You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৮ই জুন, বৃহস্পতিবার, ২৪ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০

আজ রক্তঝরা সেই সাতই জুন

আজ ৭ ই জুন।স্বাধীনতার আন্দোলনের রক্ত স্মৃতি বিজড়িত এই দিন সাত বৎসর আগে মুক্তিপাগল মানুষ শাসনযন্ত্রের সকল ভয় ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে পথে বেরিয়ে এসেছিল। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকাসহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র পালিত হয়েছিল হরতাল। নিরীহ-নিরস্ত্র শোভাযাত্রাকারীদের উপর সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সরকারি-বেসরকারি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বেতনভুক পুলিশ আর ভাড়াটিয়া গুন্ডার দল। সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল সর্বত্র। একমাত্র ঢাকাতেই পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল ১০ জনেরও বেশি সংগ্রামী সাথী।
সাতই জুন আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছিল নবতর সংগ্রামের। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের যে বীজকে বপন করা হয়েছিল, ছেষট্টির সাতই জুন তাতে সঞ্চার করা হয়েছিল তীব্র গতিবেগ। ছেষট্টি থেকে একাত্তর সেই সংগ্রামেরই নানা পর্যায়ে, নানা স্তর। স্তরানুক্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রোথিত স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছি। বাধা এসেছে, সময় অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে তা কঠোরতর হয়েছে। প্রতিরোধের ভাষা বদলেছে। বিক্ষোভ- হরতাল-শোভাযাত্রা সে থেকে ছোটখাটো পাল্টা আঘাত আবার দুনিয়ার সামনে অভূতপূর্ব গণরায় প্রদান এবং সর্বশেষে সশস্ত্র জনযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অত্যান্ত বলিষ্ঠতার সঙ্গে বাংলার মানুষ বিজ্ঞজনোচিতভাবে বিন্যাস করা সংগ্রামের নানা স্তর অতিক্রম করেছে এবং অর্জন করেছে স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই দ্বিতীয়বারের মতো ঐতিহাসিক সেদিন এসেছে মুক্ত স্বদেশে। সেদিনের সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কিন্তু তাই বলে সংগ্রামের গতি স্তব্ধ হয়নি। মুক্ত সদস্যের লক্ষ ঘোষিত হয়েছে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের। ছেষট্টির ৭ ই জুন যে মেহনতী মানুষের প্রথমবারের মতো আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সার্বিকভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন সে মেহনতী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আজ আমরা কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন। সেদিন যেমন প্রতিক্রিয়াশীলদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের দেশের একশ্রেণীর হঠকারী বামপন্থী সমস্ত আন্দোলনটাকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, আজও সংগ্রামের চরমতম পর্যায় তারা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবিপ্লবের পাঁয়তারা কষছেন। কারো কারো উপলব্ধি ঘটেছে। কিন্তু যারা ‘বুঝে পাগল’ তাদের আর বোঝাবে কে? ইচ্ছা করে যারা আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে চলেন তাদের আলোর সন্ধান দিয়ে লাভ নেই।
৭ই জুন আমাদের শিখিয়েছে লক্ষ্যে স্থির থেকে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তবে বিজয় সম্ভব। ছেষট্টিতে যাদের কাছে ছয় দফা কর্মসূচি অত্যন্ত আগে দেওয়া হয়ে গেছে অথবা এর আবরণে যে লক্ষ্যের কথা অলিখিত রয়ে গেছে তা ‘অর্জন সম্ভব’ বলে মনে হয়েছে, স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। যে অসমসাহসী তরুণদের দল সকল বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন ছয় দফা আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন অথবা যে শ্রমজীবী মানুষ রক্ত দিয়ে সে সংগ্রামের যোগান রচনা করে গেছেন তাদের সে পরিশ্রম,সে ত্যাগ বৃথা যায়নি। সে সংগ্রামের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সমগ্র জাতি। ত্রুটিহীন নেতৃত্ব আর সময়োচিত সিদ্ধান্ত একটা জাতিকে তার সংগ্রামী লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করেছে।
আজ জাতির ক্রান্তিলগ্নে সকল হঠকারিতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আবার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে শরিক হবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হচ্ছে। স্তরানুক্রমিকভাবে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে অগ্রসর হতে চাই। সাতই জুন অতীত সকল আন্দোলনের মূল শিক্ষাও আমাদের তাই। কোন প্রকার হঠকারিতা যাতে আমাদের পথ চলায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারে কোন ষড়যন্ত্র যাতে সেদিনের সেই শহীদদের আত্মাকে অপমানিত করতে না পারে সেদিকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সাতই জুনের সেই শহীদরা স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। সে চাওয়ার পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও সে উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে এখনো সফল হয়নি। শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক মুক্তি এখনো আসেনি।

মধ্যস্বত্ব প্রথার বিলুপ্তি

সরকার ইজারাদারী বা মধ্যস্বত্ব প্রথাকে আর কিছুতে চালু হতে দেবেন না। সমাজতন্ত্র কায়েম এর প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য এগুলো কে চিরতরে বিলোপ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ সরকার হাট ও বাজার (ব্যবস্থাপনা) (সংশোধনী) বিল ১৯৭৩ এর উপর আলোচনাকালে সংসদের অভিযোগের জবাবে ভূমি সংস্কার মন্ত্রী জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত একথা বলেন।
সংসদে বিলটি গৃহীত হয়েছে। বিলে এসম্পর্কিত রাস্ট্রপতির ১৯৭২ সালের আদেশ সংশোধন করে এর আওতা থেকে যেকোন হাট-বাজারকে রেহাই দেবার অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়েছে।
সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত রাজশাহি সারদাহ বাজারের উল্লেখ্য করে বলেন, এই বাজারটি সারদাহ পুলিশ একাডেমি এলাকায় অবস্থিত এবং ট্রেনিং রত পুলিশদের সুবিধা ও কল্যাণের স্বার্থে বাজারটি স্থাপিত। বাংলাদেশ সরকার হাট বাজার (ব্যবস্থাপনা) আদেশ ১৯৭২ এর ফলে সে উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে জাতীয় অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এই অবস্থা মোকাবিলার জন্য এই সংশোধনের প্রয়োজন।
একথা আজ আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে হাট বাজার নিয়ে একদল মধ্যস্বত্বভোগী মানুষ খেয়ালখুশি মাফিক তথাকথিত ব্যবসার নামে দুর্নীতি, অবিচার ও অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছেন। গ্রামের নিরীহ জনসাধারণ কোন সময়ই নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিন্তে তাদের মালামাল নিয়ে হাটে বাজারে এসে কেনাবেচা করতে পারেনি। ইজারাদাররা তখন ছিলেন ১১ জন নিজস্ব এলাকার সম্রাট। নির্দিষ্ট একটা অংক বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকার থেকে হাট-বাজার ইজারা নিয়ে তারা লাভের অংক বৃদ্ধি করেছে চক্রবৃদ্ধি হারে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর নিরীহ পণ্য বিক্রেতাদের মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য সরকারি ইজারাদারি বা মধ্যস্বত্ব প্রথা বিলোপের সিদ্ধান্ত নেন। এবং সরকারের এ সিদ্ধান্ত অভিনন্দিত হয় সব মহলে।
প্রথমতঃ উল্লেখ্য যে, ইজারাদারি বা মধ্যস্বত্ব বিলোপের পর সরকার হাটবাজার গুলোর খাজনা আদায় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করেন স্থানীয় হাট কমিটিগুলোর উপর।
সংশোধনী বিলটি সম্পর্কে আলোচনা কালে সংসদ সদস্যের মধ্যে অনেকে হাট কমিটিগুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। কেউ কেউ হাট বাজার ব্যবস্থাপনা রাজস্ব সার্কেল অফিসার তহসিলদারদের কার্যকলাপের সমালোচনা করেন।
সংসদ সদস্যদের যারা হাট কমিটিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তাদের অভিযোগের স্বপক্ষে বিপক্ষে কোন মন্তব্য না করে আমরা অনায়াসে বলতে পারি যে, বৃহত্তর জনসাধারনের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের দুর্নীতি বা অন্যায় কার্যকলাপের ফলে তা বাতিল হয়ে যেতে পারে না। সেজন্য একটি মহৎ ও কল্যাণকর ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না। যা করা যায় তা হল সে দুর্নীতির ধারক-বাহকদের সমাজবিরোধী কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গ্রামবাংলায় চালু প্রবাদ রয়েছে, চোরের সঙ্গে গোস্বা করে কলাপাতায় কেউ ভাত খায় না। একথা বাস্তব সত্য যে, ইজারাদারি প্রথার অবসান এ জনসাধারণ আজ খুশি হয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!