You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.02 | পাকিস্তানী সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস এর রিপোর্ট - সংগ্রামের নোটবুক

২ মে ১৯৭১ পাকিস্তানী সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাস এর রিপোর্ট

১৬ জুন সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশ গণহত্যার উপর প্রতিবেদন প্রকাশের আগে মাসকারেনহাস পাকিস্তানের পক্ষে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। তার ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হইল।
বাঙালি নিধন হয় নাই বরঞ্চ অবাঙ্গালী নিধন হয়েছে এই সত্য প্রমাণ করিবার উদ্দেশ্যে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আটজন–বিদেশি সংবাদদাতাকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানাইলেন। এই সাংবাদিকদের মধ্যে করাচি হইতে প্রকাশিত ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক অ্যান্টনি মাসকারেনহাসও ছিলেন। ইনি ঐসময় একই সঙ্গে বিলেতের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার সংবাদদাতা হিসাবেও কাজ করিতেন।তাদের সাথে বাছাই করা শিখাইয়া পড়াইয়া লওয়া কিছু অবাঙ্গালি পরিবারের সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করা হইল।
‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার ২রা মে ১৯৭১ সংখ্যায় মাসকারেনহাসের লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হইলে পাকিস্তান সরকার বিদেশে তাহার বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করে। এই প্রতিবেদনে সামরিক কর্তৃপক্ষ যাহা যাহা চাহিয়াছিলেন তাহাই–অর্থাৎ বাঙ্গালি জনতার হাতে অবাঙ্গালি হত্যার কথা–ফলাও করিয়া লেখা হইয়াছিল। প্রমাণ–বাছাই করা কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত অবাঙ্গালি পরিবারের সাক্ষ্য–প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান। ঐ প্রতিবেদনে মাসকারেনহাস যাহা লিখিয়াছিলেন অন্যান্য সংবাদদাতারাও–যেমন ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এস.আর. গুরি কিংবা ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা বেগ তাহাই লিখিয়াছিলেন। কিন্তু সামরিক সরকারের তরফে অ্যান্টনি মাসকারেনহাসের লেখা প্রতিবেদনটাই বেশি বেশি করিয়া বিতরণ করা হইয়াছিল। তাঁহারা হয়তো ভাবিয়াছিলেন মাসকারেনহাসের খ্রিস্টান নামটার মাহাত্ম্যে লোকে ধরিয়া লইবে লোকটা ব্রিটিশ। সুতরাং তাঁহার সাক্ষ্যটা একটু বেশি পরিমাণে বস্তুনিষ্ঠ অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য হইবে।
রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত এবং পর্তুগিজ শাসনাধীন গোয়া হইতে উদ্ভূত এন্থনি মাসকারেনহাস পাকিস্তানী নাগরিক। তিনি করাচিতেই বড় হইয়াছিলেন। লেখাপড়াও সেখানেই। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে এবং তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে ঢুকিয়াছিলেন এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ নাগাদ। অভ্যাগত আর সাংবাদিকের সহিত তাঁহাকেও কুমিল্লায় লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। এই এলাকায় গোটা দশদিন কাটাইয়া তিনি করাচি ফিরিয়া গেলেন আর সিদ্ধান্ত নিলেন যাহা দেখিয়াছেন তাহাই প্রচার করিবেন। ২রা মে তারিখে তিনি সেনাবাহিনীর অনুমোদন সাপেক্ষে যাহা লিখিয়াছিলেন সে কথাগুলি কতখানি বিশ্বাসযোগ্য–সেই প্রশ্নও তুলিতেই হয়। ঐ প্রতিবেদনে তিনি লিখিয়াছিলেন, সশস্ত্র বাঙ্গালি জনতার হাতে ২০,০০০-১০০,০০০ অবাঙ্গালি নিহত হইয়াছিলেন। ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় খবরটা পড়িয়া সেকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হইতে প্রকাশিত ‘পাকিস্তান ফোরাম’ নামক সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক ড. ফিরোজ আহমেদ একপাতা প্রতিবাদ ‘টাইমস’ বরাবর পাঠাইয়াছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, আপনাদের সংবাদদাতা এই অবিশ্বাস্য তথ্যটা জানিলেন কি উপায়ে? চিঠিটা ছাপাইতে সাহসই করেন নাই সানডে টাইমস।
ফিরোজ আহমেদ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই সত্যটা এতদিন প্রকাশ করেন নাই কেন? এই প্রশ্নের আগাম উত্তর অ্যান্টনি মাসকারেনহাস নিবেদিত ২রা মের প্রতিবেদনে এইভাবে ছিল: ‘এতগুলি অবাঙ্গালি হত্যার খবর পাইয়া সেনাবাহিনী এতখানি বিস্ময়বিহ্বল হইয়াছিলেন যে তাহারা খবরটা প্রকাশের কথা ভুলিয়া গিয়াছিলেন।’ ফিরোজ আহমেদ কথাটা হাসিয়া উড়াইয়া দেন নাই, শুদ্ধ যোগ করিয়াছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও সীমালঙ্ঘনের সীমাহীনতার কারণে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালি শরণার্থী আর শত শত বিদেশির বহির্গমনের স্রোত তৈরি হইয়াছে। তাঁহাদের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের ভুরি ভুরি প্রমাণ ক্যামেরায় আর ফিলমে বন্দী আছে। এহেন দয়াপরবশ আর বিনয়ভূষণ আখ্যা আর যাহাকেই মানাক তাঁহাদের মানায় না।
বাঙ্গালির হাতে অবাঙ্গালি হত্যার কিছু প্রমাণ অন্তত বিদেশি সাংবাদিকরা–বাস্তবে থাকিলে–নিশ্চয়ই দেখিতে পাইতেন। এই সংবাদদাতাদের মধ্যে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার ম্যালকম ব্রাউন। ৯ মে ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখিয়াছিলেন, তাঁহারা মোটের উপর পাঁচদিন পূর্ব পাকিস্তানে থাকার অনুমতি পাইয়াছিলেন। তখন সামরিক বাহিনীর গাইড সারাক্ষণ তাঁহাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেন। শুদ্ধ শেষের দিন তাঁহাদিগকে এক ঘণ্টার জন্য সাধারণ জনগণের সহিত কথা বলার এজাজত দেওয়া হইয়াছিল।
অবাঙ্গালি নিধনের কোন চিহ্নই তাঁহারা দেখিতে পান নাই। আর সেনাবাহিনী যাহা লুকানোর চেষ্টায় যত্নের কোন ত্রুটিই করেন নাই তাহা তাঁহারা ঢের দেখিয়া ফেলিয়াছিলেন। হয়তো সেই জন্যই তাঁহারা স্ব স্ব প্রতিবেদন লিখিবার আগে ব্যাংকক কিংবা হংকং চলিয়া আসিয়াছিলেন। অ্যান্টনি মাসকারেনহাসও নিজের পুরানা বক্তব্যটা পরে খানিক প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছিলেন।