কলাম
দৈনিক ইত্তেফাক
৪ঠা মার্চ ১৯৬৯
রাজনৈতিক মঞ্চ
মোসাফির
মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়া এক ভীষণ সমস্যা দেখা দিয়াছে। শেখ মুজিবের মুক্তির পর ঢাকার রেসকোর্সে যে ঐতিহাসিক গণ-সম্বর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়, সে সম্বর্ধনার মঞ্চ হইতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৩রা মার্চের মধ্যে মৌলিক গণতন্ত্রীদের পদত্যাগ করার দাবী জানাইয়া এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। ছাত্রদের এই দাবী বোধগম্য। প্রথমত: “মৌলিক গণতন্ত্র” ব্যবস্থার বিলোপ সাধন বর্তমান আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত: ১৯৬৪ সালের নির্বাচনকালে এরা জনগণের নিকট যে ওয়াদা করিয়াছিলেন তাহা তাঁহাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ রক্ষা করেন নাই। মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ইহাদের দলীয় আনুগত্য কিংবা সততা বলিয়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কেহ-বা সরকারী চাপের নিকট নতি স্বীকার করিয়াছে, কেহ-বা ‘রূপচান্দের’ ভিত্তিতে ভোট প্রদান করিয়াছে। অবশ্য মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা এমনিভাবেই সরকারী কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হইয়াছে যে, সৎসাহসী লোক ছাড়া কাহারও পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করার উপায় ছিল না। ১১ কোটি জনসাধারণের মধ্যে মাত্র ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীকে ভোটাধিকার প্রদান করিয়া ক্ষমতাসীনরা ক্ষান্ত হন নাই, এদেরকে সরকারী শাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনিয়াছিলেন তাহাই নয়, নানা প্রলোভনের ‘টোপ’ও দেওয়া হইয়াছিল। ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কোটি কোটি টাকা এদের হাতে তুলিয়া দিয়া উহা যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হইয়াছে। তারপরও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে এবং উপনির্বাচনে এদের ‘নগদ নারায়ণের’ ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। গোটা মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা কতদূর দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, দেশবাসীর সে সম্পর্কে নিজেদেরই অভিজ্ঞতা রহিয়াছে। এই অবাধ সুযোগ-সুবিধা ভোগের অধিকারী মৌলিক গণতন্ত্রীরা গ্রামবাসীর দ্বারা নির্বাচিত হইলেও গ্রামবাসীদের উপর ইহাদের দৌরাত্ম্য সীমা ছাড়াইয়া গিয়াছিল। এদের মধ্যে দুই-চারিজন ভাল লোক থাকিলেও দুর্নীতির উপর ভিত্তি করিয়া যে সংস্থা গঠিত, তাতে তাদের স্থান হইল না-হইতে পারে না। তারা সরকারের খুশি-খেয়াল মত কাজ করিতে সম্মত না হইলে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা ত পাইতই না, বরং স্থানীয় কর্মচারীদের রোষালনে পড়িবার উপক্রম হইত। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনকালে যারা পবিত্র কোরান স্পর্শ করিয়া জনগণের ভোটাধিকার ফিরাইয়া দিবার ইস্যুর উপর ভোট প্রদানের ওয়াদা করিয়াছিল তারা একে একে বেঈমানে পরিণত হইল। এক দিকে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী সরকারের চাপ অন্যদিকে ‘রূপচাঁদের’ মোহ তাহাদিগকে বিপথে পরিচালিত করিল। স্বার্থের জন্য যারা বিপথগামী হয় তাদের অধঃপতনের সীমা-পরিসীমা থাকেনা। যে দেশবাসীর ভোটে তারা নির্বাচিত হইলেন সেই দেশবাসী বিশেষত: গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের উপর ‘টাউটগিরি’ করা এবং দুর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মচারীদের হাতিয়ার হিসাবেই তারা ব্যবহৃত হইতে লাগিল। এক একটি উপ-নির্বাচনে গভর্ণর বাহাদুর মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়া যে ‘যাদুর শেল’ দেখাইলেন, তাতে পিণ্ডির উচ্চমহলে ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল।
বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে কোন সভ্যদেশের জনগণের নামে, ভোটের নামে, গণতন্ত্রের নামে এইরূপ ভণ্ডামী-সণ্ডামী যে বেশীদিন চলিতে পারেনা সংশ্লিষ্ট সকল মহল যেন তাহা ভুলিয়া গেলেন। গণতন্ত্রের নামে এই ব্যভিচারমূলক ব্যবস্থার দ্বারা বহু দেশকে এবং বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করা হইয়াছিল। এই ব্যভিচারমূলক ব্যবস্থা দ্বারা দেশে কি ‘অপূর্ব উন্নয়ন’ ঘটিয়াছে তার গাল ভরা প্রশংসা ইংলণ্ডের সুসাহিত্যিক রাস্ট্রক উইলিয়ামস ও বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক টয়েনবির মত লোককেও বিভ্রান্ত করিয়াছিল। রাব্রুক উইলিয়ামস তো মৌলিক গণতন্ত্রী ব্যবস্থার প্রশংসা করিয়া এক পুস্তকও লিখিয়াছিলেন। এখানেও ‘রূপচাঁদের’ খেলা ছিল কিনা তাহা হয়ত একদিন না একদিন প্রকাশ পাইবে। হঠাৎ তাঁহার সহিত একবার সাক্ষাৎ হওয়ায় আমি তাঁহাকে এইটুকুই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম যে, মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা যদি এতই ভাল হয়, তবে আমাদের দেশে এর জন্য ওকালতি না করিয়া তোমার দেশ অর্থাৎ ইংলণ্ডে ইহা প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করনা কেন? ভদ্রলোক না জবাব হইয়া মুখ ঘুরাইয়া নিলেন। আমরা একনায়কত্ববাদের কথা শুনিয়াছি, (এ সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতাও আছে) একনায়কত্ববাদী দেশের নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কেও আমাদের কিছুটা জ্ঞান আছে, কিন্তু গণতন্ত্রের নামে এমন দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থা আমরা জীবনেও দেখি নাই, শুনিও নাই। এই দিক দিয়া বিচার করিতে গেলে মৌলিক গণতন্ত্রীদের পদত্যাগ শুধু ছাত্র সমাজেরই দাবী নয়, জনসাধারণেরও দাবী। কিন্তু তাদের পদত্যাগের ফলে সাময়িক অসুবিধা দেখা দিবে এবং স্থানীয় ব্যবস্থাদিতে শূন্যতা সৃষ্টি হইবে বলিয়া আমাদের ধারণা। ইউনিয়ন বোর্ড এদেশে বিগত ৪০ বছর যাবৎ প্রচলিত রহিয়াছে, আমরা ইউনিয়ন বোর্ড তুলিয়া দিবার পক্ষপাতী নই বরং জন-প্রতিনিধিত্বমূলক ইউনিয়ন বোর্ডের মারফত স্থানীয় উন্নয়নমূলক তথা জনকল্যাণমূলক কাজ-কর্ম পরিচালনা করা উচিত।
দেশে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠিত হইলে, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসাবে ইউনিয়ন বোর্ড তথা ইউনিয়ন কাউন্সিল ‘ভক্ষক’ না হইয়া জনগণের ‘রক্ষক’ বনিতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যাঁহারা সদস্য আছেন, তাঁহারা ইচ্ছায় হউক বা অনিচ্ছায় হউক, প্রায় সকলে দুর্নীতিগ্রস্ত হইয়া জনগণের আস্থা হারাইয়া ফেলিয়াছেন;-এরা এতদিন জনগণের উপর অত্যাচার-নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহৃত হইয়াছে। এতদসত্ত্বেও এক্ষণি তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হইলে, ওয়ার্কস প্রোগ্রামের নামে যে কোটি কোটি টাকা ইহাদের হস্তে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছিল, তার হিসাব-নিকাশ কে দিবে ? খাদ্য ইত্যাদি ইহাদের মারফত বিলির ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। বিকল্প ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত তারই বা কি হইবে ? সুতরাং ইহারা পদত্যাগ করিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা-পয়সার হিসাবপত্র বুঝাইয়া না দেওয়া পর্যন্ত এবং অন্যান্য আবশ্যকীয় ব্যাপারে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা না পর্যন্ত এদের পদত্যাগ পত্র গৃহীত হওয়া সঙ্গত হইবে না বলিয়া আমরা মনে করি। এ প্রসঙ্গে আমরা ছাত্র-বন্ধুদের উদ্দেশ্যে একটি আবেদন করিতে চাই। ইস্তফা পত্র আদায়ের জন্য কোন মহল যেন মৌলিক গণতন্ত্রীদের উপর কোন প্রকার জবরদস্তিমূলক আচরণ না করে। যাঁহারা ছাত্র সমাজের আবেদনে সাড়া দিবে না, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের লোকদের কাছে তাঁহারা চিহ্নিত হইয়া থাকিবে। আজিকার আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে দেশে গণ-সরকার প্রতিষ্ঠিত হইলে মৌলিক গণতন্ত্রী প্রথা সমূলে বাতিল করা হইবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নূতন ইউনিয়ন বোর্ড গঠিত হইবে।
ছাত্র সমাজ সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছে তা যেন এখানে-ওখানে দুই একজনের হঠকারী বা অবাঞ্ছিত আচরণের ফলে এতটুকু ম্লান না হয় সময় থাকিতে ছাত্র সমাজকে সেদিকে লক্ষ্য দিতে হইবে। এদিক-ওদিক হইতে দুই চারিটা অবাঞ্ছিত কার্যকলাপের খবর আমাদের নিকট পৌছিয়াছে। আমরা বিক্ষিপ্ত খবর পাইতেছি যে, কোন কোন স্থানে তহশীল-কাচারীর কাগজপত্র পুড়াইয়া দেওয়া হইতেছে এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাইবার চেষ্টা করিতেছে। আমাদের ধারণা ইহার পিছনে প্রধানত: দুর্নীতিপুষ্ট অফিসারদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উস্কানি রহিয়াছে। প্রজাসাধারণের নিকট হইতে জবরদস্তিমূলকভাবে ঘুষ আদায় করা ছাড়াও বহু দুর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মচারী আদায়কৃত সরকারী রাজস্বের তসরুপ করার জন্য এই সকল ফন্দি-ফিকির আঁটিতে পারে। এ সম্পর্কেও জনসাধারণ ও ছাত্রসমাজ এবং রাজনৈতিক কর্মীদের সতর্ক থাকিতে হইবে। কোন মহলের প্ররোচনায় বা কোন প্রলোভনে কেহ যেন বিপথগামী না হন। আমরা দেখিয়া অবাক বোধ করিতেছি যে, কিছুকাল যাবৎ সরকার সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া আছেন, দৈনন্দিন কাজ-কর্মে পর্যন্ত অচলাবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে। গ্রামাঞ্চলে খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি হইলেও নাকি পুলিস নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকে। বর্তমান আন্দোলন দমননীতির বিরুদ্ধে, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশে গণ-অধিকার তথা গণতন্ত্র পুন:প্রবর্তনই এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। সরকারী অফিস-আদালতে এবং বিভিন্ন বিভাগের স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ হইয়া যাক, ইহা এই আন্দোলনের লক্ষ্য ত নয়ই, ইহা কোন নাগরিকেরও কাম্য হইতে পারে না। কিন্তু যাঁহারা ডাণ্ডা ছাড়া শাসন কার্য পরিচালনা করিতে অভ্যস্ত নন তাঁহাদের ডাণ্ডা অকেজো হইয়া যাইবার পরে তাঁহারা মনোবল হারাইয়া নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়িতে পারেন। কিন্তু দেশবাসী চায় যে, দেশের বিকল্প গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা প্রচলিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারী শাসনযন্ত্র (অফসরহরংঃধঃরাব সধপযরহবৎ) চালু থাকুক এবং দেশবাসীর প্রতি সরকারী কর্মচারীরা স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করুক। অন্যথায় এই নিষ্ক্রিয়তার জন্য কোথাও যদি কোন অঘটন ঘটে, তাহা হইলে দেশবাসীর নিকট তাঁহাদের একদিন কৈফিয়ত দিতে হইবে’।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