You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৪শে জুলাই, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ৮ই শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

এ সফর গুরুত্বপূর্ণ

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন দু’সপ্তাহব্যাপী বিদেশ সফর শেষে গত পরশুদিন দেশে ফিরে এসেছেন। ডঃ কামাল হোসেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বার্মা ও উত্তর ভিয়েতনাম সফর করেছেন। সফর শেষে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তনের কালে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। সফরের ফলাফল সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাঁর সফর ফলপ্রসূ হয়ে বলে মন্তব্য করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যে সকল দেশ আমি সফর করেছি তারা সবাই ন্যায়ের স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া দরকার বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন।’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ‍ভুট্টো যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সে সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিঃ ভুট্টো যাই-ই বলুক না কেন—বিচার তার নিজস্ব পথ ধরেই এগোবে। বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিতব্য প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোন বৈঠক হবে কিনা এ ধরনের একটি প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট, একমাত্র পারস্পরিক সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ভিত্তিতে এ ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে। এছাড়া ঐ সকল দেশের সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ইশতেহার সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। আটক বাঙালীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নটিও ঐ সকল দেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এই বিষয়টি যে একটি মানবিক সমস্যা এবং এর সমাধান যে আশু প্রয়োজন তাও ঐ সকল দেশ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মৌলিক কতকগুলো সমস্যার প্রশ্নে সফরকৃত দেশসমূহের সমর্থন ও সহযোগিতার মনকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাবো। বিশেষ করে উপমহাদেশের কতকগুলো বাস্তব সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে যে সকল দেশ ঐক্যমত পোষণ করে তাদের সঙ্গে আমরা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে সবসময়ই আগ্রহী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এই সফর দেশের ও দেশের বাইরের সমস্যাসমূহের সমাধানের পথে বেশ খানিকটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে বলে আমরা মনে করি। পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দেওয়ার বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্যে এবং আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নটি সহ অন্যান্য মানবিক সমস্যা সমাধানের যে বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছিলো তার পরিপ্রেক্ষিতেও ডঃ কামালের এ সফর বিশেষ অর্থবহ। বস্তুতঃপক্ষে বাংলাদেশ অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, উপমহাদেশীয় শান্তি সহ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তায় এদেশ মনেপ্রাণে বিশ্বাসী। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বাস্তব আগ্রহ বিশ্বের কোন বিবেকবান মানুষ অস্বীকার করতে পারবেনা। কিন্তু পাকিস্তান এ ব্যাপারে বরাবর বাদ সাধছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। এটা বাংলাদেশের সুস্পষ্ট নীতি। এজন্যে ইতিমধ্যে ট্রাইব্যুনাল বিলও পাশ হয়েছে। আমরাও তাই বলবো, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উল্লেখিত সফর করা দেশসমূহ উপমহাদেশের সমস্যা অনুধাবন করবেন এবং শান্তি ও মৈত্রীর নিশ্চয়তার জন্যে সহযোগিতার হাত বাড়াবেন।

ফ্রান্সের বোমা বিস্ফোরণ, বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড়

বাঙালী কবির কন্ঠেই একদা আক্ষেপাত্মক সুরে ধ্বনিত হয়েছিলো, ‘শান্তির লালিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মুরুরোয়া প্রবাল দ্বীপে ফ্রান্সের প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ এই ‘ব্যর্থতার পরিহাস’কেই প্রকট করে তুলেছে। ফ্রান্সের এই গোঁয়ার্তুমির বিরুদ্ধে দেশ-দেশান্তরে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিশ্বব্যাপী প্রবল সোচ্চার প্রতিবাদী কন্ঠকে উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স গত একুশে জুলাই শনিবার মুরুরোয়া সময় সকাল ন’টায় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পারমাণবিক বিস্ফোরণটি ঘটায়। ফ্রান্স প্রশান্ত মহাসাগরে এই পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অব্যবহিত পর পরই নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া প্রতিবাদ জানিয়ে মানবাধিকার আইন সংক্ষরণের জন্যে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলো। আন্তর্জাতিক আদালত ফ্রান্সকে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে বিরত থাকার জন্যে রায় দিলেও ফ্রান্স সে রায় মানেনি। বিশ্ব আদালতের নিষেধাজ্ঞা এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মুখে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ফ্রান্স তার একগুঁয়েমি বহাল রেখেছে। সন্দেহ নেই, ফ্রান্স এই পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত উত্তেজনা বাড়াতেই সহায়তা করলো। মুরুরোয়া প্রবাল দ্বীপে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর পরই খোদ ফ্রান্সে এই অমানবিক ও শান্তি বিরোধী ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ফ্রান্সের কম্যুনিস্ট পার্টি এই বোমা বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে যে, বিশ্বের দু’টো বৃহৎ শক্তি যখন পারমাণবিক অস্ত্র সীমিতকরণের জন্যে চুক্তিবদ্ধ এবং শুভ প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে, তখন ক্ষমতাসীন ফরাসী সরকার পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে খেলায় মত্ত হয়েছে। বিবৃতিতে আরো স্পষ্ট করে মন্তব্য করা হয় যে, এই বোমা বিস্ফোরণের ফলে ফ্রান্স আন্তর্জাতিকভাবে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। আণবিক পরীক্ষার খেসারত হিসেবে ফ্রান্সের সম্পদের প্রভূত অপচয় হচ্ছে এবং ফ্রান্সের জনগণ এত সমস্যাকীর্ণতায় জড়িয়ে পড়ছে। ফরাসী সোস্যালিস্ট পার্টি ও ফ্রান্সের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের নিন্দা জানিয়েছে এবং মন্তব্য করেছে যে, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফরাসী সরকার বিশ্ব জনমতের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। শুধু ফ্রান্স নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্রান্সের এই পারমাণবিক হিংস্রতার বিরুদ্ধে নিন্দা ও ধিক্কার ধ্বনি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। নিউজিল্যান্ডের সত্যাগ্রহী রণতরী ওটাগো থেকে বোমা বিস্ফোরণের সংবাদ প্রচারিত হবার কয়েক মিনিট পরই নিউজিল্যান্ডে এই বিস্ফোরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। একে একে প্রতিবাদী কন্ঠ উচ্চারণ করে অস্ট্রেলিয়া, চিলি, পেরু, জাপান এবং ইন্দোনেশিয়া। অস্ট্রেলিয়ার ট্রেড ইউনিয়ন কাউন্সিলের সম্পাদক জানিয়েছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার শ্রমিকরা ফ্রান্সের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বর্জন করবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ফ্রান্স পারমাণবিক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরই অস্ট্রেলিয়ার ডাক বিভাগের শ্রমিকরা ফ্রান্সের সাথে ডাক যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো।
এক পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে যে, ফ্রান্স এ পর্যন্ত ৪৭টি আণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সত্য যে, এই সব বিস্ফোরণের অর্থ হচ্ছে, বিশ্বের বুকে নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় জাহির করা। ওটাগো রণতরীর নাবিকরা আশঙ্কা করছেন যে, ফ্রান্স প্রবাল দ্বীপে আরো একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটাবে। গত একুশ তারিখের বোমা বিস্ফোরণ সম্পর্কে সরকারীভাবে ফ্রান্সের কোন সত্যতা ঘোষণা করেনি, তবে প্যারিসের তথ্যাভিজ্ঞ মহল অভিমত দিয়েছে যে, আগামী সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ ফ্রান্স এই পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের সত্যতা সম্পর্কে সমগ্র বিশ্ববাসীকে অবহিত করবে। ফ্রান্স তার কৃতকর্মের সত্যতা যেদিনই ঘোষণা করুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা জানি, সত্যকে কোন দিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না। তাছাড়া, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতো একটি উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা তো আর চাপা পড়ে থাকতে পারে না। তাই ফ্রান্স যেদিন এই পারমাণবিক বোমা ফাটালো ঠিক তার পর পরই ‘টরে টক্কা টরে’ করে সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই নিন্দিত বোমাবাজির খবরটি রটে গেলো। চারিদিকে ধ্বনিত হলো সোচ্চার প্রতিবাদী কন্ঠ। ফ্রান্স কি তাহলে বিশ্বের বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, তা চায় না? তাহলে ফ্রান্স এই কিছুদিন আগেও কেন লাতিন আমেরিকায় পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করেছিলো? ফ্রান্স কি ইচ্ছে করেই আজ বিশ্বের দরবারে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে? বিশ্বের দু’টি বৃহৎ শক্তি রুশ-মার্কিন যেখানে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের স্বপক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানে ফ্রান্সের একগুঁয়েমি সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। চীনও এ পর্যন্ত পনেরো বার বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ফ্রান্সও বোমাতঙ্ক জিইয়ে রাখার চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। এতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথ বিঘ্নিত এবং কন্টকাকীর্ণ হচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী দেশকে আজ এই বোমা বিস্ফোরণের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে হবে। তবে যারা মানবাধিকার লংঘন করে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের আস্ফালন প্রদর্শন করবে, তাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করা দরকার। নইলে আজ যেখানে সমগ্র বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, সেখানে ফ্রান্স বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যে কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে, তা শুধু প্রতিবাদ জানানোর মধ্যেই যেন সীমিত না থাকে। মানব সভ্যতার বিকাশের জন্যেই পারমাণবিক অস্ত্রের হুংকার চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া দরকার। বৃহৎ শক্তিগুলো তো ইতিমধ্যেই অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছে। অতএব, হে উদ্ধত ফ্রান্স, এবার অস্ত্রের মহড়া বন্ধ করো। শান্তির পথ ধরো।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!