You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952.02.21 | সেদিনের একুশ -ডঃ আনিসুজ্জামান - সংগ্রামের নোটবুক
আমাদের কালের অনেকের জীবনের গৌরব এই যে, তারা একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের দুই মহৎ ঘটনার ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের
 
– মুক্তিযুদ্ধেরসাক্ষী এবং প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে তার অংশীদার
 
এসবই সৌভাগ্যবানদের আমিও একজন। হঠাৎ কখনাে কখনাে এসব দিনের অভিজ্ঞতা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে, আনমনা করে দেয়। আবার এও বুঝি, কালের ব্যবধানে কিছু স্মৃতি হারিয়ে [ যায়। কিছু তারিখের গােলমাল হয়। বিশেষ বিশেষ ব্যক্সি
 
বিশেষ মুহূর্তের ভূমিকা। অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। তবু যেটুকু মনে
 
* পড়ে, সেটুকু প্রতিভাত হয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয় বলে। ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে আমি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই। এর অল্পকাল পরে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যােগদান করি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে, মূলত অলি আহাদের উদ্যোগেই, যুবলীগের অফিস সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি।
 
উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, এই মর্মে পল্টন ময়দানে ৩০ জানুয়ারী খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পর জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম না, যদিও পরিষদের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছি। ৪ ফেব্রুয়ারী ও ১১ ফেব্রুয়ারীর প্রতিবাদ দিবস উপলক্ষে স্থানীয় স্কুল-কলেজে ধর্মঘট আয়ােজন করা এবং ভাষা আন্দোলনের পতাকা বিক্রি করা এসব কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সহপাঠিদের সঙ্গে ট্রেনে ঢাকা থেকে নারায়ণগজ্ঞের পথে এবং ফিরতি পথে পতাকা বিক্রি করেছি। পােগােজ স্কুল, সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে ধর্মঘট করাতে গিয়েছি। পুলিশ এসে পড়ায় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের গেটে অবস্থানরত আমরা দুজন সরে পড়তে বাধ্য হই।
 
আমরা মূলত যুবলীগের উদ্যোগে আন্দোলন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যুবলীগের সকল ইউনিটকে কেন্দ্রীয় নির্দেশ লিখে জানাবার দায়িত্ব ছিল আমার।
 
আমার যতদুর মনে পড়ে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে একটি পুস্তিকা রচনার ছার মােহাম্মদ তােয়াহকে দেয়া হয়েছিল। এমনও হতে পারে যে, যুবলীগই এই দায়িত্ব কে অর্পণ করেছিল; তবে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ থেকে তাঁর পুস্তিকা বের হবে, এমন ধারণাই আমার জন্মেছিল। তােয়াহা সাহেব লিখতে দেরি করছিলেন। তখন অলি আহাদ আমাকে যথা সম্ভব একটি পুস্তিকা লিখতে বলেন। আমি লিখে দিলে অলি আহাদ তা সংশােধন করে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নামে মুদ্রণ ও প্রচার করেন। পুস্তিকাটির নাম ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সাব-টাইটেল ছিলঃ কি ও কেন? 
 
পুস্তিকায় লেখক হিসাবে কারাে নাম ছিল না। এটাই সম্ভবত ফেব্রুয়ারী মাসে ছাপা ভাষাআন্দোলন সম্পর্কিত প্রথম পুস্তিকা। এরপর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের পুস্তিকা বেরিয়েছিলঃ আমারটার চেয়ে আরেকটু বড় ও ভালাে হয়েছিল। সেটি লিখেছিলেন বদরুদ্দীন উমর। | ২০ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা জারি হওয়ার পরে রাতে আওয়ামী লীগের নবাবপুর অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সামি পরিষদের যে সড় হয় তাতে জগন্নাথ কলেজ সংগ্রাম পরিষদের নাম করে পর্যবেক্ষক হিসেবে সৈয়দ আহমদ হােসেন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। তখনই আমাদের মনে হয়েছিল সভায় যদি ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তা কেউ মেনে নেবে না। ২১ ফেব্রুয়ারী সকালে আমাদের বাসা থেকে আমরা কয়েক বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে রওনা হয়েছিলাম থমথমে আবহাওয়ার মধ্যে। আমার মা ও বােন সকলকে পরটা-ডিম খাইয়ে দিয়েছিলাম। মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে গেলে তাদের কি করণীয় হবে।
 
মােটামুটি ১৪৪ ধারা বাঁচিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে যে সংখ্যক ছাত্র প্রবেশ করছিল, তাতে স্পষ্টই বােঝা যাচ্ছিল যে, ১৪৪ ধারা ভাঙবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী দশজনের এক-একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে রাস্তায় বের হতে শুরু করে। আমার যতদূর মনে পড়ে, প্রথম দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী এখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। আমার সহপাঠি ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেয়ামল ৰাসির ও আমীর আলী সবত দ্বিতীয় ছিল। হাসান হাফিজুর রহমান স্মৃতিভ্রমবশত লিখেছেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারীতে গুলি চালনার পর তিনি যখন প্রচারপত্র ছাপতে যান, তখন আমীর আলী তার সঙ্গে ছিল।
 
প্রথম দল বেরিয়ে যাওয়ার পর অলি আহাদ মধুর দোকানের সামনে আমাকে ডেকে নিয়ে যুবলীগ অফিসের চাবি দিয়ে বলেন যে, যে কোনাে মুহুর্তে তারা গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন। অফিসের দায়িত্ব আমার থাকবে। অবস্থা বুঝে অফিসের কাগজপত্র সরিয়ে নিতে হবে এবং সকল ইউনিটের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতে হবে। যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ইমদাল্লাহকে বাইরে রাখার চেষ্ঠা করা হবে। তার সঙ্গে যােগাযোগ রেখে আমি যেন কাজ করি। এই দায়িত্ব। আমাকে নিতে হবে বলে আমি যেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করি। আমি তার কথা অনুযায়ী কাজ করছিলাম। ‘ ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী দল ক্রমশ বাড়তে থাকে। পুলিশ কলাভবনের গেটের সামনে মৃদু লাঠি চালনা করে। তারপর কাঁদানে গ্যাস। ছাত্ররা ইট-পাটকেল মারতে থাকে পুলিশের দিকে। এ বিষয়ে নেতাদের নিষেধ ‘তার মানেনি। এক পর্যায়ে ভাইস-চ্যান্সেলর ডক্টর সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেনকে কলাভবনের বারান্দায় দেখি। ভকে দেখে বেশ কিছু ছাত্র দৌড়ে যায় এবং তাকে পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে বলে। আমি তখন গা থেকে গেঞ্জি খুলে পুকুরে তা ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম চোখে পানি দেয়ার জন্য। আমি অন্য ছাত্রদের পিছু পিছু তার দিকে গিয়েছিলাম। ভাইস-চ্যান্সেলর বলেছিলেন যে, পুলিশ তার কথা শােনেননি এবং তিনি প্রতিবাদ করবেন।
 
মধুর দোকানের পাশের রেলিং টপকে ততক্ষনে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সবাই সমবেত হতে শুরু করেছিল। সেখান থেকেও পুলিশের দিকে কিছু ইট ছোড়া হয়। তারপর হাসপাতালের পশ্চিম দিকের রেলিং পেরিয়ে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে সকলে ক্সড়ো হয়। হােস্টেলের গেট দিয়ে রাস্তায় বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠি চালায়। 
 
প্রাঙ্গণে যাদেরকে দেখেছিলাম, তাদের মধ্যে ইমাদুল্লাহ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান ও মুর্তজা বশীরও ছিলেন। এক সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ আমাকে বলেন, গুলি চালাতে পারে। চার মিনিট পনেরো পরই গুলি চলে। গুলিতে আহত একজনকে মুর্তজা বশীর ধরেছিলেন, সে কথা পরে তিনি আমাকে বলেন। | গুলি চলার পর পরই আমরা শুনতে পাই যে, আবুল বরকত, সালাম ও রফিকউদ্দিন নামে তিনজন ছাত্র মারা গেছে। এই সালামকে আমরা মেডিক্যাল কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্র (এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক) সালাম বলে ধরে নিয়েছিলাম। পরে জানা যায় যে, তিনি মারা যাননি। গুলিবর্ষণের পরে মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলের একটি ঘরে মাইক্রোফোন বসানাে হয়। যিনি পারছিলেন তিনিই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমাকে একটা বক্তৃতা লিখে দিতে বলা হয়। কিন্তু বলার গতির সঙ্গে লেখার গতি তাল রাখতে পারছিল না। ফলে। আমাকে মাইক্রোফোন নিতে বলা হয়। আমি পুলিশদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতা দিই; পুলিশ ধর্মঘটের সময়ে সরকার তাদের ওপর যে নির্যাতন চালায় তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাঙালী হিসাবে তাদেরকে আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে বলি। আমি অল্পক্ষণ বলেছিলাম। তােয়াহা সাহেবও সেখান থেকে বক্তৃতা করেন। গুলি চালানাের সংবাদ পেয়ে বেতারকর্মীরা যে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে কথাও আমি মাইকে ঘােষনা করি আরেক দফায়। পরে মাওলানা । আলুর রশিদ তর্কবাগীশ পরিষদ থেকে বেরিয়ে এখানে এসে বক্তৃতা দেন।
 
পরে সন্ধ্যার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে রেল লাইন ধরে আমি বাসায় ফিরে আসি।
 
২২ তারিখে আমার মামাতাে ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামানের সাইকেলে চেপে আমি বিশেষ করে নেয়ামল বাসিরের জামিন নেওয়ার উদ্দেশ্যে মাহুতটুলীতে সৈয়দ আবদুর রহিম মোজারের কাছে যাই। উনি ততক্ষণে কোর্টে চলে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ কোর্টে ঘোফেরা করে কাউকে না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসি। ইতিমধ্যে অনেকগুলাে মিছিল বেরিয়েছিল। ফেরার পথে নবাবপুরে গুলিচালনার খবর পাই। একটা ল্যাম্পপােস্টে গুলির দাগ সকলে মিলে দেখছিলাম। সংবাদ অফিস আক্রান্ত হচ্ছে, তা দূর থেকে দেখি। হাইকোর্টের সামনে গুলি চলেছে জেনে ওখান থেকেই ফিরে আসি।
 
২৩ তারিখে আব্বার গাড়িতে ডাক্তার লেখা) করে লক্ষ্মীবাজারের একটা দোকান থেকে মাইক্রোফোন ভাড়া করে জগন্নাথ কলেজে নিয়ে যাই। কলেজের হোস্টেলের একটি ঘরে তা স্থাপন করে সেখান থেকে বক্তৃতা দেওয়া হয়। আমি কিছুক্ষন বলেছিলাম। তারপর ওই উদ্যোগের সঙ্গে আর আমার যােগ ছিল না। সম্ভবত ২৫ তারিখে পুলিশ হােস্টেলে ঢুকে মাইক নিয়ে চলে যায়। | প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের (২৩ ফেব্রুয়ারী) সময়ে আমি অল্পক্ষণ উপস্থিত ছিলাম। পরদিন আবুল কালাম শামসুদ্দিন তা উদ্বােধন করেছিলেন বলে মনে পড়ে। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ ছােঠ বক্তৃতা দিয়ে মােনাজাত করেছিলেন। আমার আব্বা ও মা রিকশায় 
 
করে শহীদ মিনারে গিয়েছিলেন বিকেলে। সকলেই শহীদ মিনারে টাকা পয়সা দান করছিলেন। মা সৈয়দা খাতুন একটি সােনার চেন দেন। চেনটা ছিল আমার মৃত একটি ছোট বােনের। তার স্মৃতি হিসাবে মা এটি রক্ষা করেছিলেন। মুর্তজা বশীরের একটি কবিতায় এই সােনার হারটির কথা আছে। মা এটা যে মিনারে দিয়ে আসবেন, তা আমরা কেউ জানতাম না। উনি দিয়ে এসে আমাদের বলেছিলেন।
 
নেতাদের নামে হুলিয়া বেরিয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে রা খানিকটা আত্মগােপন করেছিলেন। শহীদ মিনার পুলিশ যখন ভেঙে দেয়, তখন হাসপাতালের প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে ছিলাম আমরা। আমার মনে পড়ে, অরুদ্ধ কষ্ঠে ইমাদুল্লাহ ক্যামেরা ক্যামেরা’ বলে চিৎকার করছিলেন, বলছিলেন, ‘ওরা মিনার ভাঙছে কেউ একটা ছবি তুলে রাখাে।’
 
বাংলা বিভাগের রফিকুল ইসলাম বােধ হয় মাথার খুলি উড়ে যাওয়া রফিক উদ্দিনের ছবি তুলেছিলেন। সেটা ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে সামগ্রিক ধর্মঘটের আহ্বান জানানাে হয়েছিল। ওই আহ্বান জানিয়ে আমি একটা প্রচারপত্র তৈরী করি। পাকিস্তান বুক ডিপাের মালিকের ছেলে মাখন (বদরুদ্দীন আহমদ, এঙ্গেকেট) তাঁদের প্রেসে সেটা ছেলে দিয়েছিলেন। এই যােগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে আমাদের সিনিয়র ছাত্র আনােয়ার হােসেন (স্টার বাবা খন্দকার আহমদ হােসেন চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, রাজনীতিবিদ দেওয়ান মাহবুব আলী পত্রে আলুর বােনকে বিয়ে করেন।) ইশতেহার ইত্যাদি অনেকে লিখতেন এবং প্রচার স্বতেন। মেডিক্যাল কলেজ, সলিমুল্লাহ মুসিলম হল, জগন্নাথ কলেজ এসব সগ্রাম পরিষদ থেকে স্থানীয়ভাবেও প্রচারপত্র বের হতাে।
 
২২ বা ২৩ ফেব্রুয়ারীতে ইমাদুল্লাহ আর আমি যুবলীগ থেকে কিছু দরকারি কাগজপত্র আর টাইপরাইটারটা আমাদের বাসায় (৮৭ বামাচরণ চক্রবর্তী রােডে) নিয়ে আসি। পরে যুবলীগ অফিস পুলিশ সীল করে দেয়। কিন্তু ইউনিটগুলাের ঠিকানা আমাদের কাছে থাকায় আমরা কিছু চিঠিপত্র পাঠাতে সমর্থ হই। সেসব চিঠিপত্র ইমাদুল্লাহ সই করেন। | বােধহয় ২৫/২৬ তারিখে অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল মতিন ও ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য নেতার নামে গ্রেপ্তারী পরােয়ানার প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি কাগজে বেরিয়ে আসে। তারা আত্মগােপন করেন। অলি আহাদের ভাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের। শিক্ষক, ডঃ আবদুল করিম আমার বাসায় এসে খবর দেন যে, অলি আহাদ আত্মগােপন করেছেন। তবে চিরকুট কেউ বিশেষ একটা শব্দ লিখে আনলে আমাকে বুঝতে হবে যে, অলি আহাদ তাকে পাঠিয়েছিলেন। আমি প্রথম বার্তা পাই চিকিৎসক ডাঃ এম, এ, করিমের মাধ্যমে। তিনি এককালে জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন, তথন যুবলীগে ছিলেন, পরে কিশাের মেডিক্যাল হল নামে নবাবপুরে একটি ফার্মেসী প্রতিষ্ঠা করেন এবং অসানী ন্যাপে সক্রিয় হন। এই বার্তায় কিংবা তার পরে আরেকটি বার্তায় নির্দেশ ছিল একজনের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি আমার এক ক্লাশ উপয়ে পড়তেন বােথ হয় । যাই হােক, তার সঙ্গে সন্ধ্যায় রানকিন স্ট্রীটের উল্টোদিকে ভূতের গলিতে একটা বাসায় যাই। অলি আহাদ সেখানে ছিলেন । তনি আমাকে বলেন, শান্তিনগরে ডাক্তার মােতালেবের বাসায় তাকে পেীছে দিতে হবে। সে বাসা ‘আমি চিনতাম তা তিনি কোনােভাবে জেনেচ্ছিলেন। ডাক্তার মােতালেবের অনুজ 
 
