You dont have javascript enabled! Please enable it!

ছেচল্লিশের নির্বাচনে কংগ্রেসী বক্তৃতাবাজী

১৯৩৭ সালেও দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনকে উপলক্ষ করেই বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করে গিয়েছিল। সেসময় আমার বয়স মাত্র এক বছর। বড়াে হয়ে সে-সময়কার নির্বাচনের খবর বড়ােদের মুখে কিছু কিছু শুনেছি, বইয়েও পড়েছি। মনে হয়, ছেচল্লিশের নির্বাচনের মতাে এমন জোশ সাঁইত্রিশের নির্বাচনে গ্রাম বাংলায় দেখা যায়নি।
সাঁইত্রিশেও পৃথক নির্বাচন-ব্যবস্থার অধীনেই ভােটাভুটি হয়েছিল, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিরােধ তখনকার নির্বাচনেও প্রধান বিবেচনা হয়ে গিয়েছিল, তবু তখনাে মুসলমানের পৃথক রাষ্ট্রের কথা ওঠেনি, মুসলমানদের মধ্যে সলিম লীগের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়নি। কৃষক-প্রজা পার্টিই বরং তখন গ্রাম বাংলার মুসলমানদের স্বপ্নকে ধারণ করেছিল। বাঙালি মুসলমানের প্রাণপ্রিয় নেতা তখনাে হক সাহেব (এ, কে, ফজলুল হক) জমিদার-মহাজনের হাত থেকে বাংলার প্রজাকে তিনি মুক্তি দেবেন, কৃষকের দু’বেলা দু’মুঠো ডালভাত খাওয়ার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন, কৃষকের ছেলে যাতে বিনা বেতনে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষার সুযােগ পেতে পারে তা-ও দেখবেন এই হক সাহেব। তবে জমিদার-মহাজনদের অধিকাংশই যেহেতু হিন্দু, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-খাতক-প্রজা মুসলমান, তাই হক সাহেব মূলত মুসলমানেরই নেতা ছিলেন, কৃষক-প্রজা দলও মুসলমানেরই দল ছিল। তবু সঁইত্রিশে পাকিস্তানের দাবি উঠে আসেনি বলে, হিন্দু আর মুসলমানের রাজনীতি—পৃথক নির্বাচন সত্ত্বেও—একেবারে আলাদা হয়ে যায়নি। কিন্তু ছেচল্লিশে সব কিছুই অন্য রকম, সব কিছুই আলাদা। হিন্দুদের মধ্যে তখন কংগ্রেস দলের প্রভাব সব চেয়ে বেশি হলেও, আরাে অনেক দল-উপদল সে-প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল। কিন্তু মুসলমানের তখন একদল— মুসলিম লীগ। অন্য কোনাে দল উপদলের অস্তিত্ব অস্বীকার করা না গেলেও তাদের খুঁজে পেতে হলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ লাগাতে হয়।
ছেচল্লিশে আমাদের নির্বাচনী এলাকায় (তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমার সবগুলাে ও কিশােরগঞ্জের আটটি থানা নিয়ে গঠিত) কংগ্রেসের বর্ণহিন্দু প্রার্থী ছিলেন অমূল্য অধিকারী আর তফসিলি প্রার্থী প্রফুল্লচন্দ্র সরকার। অমূল্য অধিকারীর নির্বাচনী প্রতীক ছিল কলস আর প্রফুল্ল সরকারের নৌকা। কংগ্রেসের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কম্যুনিস্ট পার্টি। কম্যুনিস্ট পার্টির প্রার্থী মণি সিংহ, আর তার প্রতীক গােরুর গাড়ি। প্রতীক শব্দটি অবিশ্য তখন কারাে মুখে শুনিনি, কিংবা পােস্টার, লিফলেটেও দেখিনি। চালু ছিল মার্কা’ কথাটা। টিনের চোঙে মুখ লাগিয়ে একজন বলতাে—ভােট দিবেন কিসে? সঙ্গে সঙ্গে দশ-বারাে জন বা আরাে বেশি সংখ্যক বালক আকাশ-ফাটানাে চিৎকার দিয়ে উঠতাম—কলস মার্কা বাক্সে’ ‘নৌকা মার্কা বাক্সে। ব্যালট পেপারে প্রার্থীর প্রতীকের পাশে সিল মেরে ভােট দেয়ার নিয়ম তখনাে চালু হয়নি। ভােটকেন্দ্রে বিভিন্ন প্রার্থীর জন্যে আলাদা আলাদা বাক্স থাকতাে, আর সেই বাক্সের গায়ে প্রার্থীর প্রতীকটি সাঁটানাে থাকতাে। এটিকেই বলা হতাে মার্কা। হাঁস মার্কা নারকেল তেল বা রাণী মার্কা টিনের মতাে ভােটের বাক্সেরও নানা মার্কা। মার্কা মারা’ কথাটা তাে বাংলাভাষার একটি বহুল ব্যবহৃত ইডিয়ম। ইলেকশানে প্রার্থীর মাৰ্কাই প্রার্থীকে আড়াল করে দেয়। ভােটারদের অনেকেই প্রার্থীর নাম পর্যন্ত জানে না, মার্কাটাই তাদের একমাত্র বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। বরং
৩৮
অনেক ক্ষেত্রে ইলেকশানের পরেও মার্কাটা একটা স্থায়ী ‘প্রতীকী’ মর্যাদা পেয়ে যায়। (তখন। কিন্তু মার্কার বদলে ‘প্রতীক’ শব্দটিই ব্যবহার করতে হয়।)
নেতা ও পাতিনেতাদের মুখে কলস মার্কা ও নৌকা মার্কায় ভােট দেয়ার সপক্ষে বক্তৃতা শুনতে শুনতে সব আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সভায় বক্তৃতা শুনে এসে আমিও বাড়িতে কিংবা বাড়ির পাশে পুকুর পারের বেলগাছটির নিচে দাঁড়িয়ে অনর্গল বক্তৃতা দিয়ে যেতাম। শ্রোতা ছিল আমার ছােট ভাই মতীন্দ্র, এবং আমাদের পাড়ার ক্ষিতীশ, সৌভাগ্য, নীরু, অমূল্য, সুধীর—এসব বালকের দল। সবচেয়ে বেশি উৎসাহী শ্রোতা ছিলেন আমার বাবা। আসলে, বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমাকে উস্কে দিতেন আমার বাবাই। কোনাে সভায় বক্তৃতা শুনে এলেই বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, অমুক বক্তা সভায় কী বললেন?’, আমি বক্তার কথাগুলাের পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করলেই তিনি বলতেন, না, এভাবে নয়। যেভাবে বক্তৃতা দেয়া হয় ঠিক সেভাবে বলতে হবে।’
বাবা তখন আমাকে টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতেন। আমি মহানন্দে বীর বিক্রমে হেঁড়ে গলায় বক্তৃতা করতে থাকতাম। বাবার তখন কী খুশি! সে-খুশিতে যােগ দিতেন মা আর ঠাকুরমাও।
বাবা যে তাঁর এই দশ বছরের ছেলেটিকেই বক্তা বানাবার জন্যে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন, তার পেছনে বােধ হয় একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ ক্রিয়াশীল ছিল। বাবা ছিলেন মিতভাষী এবং সেই মিতভাষিতার কারণ নিহিত ছিল তার জিহ্বার জড়তার মধ্যে। অর্থাৎ তিনি ছিলেন কিছুটা তােতলা। পরিণত বয়সে সেই তােতলামি যদিও খুব বেশি ছিল না, তবু রাগান্বিত বা আবেগাক্রান্ত হলে তার কথা জড়িয়ে যেতাে। ঠাকুরমার মুখে শুনেছি, ছেলেবেলায় এই তােতলামির জন্যে সমবয়সীরা তাঁকে ক্ষেপাতাে ও নানা ভাবে হেনস্থা করতাে। ঠাকুরমা নাকি বাবার মুখে সীসার বল পুরে রাখতেন এবং ঠাকুরমার বিশ্বাস, এর ফলেই তাঁর তােতলামির মাত্রা কমে গিয়েছিল। যাই হােক, বাবা বােধ হয় ছেলেকে বক্তা বানিয়ে নিজে বক্তা-না-হতে পারার দুঃখটা ঘােচাতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই-পুত্রটির কলিংবেল-নিন্দিত কণ্ঠস্বর যদিও সকলের কর্ণপীড়া উৎপাদন করে, তবুও পিতার কানে বােধ হয় পুত্রের বক্তৃতা মধুবর্ষণ করতাে।
কিন্তু আমার বক্তৃতায় সে-সময়ই একবার একটু তাল কেটে গিয়েছিল। তাল কেটে দিয়েছিলেন শহর-থেকে-আসা এক তরুণ। | আমাদের গায়ের বিশ্বাস বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন বীরু বিশ্বাসের শ্যালক। ১৮/১৯ বছরের যুবক। খুবই সুদর্শন বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। চোখে চশমা। সম্ভবত আনন্দ মােহন কলেজের ছাত্র। এতাে বছর পরে তার নামটি আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
বিশ্বাস বাড়ির বৈঠকখানায় তাঁকে ঘিরে প্রায় রােজই ছােট খাটো মজলিস বসে যেতাে। বক্তৃতার ঢঙেই তিনি কথা বলতেন। তাঁর কথাগুলাে মনে হলাে অনেকটা অন্যরকম। গান্ধী সম্পর্কে তিনি নানা ধরনের বক্রোক্তি করতেন। আমার সে বয়সে সেসব বক্রোক্তির তাৎপর্য বােঝার কথা নয়। তবু এটুকু বুঝতাম যে, এই শহুরে তরুণটি গান্ধী-বিরােধী ও সুভাষের অনুরাগী। গান্ধী সম্পর্কে বুড়াে শয়তান’-এর মতাে বিশেষণও তিনি প্রযােগ করেছিলেন বলে মনে পড়ে। কংগ্রেসের কোন্ একটা সম্মেলনে সুভাষের প্রতি গান্ধী কী ধরনের অন্যায় আচরণ করেছিলেন—একদিনের মজলিসে সে-সব কথা বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন।
৩৯
আমার জ্ঞাতি ভাই হীরেন্দ্র দা তার কথার প্রতিবাদ করেছিলেন। সে-প্রতিবাদ বিতর্কে, এবং বিতর্ক প্রায় বিবাদে পরিণত হতে যাচ্ছিল। বীরু বিশ্বাসের ভাই জিতু বিশ্বাসের হস্তক্ষেপে সেই বিতর্ক ও বিবাদ খুব বেশি বাড়তে পারেনি।
বড়ােদের মজলিসের একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে একটি বালক যে সকলের উত্তেজিত কথাবার্তা হা করে শোনে—ওই বুদ্ধিদীপ্ত তরুণটি তা লক্ষ করেছিলেন। কৌতূহল বশেই একদিন এই বালকটিকে তিনি সস্নেহে তাঁর কাছে ডেকে নিয়েছিলেন।
আমার নাম কী, কোন্ ক্লাসে পড়ি, গাঁয়ের কোন বাড়িটি আমাদের—এসব খবর জেনে নিয়ে তিনি আমার রাজনৈতিক জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে শুরু করলেন। পরীক্ষায় বােধ হয় তিনি আমাকে পাসমার্ক পাওয়ার যােগ্য বিবেচনা করেছিলেন। তাই, এরপর তিনি সােৎসাহে আমাকে আরাে জ্ঞান দিতে প্রবৃত্ত হলেন। তবে জ্ঞানের চেয়ে বােধ হয় আমার মধ্যে আবেগ আর উত্তেজনাই সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন বেশি করে। নেতাজী সুভাষ বসুর নানা কীর্তির প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধী ও নেহেরুর প্রতি বিষ ঝরতে লাগলাে তার মুখ থেকে। তিনি খুবই আবেগের সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা বললেন, আর বললেন ফরােয়ার্ড ব্লকের কথা। ফরােয়ার্ড ব্লকই হচ্ছে নেতাজীর দল, আমাদের সকলেরই উচিত এই দলটিকে সমর্থন করা। কংগ্রেসফংগ্রেস দিয়ে কিছু হবে না। ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা আনবে ফরােয়ার্ড ব্লকই। নেতাজীতে শিগগিরই ভারতে আসবেন তার আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে। তারই নেতৃত্বে ভারত হবে স্বাধীন। স্বাধীন ভারতকে গড়ে তুলবে নেতাজীর ফরােয়ার্ড ব্লক।
কথাগুলাে শুনে খুবই খটকা লাগলাে। ফরােয়ার্ড ব্লক নামটা আমার কাছে একেবারেই নতুন। তা-ও আবার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তাহলে আমরা যে কংগ্রেসকে ভােট দেয়ার কথা বলে আসছি, তার কী হবে?
-না, না। ভােটের ব্যাপারে কোনাে হেরফের হবে না। ভােট তাে কংগ্রেসকেই দিতে হবে।…আর তা ছাড়া ফরােয়ার্ড ব্লক তাে এখনাে কংগ্রেসকে ছেড়ে যায়নি। আরাে কিছুদিন কংগ্রেসের ভেতরেই থাকতে হবে। তবে নেতাজী যখন দেশে চলে আসবেন, দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন ফরােয়ার্ড ব্লকই হবে একমাত্র পার্টি। তাই, এখন কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই আমাদের ফরােয়ার্ড ব্লককে গুছিয়ে নিতে হবে। খুব ধীরে ধীরে কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিলেন বীরু বিশ্বাসের তরুণ শ্যালকটি।
তাঁর কথাগুলাের কী অর্থ সেদিন আমার কাছে ধরা দিয়েছিল, কিংবা একবারেই অধরা থেকে গিয়েছিল কিনা, আজ আর তা সঠিক ভাবে বলতে পারবাে না। তবে, দু’তিন দিন ধরে তাঁর অন্তরঙ্গ আলাপ শুনতে শুনতে আমার ওপর যে তার আছর পড়ে গিয়েছিল, বাবা সেটা ধরে ফেলেছিলেন। সেদিনও আমি বালক শ্রোতাদের সামনে যথারীতি বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সে-বক্তৃতায় ছিল গান্ধী ও কংগ্রেসের নিন্দা, এবং নেতাজী ও ফরােয়ার্ড ব্লকের প্রশংসা। আবার কংগ্রেসের প্রার্থী অমূল্য অধিকারীকে কলস মার্কায় এবং প্রফুল্ল সরকারকে নৌকা মার্কায় ভােট দেবার জোরালাে আহ্বানও ছিল। নেতাজী তার আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে দেশে এসে পড়লে যে কংগ্রেস ফংগ্রেস কিছু থাকবে না, ফরােয়ার্ড ব্লকই হবে একমাত্র দল—সেসব কথাও বলতে বাকি রাখিনি।
বালক শ্রোতারা আমার বক্তৃতার অর্থ নিয়ে মাথা ঘামাতাে না। (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তারা ‘অর্থলােভী নয় বলেই হয়তাে।) আমার গতকালকের কথার সঙ্গে আজকের কথার কোনাে
৪০
অসামঞ্জস্য আছে কিনা সেসবও তাদের মাথায় ঢুকতাে না। (বালকরা তাে অসম্ভব ও অসামঞ্জস্যের জগতেই বাস করে। তারা শুধু দেখতে আমার হাত-পায়ের খিচুনি আর শুনতাে কণ্ঠের প্রচণ্ড গর্জন। মুহুর্মুহু করতালি আর স্লোগান দিয়ে আমার সভাকে তারা সরগরম করে রাখতাে।
কিন্তু আমার সেদিনের বক্তৃতার কথাগুলাে শুনে বাবা খুবই বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হলাে। গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলেন, কার কাছ থেকে আমি এসব কথা শিখেছি। আমার শিক্ষাগুরু সেই যুবকটির নাম বললে তিনি আমাকে তার সঙ্গ পরিহার করতে উপদেশ দিলেন। গান্ধীজী, নেতাজী কিংবা এরকম অন্য যে কোনাে নেতা সম্পর্কেই কোনাে রূপ নিন্দাবাদ করা যে অন্যায়, সে-কথা আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেন।
বাবার একদিনের উপদেশেই কাজ হলাে। আর কোনাে দিন আমি গান্ধী-বিরােধী ও সুভাষবাদী বক্তৃতা করিনি। গান্ধী-নেহরু-সুভাষ-আজাদ সকলের সমান গুণগান করেছি। ভুলেও ফরােয়ার্ড ব্লকের নাম উচ্চারণ করিনি। বীরু বিশ্বাসের শ্যালকও কয়েক দিনের মধ্যে শহরে ফিরে গিয়েছিলেন। আর কখনাে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
এর অনেক দিন পর স্বদেশী যুগের এক নেতার বক্তৃতা সম্পৰ্কীয় গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি শুনে হাসিও পেয়েছিল, আমার বালক বেলার স্ববিরােধী বক্তৃতার কথাও মনে পড়ে গিয়েছিল।
ময়মনসিংহের মতিলাল পুরকায়স্থ ছিলেন যুগান্তর পার্টির নেতা। ব্রিটিশের চোখে অনুশীলন ও যুগান্তর পার্টির লােকেরা ছিলেন সন্ত্রাসবাদী। এঁরা বন্দুক-পিস্তল দিয়ে ইংরেজ ও তাঁর সহযােগীদের মেরেই এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াবার ও দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখতেন। এঁদের বীরত্বের কাহিনী দিয়ে যদিও ব্রিটিশ-বিরােধী স্বাধীনতা-সগ্রামের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় রচিত হয়েছে, তবুও অভিজ্ঞতা দিয়েই এঁরা একদিন নিজেদের পথের ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এঁদের একদল গ্রহণ করলেন মার্কসবাদ, আরেক দল গান্ধীবাদ।
মতিলাল পুরকায়স্থ সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করে গান্ধীবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীজীর অহিংসা মন্ত্রগ্রহণ করেও তিনি তাঁর সহিংস অতীতকে ভুলতে পারছিলেন না। বিশেষ করে বক্তৃতা দিতে উঠলেই তার রক্ত টগবগ করে উঠতাে, অহিংসার কথা বাদ দিয়ে ব্রিটিশের প্রতি একেবারে হিংস্র হয়ে উঠতেন। এ-রকমই ঘটেছিল একবার ময়মনসিংহ টাউন হলের সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে। জোশের সঙ্গে তিনি বলে যাচ্ছিলেন, সাত সমুদ্র তেরাে নদী পার হয়ে এদেশে এসে ইংরেজরা কি চিরকালই আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে থাকবে? ওরা কি মনে করেছে, এদেশের মানুষের কোনাে দিন চোখ ফুটবে না? ওদের জানা উচিত, আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাবাে না। এবার আমরা রুখে দাঁড়াবাে। ওদের প্রত্যেকের মাথা আমরা খুঁড়িয়ে দিতে পারি, ওরা যে-গাড়ি করে চলে সে-গাড়ি আমরা বােমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারি, ওদের আমরা আমাদের খালে-বিলে-নদীতে ডুবিয়ে মারতে পারি। আমরা পিস্তল চালাতে শিখেছি, ওই পিস্তল মেরে আমরা ওদের সব কটাকে শেষ করে দিতে পারি, ঘরে আগুন লাগিয়ে বিবি বাচ্চাসহ ওদের আমরা পুড়িয়ে মারতে পারি…”
পুরকায়স্থের বক্তৃতায় সভাপতি ক্রমে শঙ্কিত হয়ে উঠছিলেন। তিনি তাঁর পাঞ্জাবী ধরে টান দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আরে, কী বলছেন আপনি? ওসব তাে এখন আমাদের কাজ নয়। আমরা এখন গান্ধীবাদী, আমাদের মন্ত্র অহিংসা…”
৪১
মুহূর্তে মতিলাল পুরকায়স্থ নিজেকে সামলে নিলেন। গলার স্বর বদলিয়ে বলতে লাগলেন, হ্যা, আমরা ওদের মেরে তাড়াতে পারি বটে, কিন্তু আমরা কি তা করবাে? না, না, মােটেই না। ওদের আমরা মারধর কিছুই করবাে না। আমরা এখন গান্ধী মহারাজার শিষ্য। আমাদের মন্ত্র এখন অহিংসা। আমাদের অহিংসা-অসহযােগের ধাক্কাতেই ওরা এদেশ ছেড়ে পালাবে, এভাবেই আমরা স্বরাজ লাভ করবাে।”
আমার অবশ্য মতিলাল পুরকায়স্থের মতাে এমনটি করতে হয়নি। আমার বালক শ্রোতারা কিছুই বুঝুক আর না বুঝুক, ওদের সামনে আগে যে রকম বলতাম, পরেও সে-রকমই বলে গিয়েছি। মাঝে কেবল একদিনই মাত্র বীরু বিশ্বাসের শ্যালকের-কাছে-শােনা সুভাষবাদী ফরােয়ার্ড ব্লকপন্থী বক্তৃতা দিয়েছিলাম।
তবে, সে-সময় কট্টর গান্ধীপন্থী আর সুভাষপন্থী দুই-ই ছিল কম্যুনিস্ট বিরােধী। সেনির্বাচনে মুসলিম লীগ তাে আর পাকিস্তানের পক্ষে হিন্দুদের কাছে ভােট চাইতে আসেনি, তাই কংগ্রেসের মূল লড়াইটা হয়েছিল কম্যুনিস্টদের সঙ্গে। কংগ্রেসের সভাগুলােতে বক্তারা যতাে না ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তার চেয়ে বেশি করতেন কম্যুনিস্টদের মুণ্ডুপাত। ওদের কথা শুনে মনে হতাে : ইংরেজ নয়, এদেশের মানুষের আসল শত্রু কম্যুনিস্টরাই। কম্যুনিস্টরা হচ্ছে রাশিয়ার দালাল। রাশিয়ার স্বার্থেই তারা ব্রিটিশদের পায়রােবি করেছে, গান্ধীর ভারত ছাড়’ আন্দোলনের বিরােধিতা করেছে, নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ এদেশে না আসতে পারে তার জন্যে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করেছে। এই দেশদ্রোহী কম্যুনিস্টদের যারা ভােট দেবে, তারাও হবে দেশের শত্রু। ওদের কিছুতেই ক্ষমা করা যাবে না।
আমাদের এলাকার ক্যুনিস্ট প্রার্থী মণিসিংহের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কেও কংগ্রেসীরা যাতা বলতাে। এবং অধিকাংশ মানুষই সেসব বিশ্বাসও করতাে।।
স্বভাবতই, আমার বক্তৃতারও অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছিল কম্যুনিস্টদের নিন্দাবাদ। অহেতুক ক্যুনিস্ট-বিদ্বেষ এর পরও বহুদিন আমার মাথায় বাসা বেঁধে ছিল।

 

Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!