বাংলার বাণী
১৮ই মার্চ, ১৯৭৩, রবিবার, ৪ঠা চৈত্র, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
নতুন মন্ত্রিসভা
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হলো গতকাল। নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার মাত্র নয় দিনের মধ্যেই নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গতকাল শুক্রবার নতুন আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেছেন। মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু সহ ২১ জন মন্ত্রী রয়েছেন। একজন মাত্র নতুন মন্ত্রী এ মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুরানো মন্ত্রিসভা থেকে তিনজন মন্ত্রী বাদ পড়েছেন। জল্লাদ শিরোমণি ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গত বছরের ১০ই জানুয়ারী বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে মাত্র দু’দিন পরেই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তারপর মাত্র চৌদ্দ মাস সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর মন্ত্রিসভাকে দেশের বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংবিধান রচনা ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতিকে উপহার দিয়েছেন রক্তের আঁখরে রচিত নতুন সংবিধান। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুসম্পন্ন করেছেন দেশের সাধারণ নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সম্মুখে অন্যান্য সমস্যা ও সংকটের সঙ্গে ছিলো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সে দু’টি সমস্যা হলো শরণার্থী পুনর্বাসন ও খাদ্য। এ দু’টো সমস্যার সমাধান যে তারা করতে সক্ষম হয়েছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশে অন্ততঃ না খেতে পেয়ে কেউ মারা যায়নি। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর মন্ত্রিসভা এ বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ও তৎপর ছিলেন। সকলের মিলিত সাহায্য ও সহযোগিতার ফলেই খাদ্য সমস্যা, যোগাযোগ ও অন্যান্য সমস্যাকে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র চৌদ্দ মাস সময়ের মধ্যে হানাদার বাহিনীর নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বিধ্বস্ত ও বিপন্ন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। এজন্যে সময়ের প্রয়োজন। দেশবাসী এ সত্যকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন বলেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সংগ্রামী পার্টি আওয়ামী লীগকে অকুন্ঠচিত্তে সমর্থন করেছেন। নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি দেশবাসীর পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে। দেশবাসী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ শান্তি, প্রগতির পথ বেয়ে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাবে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সম্ভব হবে সমাজতন্ত্রের উত্তরণ। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত নতুন মন্ত্রিসভার দিকে দেশবাসী তাকিয়ে আছেন অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সমস্যা ও সংকটের পরিপূর্ণ সমাধান এখনো হয়নি। এখনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে আগুন, আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি, পুরোপুরিভাবে উৎপাদন শুরু হয়নি কল-কারখানায়, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জিত হয়নি ইত্যাকার নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। এ সমস্যাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে হবে। একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের পক্ষে একা সব কিছু করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর হাতকে শক্তিশালী করতে হলে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব হবে সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা।
একুশ সদস্য বিশিষ্ট নয়া মন্ত্রিসভায় দফতর বন্টনের ক্ষেত্রেও অনেক রদবদল করা হয়েছে। পুরাতন মন্ত্রিসভায় যাঁরা যে দায়িত্বে ছিলেন নতুন মন্ত্রিসভায় তাঁদের উপর নতুন দায়িত্বভার অর্পিত হয়েছে। এই দফতর বন্টন নিয়েও হয়তো নানান জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হতে পারে—উড়তে পারে কল্পনার ফানুস। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে তাতেও ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়েছে। জনৈক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছেন, ‘জনগণ আমাকে ক্ষমতা দিয়েছে। যে ভাবেই আমি মন্ত্রীদের তালিকা সাজাই সে ভাবেই জনগণ তা মেনে নেবে।’
বঙ্গবন্ধু জনতার মনের কথাটিই তুলে ধরেছেন। জনগণই হলো সকল ক্ষমতার উৎস। আর জনগণের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই কাজ করে যেতে হবে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুরাতন মন্ত্রিসভা যা করেছেন এবং যা করতে পারেননি তারই সঠিক হিসাব-নিকাশ করে তারা দেশ ও জনগণের সেবায় পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করবেন এটাই আমরা আশা করছি। চারটি রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধানের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার কঠিন দায়িত্বভার অর্পিত হয়েছে নতুন মন্ত্রিসভার উপর।
সরষের ভূত তাড়াতে হবে
পত্রান্তরে হাইজ্যাক, ছিনতাই, হত্যা ও চুরির সংবাদ একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। হাইজাক, ছিনতাই, ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি গর্হিত কাজগুলো যেন সমাজের বুকে বিষ ফোড়ার মত চেপে বসে আছে। এর কোন বিহিত হচ্ছে না। আজ রাস্তায় গাড়ী হাইজ্যাক, ব্যাঙ্ক লুণ্ঠন, কাল নারী নির্যাতন, পথচারীদের টাকা পয়সা কেড়ে নেওয়া ইত্যাদির মত কাজগুলাে বিনা বাধায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ সমাজে। এমন কর্ম যে শুধু সমাজের তথ্যকথিত ছেলে-ছােকরারাই করে বেড়াচ্ছে তাই নয়। সংবাদে প্রকাশ, এমন কাজ অনেক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিরাও করে চলেছেন বা যাদের হাতে আইন রক্ষার ভার তারাও করছেন। খবরে প্রকাশ, স্থানীয় কলেজের জনৈক অধ্যক্ষ টিসিবি’র বরাদ্দকৃত ছাত্রদের কাপড়-চোপড় বেমালুম গায়েব করে দিয়েছেন। গতকাল জনৈক কনষ্টেবল পথচারীর নিকট থেকে টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে ইত্যাদি। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, রক্ষক ভক্ষক হবার বহু ঘটনা ঘটে চলেছে আমাদের সমাজে। আইন রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মধ্যেও দুর্নীতি বিদ্যমান।
বিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষের কাছে অসভ্য কর্মে আবর্তিত পংকিল সমাজ নিশ্চয়ই কাম্য নয়। মানুষ তার জীবনে সুস্থতা পেতে চায়—শাস্তি চায়। দেশ স্বাধীন হবার পর প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য ছিল দেশের আইনানুগ বিধান মেনে চলার মাঝে সমাজের সুস্থতা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তার ব্যতিক্রম রূপ দৃষ্টমান আমাদের সমাজে। যখন আমরা পর্ষীক্ষায় ছাত্রদের নকল করার প্রবণতাকে নিন্দা করছি তখন কলেজের অধ্যক্ষ এমনতর দুর্নীতিপরায়ণ হলে ছাত্রদের ন্যায়পরায়ণ হবার সুযোগ কোথায়! কিছুদিন পূর্বে দুর্নীতি দমন বিভাগ দশ হাজার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। তার মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন যাদের উপর আইন রক্ষার ভার অর্পিত। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, আমাদের আইন রক্ষাকারী প্রশাসনিক যত্নে ও সমাজের প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতির প্রবেশ ঘটেছে। এ মারাত্মক ব্যাধির শিকারে পরিণত সমাজকে কলুষমুক্ত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি। আর সমাজের দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা অধিষ্ঠিত রয়েছেন, যাদের উপর আইন ও শৃঙ্খলার দায়িত্বভার অপিত তাদের দুর্নীতিমুক্ত হবার মধ্যেই সমস্যার সমাধান নিহিত। সোজা কথায় যে সরষে দিয়ে ভূত তাড়ানো হবে সে সরষেতে ভূত থাকলে চলবেনা। সরষেকে ভূতমুক্ত হতেই হবে দেশ ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক