প্রতিবাদের এক বিশেষ প্রকাশ। সেই প্রসঙ্গে বলা যায়, তাদের অভাবঅভিযোগও রয়েছে এবং সেগুলি মৌলিক দাবিও বটে। যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি, চিকিৎসাভাতা, বেতন স্কেল ও স্থায়ী বাসস্থান এর দাবিগুলো সহ অন্যান্য দাবিগুলো যুক্তিযুক্ত, সে কথা অনিস্বীকার্য। তবে দাবি পূরণের একমাত্র পন্থা যে ধর্মঘট করা, একথাও ঠিক নয়। ওয়াসা কর্মচারী ইউনিয়ন আরো বলেছেন যে, তাদের দাবি দাওয়ার প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার জন্যই তারা এই প্রতীক ধর্মঘট পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ফল না হলে তারা পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট করতে বাধ্য হবে।
ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা পূর্বে ওয়াসা কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া গুলো কে বা কারা কোথায় এবং কখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেছে তা আমরা জানি না। তবে হঠাৎ করে ধর্মঘট করলে জনজীবনে আকস্মিকভাবে নানা দুর্বিপাক নেমে আসবে এবং জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। সৃষ্টি হবে এক মানসিক সমস্যা। আজকের প্রপীড়িত জনজীবন এতে অধিকতর বিড়ম্বিত হয়ে পড়বে।
অতএব পরিস্থিতিকে সহজ করে আনার জন্য আমরা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সহ সংশ্লিষ্ট মহলকে অনুরোধ জানাচ্ছি। দাবি-দাওয়া যা আছে তা পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই মিটিয়ে ফেলতে হবে, কোন চরমপন্থা গ্রহণ করে নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন