You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৪ঠা জুন, রবিবার, ২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০

একনায়কত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন

সংবাদে প্রকাশ, ভুট্টো-টিক্কা খানের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে সারাদেশে অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করার জন্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ইউনিটগুলোর প্রতি গোপন নির্দেশ জারি করেছেন।
সম্প্রতি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা দেশপ্রেমিকদের যে বৈঠক হয় তাতে বাংলাদেশের আন্দোলনের ধরনে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘মুক্তিবাহিনীর’ কৌশল অবলম্বন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে প্রদেশে দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নৃশংস সামরিক তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে যা আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো তথাকথিত ইসলামী সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্রের নামে ভুট্টো সাহেবের স্বৈরাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছেন তা কোন অবস্থাতেই সেখানকার জনসাধারণ মেনে নেবে না। নিতে পারে না। বিশেষত বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ভুট্টো সাহেব সেখানকার শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত জনসাধারণের স্বাধীকারের দাবিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছেন। ঠিক যেমনটি একাত্তর সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল।
পাকিস্তানি শাসকচক্র কোনদিনই জনমতের তোয়াক্কা করেনি। আজও করছে না। শুধু তাই নয় শোষিত ও নির্যাতিত বেলুচিস্তান ইরানের কাছে হস্তান্তর করার ষড়যন্ত্রও চালিয়ে যাচ্ছে ভুট্টো-টিক্কা চক্র। ন্যাপ প্রধান ওয়ালি খান বেলুচিস্তান কে ইরানের কাছে হস্তান্তরের প্রসঙ্গে বলেছেন, সম্প্রতি সেখানে যে সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে তাহলো এই হস্তান্তরের প্রথম পদক্ষেপ।
গত সপ্তাহে পাঁচ দিনের জন্য খুদাই-খিদমতগার নেতা খান আবদুল গফফর খান বাস্তব সমস্যাবলী পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, “আমাদের লোকজন হচ্ছে ক্ষুধার্ত ও নিঃস্ব। বহুদিন থেকে তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং একমাত্র তারাই যৌথ চেষ্টা ও আত্মত্যাগের তারা দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন।”
বেলুচিস্তান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনসাধারণ বাঁচতে চায়। শাসন, শোষণ, অত্যাচার অবিচার এর হাত থেকে পরিত্রান করা সুখী সমাজ গড়তে চায়-তাদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য যে জঘন্য ষড়যন্ত্র চক্রান্ত ভুট্টো-টিক্কা চালিয়ে যাচ্ছে তা কোনদিনই বাস্তবায়িত হবে না। হতে পারে না। অন্তত ইতিহাস তা বলে না। বেলুচ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অগণিত জনসাধারণের স্বাধিকারের দাবিকে যদি পদদলিত করা হয় তাহলে কোন একদিন দেখা যাবে বাংলাদেশের মতো সেখানে স্বাধীনতার পতাকা উড়ছে আজকের বাস্তব ঘটনা বলি সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

লবণ শিল্পের সঙ্কট

বাংলাদেশের লবণ শিল্পের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অবশ্য দেশের আর দশটা শিল্পের চেয়ে লবণ শিল্পের সংকটের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্নতর। আমরা যখন বিভিন্ন শিল্পের “উৎপাদন বাড়াও-উৎপাদন বাড়াও” বলে চিৎকার করতে করতে গলায় রক্ত তুলছি, ঠিক তখনই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লবণ উৎপাদনের সংবাদ শুনে আনন্দিত না হয়ে পারি না। লবণ শিল্পের সঙ্কটটা তাই স্বাভাবিক কারণেই আমাদের কাছে সুসংবাদের বার্তাবাহী বলে বিবেচিত হওয়ার দাবী রাখে। বাংলাদেশে বছরে লবণের চাহিদা রয়েছে এক কোটি ষাট লাখ মণ। কিন্তু বর্তমান বছরে এক কোটি একানব্বই লাখ মণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। গতবছর লবণ উৎপাদিত হয়েছিল দুই কোটি তেরো লাখ মণ। হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান বছরে একত্রিশ লাখ এবং গত বছরে ষাট লাখ মণ লবণ উদ্বৃত্ত হয়েছে। লবণ উৎপাদনের জন্য এটা যেমন আশার সংবাদ তেমনি বাংলাদেশের শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রেও এটি একটি চমকপ্রদ এবং উৎসাহব্যঞ্জক উদ্যম। কিন্তু লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে উদৃত উৎপাদকদের আশার আলোয় আলোকিত না করে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে। উদ্বৃত্ত লবণ চট্টগ্রাম, কুতুবদিয়া, মহেশখালী উৎপাদকদের জন্য শাপে বর হয়েছে। বাজারে দেখা দিয়েছে চরম মন্দাভাব। চট্টগ্রামে নাকি অপরিশোধিত লবণ মাত্র দু টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রামে উপকূলীয় অঞ্চলের ছাব্বিশ হাজার পাঁচশ একর জমির লবণ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে এবং পয়ত্রিশ হাজার বয়স্ক আর দশ হাজার কিশোর লবণ উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। প্রায় আড়াই লাখ মত লবন উৎপাদনকারীদের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
এখন দেখা যাচ্ছে, উৎপাদিত লবণ দিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণের পরেও যে উদ্বত্ত লবণ থেকে যাচ্ছে, সে কারণে লবণ উৎপাদনকারীরা উৎপাদনের কাজে আর উৎসাহ পাচ্ছে না। বাজারে মন্দাভাব লবণ উৎপাদনকারীদের আজ পথে বসিয়েছে। এটি একটি উদ্বিগ্নতার দারুণ বৈকি? কিন্তু প্রশ্ন অতিরিক্ত লবণ কি বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা যায় না? রপ্তানি বাণিজ্য বিভাগ এ ব্যাপারে কি উদাসীন এর অর্গলমুক্ত করতে পারেন না? যতদূর জানা গেছে, বিদেশে বাংলাদেশের লবণের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ভারত সরকার আসাম প্রদেশের কস্টিক ক্লোরিন কারখানার জন্য এবং আরো কতিপয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের লবণ কিনতে আগ্রহী। মধ্যপ্রাচ্য লবণের ভালো বাজার পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের লবণ বিদেশে রপ্তানির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা সরকারের উচিত বলে আমরা মনে করি। লবণ রপ্তানির ফলে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব এবং এতে বাংলাদেশের লবণ শিল্পের বিকাশ ছাড়া বিনাশ হবে না বলেই আমাদের বদ্ধমূল ধারণা। অতিরিক্ত লবণ বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা হলে লবণ উৎপাদনকারীরা উৎসাহী পাবে এবং বাজারের মন্দাভাব কেটে যাবে। বাংলাদেশের লবণ শিল্পের এই সংকট মোচনের জন্য সরকারকে এগিয়ে গিয়ে এ শিল্পের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। উৎপাদনকারীরা যাতে উৎসাহী হয়ে এ শিল্পের মৃত্যুর না ঘটায় সেজন্য অবশ্যই লবণ বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া একান্ত বাঞ্ছিত। উৎপাদনের ক্ষেত্রে লবণ যেখানে উদ্বৃত্ত হচ্ছে, সেখানে অতিরিক্ত লবণ বিদেশে রপ্তানী করার নীতি কে আমরা কিছুতেই স্বাগতম জানাতে পারি না। বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদন হ্রাস বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকেই ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা সবাই শিল্পের উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলছি। কিন্তু লবণ উৎপাদনকারীরা এক্ষেত্রে বলা চলে একটি রেকর্ডই সৃষ্টি করেছেন। আমরা আশা করি, লবণ উৎপাদনকারীরা যেন হতোদ্যম না হন, যেন তাদের সংকট দূরীভূত করার জন্য সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিদেশে লবণ রপ্তানির ব্যবস্থা করে উৎপাদনকারীরা শুধু উপকৃত হবেন না, সরকারও লাভবান হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সমাজ বিরোধী তৎপরতা বন্ধ করতেই হবে

হংকং পৃথিবীর বিখ্যাত চোরাকারবারি কেন্দ্র গুলোর অন্যতম। চোরাচালানীরা ঢাকাকে দ্বিতীয় হংকং বানাতে চাচ্ছে। জনি ওয়াকার, পারনভ ওয়াউন, গরডনস জিন, ফাইভ ফিফটি ফাইভ, রথম্যান্স থেকে শুরু করে বেতার, টিভি, ফ্রিজ টেপরেকর্ডার, অশ্লীল ছবি (ব্লু-ফ্লিম) ইত্যাদি চোরাকারবারীদের হাত ধরে গোপন পথে বাংলাদেশে আসছে। এম এন কাদের নামে এক ব্যক্তি বিদেশি কূটনীতিবিদদের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রচুর পরিমাণে মাদকদ্রব্য, সিগারেট এমনকি টিভি, ট্রানজিস্টার, ওয়ারলেস সেট, সুইমিং চেয়ার ইত্যাদি বিদেশ থেকে আমদানি করছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। বলা বাহুল্য এম এন কাদের নাকি এখন পলাতক। সুতরাং ইতিপূর্বে তার নামে বিদেশ থেকে ছাড়িয়ে কোটি টাকার আমদানি করা জিনিস বিমানবন্দর শুল্ক বিভাগ আটক করতে সক্ষম হয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়। যারা বিদেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছেন তারাও জুতোর তলিতে, ব্লাউজের ভেতর, ঘড়ির মধ্যে, তলপেটের নীচে থাকি বিভিন্ন জায়গায় বিদেশী বিদেশী মুদ্রা লুকিয়ে বিদেশে পাচার করছেন বলেও বিমান বন্দরে শুল্ক বিভাগ জানিয়েছেন।
এসব চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে তৎপর হওয়াতে বিমানবন্দর শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলেও বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ।
গতকালকের পত্রিকাতেই আরও খবর একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত পিস্তল উঁচিয়ে বি আর টি সি পিকআপ ভ্যান থেকে ৫৪ হাজার ৭৯ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
গত পরশু রাতে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা থেকে একটি আজিমপুর থেকে আরেকটি গাড়ি হাইজ্যাক করেছে। সবকিছু একত্র করে দেখতে গেলে মনে হয় যেন জেমস বন্ডের কোন ছবি দৃশ্যই আমরা দেখছি।
সত্যি বলতে কি মাঝখানে এসব দুষ্কৃতিকারীদের কর্মতৎপরতা কিছুটা কমে ছিল। সে সময় অবশ্য রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চলছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অনাসৃষ্টি ব্যর্থ হওয়ার পর পর আবার লুটতরাজ, ছিনতাই এবং গুপ্তহত্যা ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে কোন গোপন চক্রের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা সক্রিয় রয়েছে। মনে হচ্ছে সরকারের সঙ্গে তাদের যেন চ্যালেঞ্জ। সরকার কোন বিষয়ে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারলে তাকে ঘায়েল করার জন্য দুস্কৃতিকারীরা আরেক পথ অবলম্বন করছে।
গুপ্ত হত্যা, লুণ্ঠন, ছিনতাই, চোরাকারবারি ইত্যাদি সবকিছুই আমাদের অনভিপ্রেত। সুতরাং যে কোনো মূল্যে এগুলোকে সমূলে দমন করতে হবে। নইলে আজ রাজধানীর বুকে যে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটছে তা ধীরে ধীরে আরও ব্যাপক আকারে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!