আবদুল মালেকের সঙ্গে আমার এক সময়ে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল-তিনি এককালে র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট দলে সক্রিয় ছিলেন। আমি রিকশায় করে অলি আহাদকে সেখানে পৌছে দিই। তখন জেনেছিলাম যে, ভাষা-আন্দোলনের নেতারা সেখানে বৈঠকে বসবেন। আমি যেহেতু সাম পরিষদের সদস্য ছিলাম না, সেহেতু ওই বৈঠকে আমার উপস্থিত থাকার কোনাে প্রশ্নই উঠেনা। অলি আহাদকে পেীছে দিয়েই আমি চলে আসি। পরে কাজী গােলাম মাহবুব ছাড়া সভার আর সকলেই সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মাহবুব সাহেব পুলিশ আসার। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মাচায় উঠে লুকিয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে তিনি আত্বসমর্পন করেন। আন্দোলনের নেতারা সকলে বন্দী হয়ে পড়েন।
 
ভাষা আন্দোলনের প্রবাহে এভাবে ভাটা পড়ে। ২২ ও ২৩ তারিখে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয়েছিল। ২৪ তারিখ রােববার ছিল। ২৫-এর হরতাল সফল হয়নি। ২৬ তারিখ অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তারপর নেতৃত্বের মধ্যে যােগাযােগের অভাব ঘটে। দমননীতির জন্য কর্মসূচীও ঠিকমত উপস্থিত করায় বিঘ্ন ঘটে। ফেব্রুয়ারী মাস শেষ হওয়ার আগেই আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। আমার শুধু এইটুকু মনে পড়ে যে, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের সংগ্রামী ভূমিকা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রবীণ নেতারা সবটা অনুমােদন করেননি। তাছাড়া, আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, ২১ ফেব্রুয়ারীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সভায় যদি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ১৪৪ ধারনা ভাঙার সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত হয়, ফলে পরিষদ আপনিই ভেঙে যাবে।
 
সাধারণ ছাত্র-যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল তারা মার্চের মাঝামাঝি সকলেই ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু নেতাদের বহুদিন আটকে রাখা হয়েছিল। তবে একুশের চৈতন্য ততদিনে ব্যাপ্ত হয়েছিল। দেশময়। | তারপরও খুব অর্থবহভাবে একুশে ফেব্রুয়ারী এসেছে আমাদের জীবনে। ১৯৫৫ সালে। ৯২-ক ধারার আমলে একুশে ফেব্রুয়ারী পালনের বিষয়টিও হিল প্রথম একুশের ঘটনার মতােই দুঃসাহসিক অভিযানের মতাে। ১৯৫৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল বিজয়ােসৰের মতে – কারণ সদ্য বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে সংবিধানে। স্বাধীন বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপনের অনুভূতি খুবই স্নিরকম ছিল ১৯৭২ সালে। আর এই শহীদ মিনার আবার ভাঙলাে, আবার গড়ে উঠলাে এবং চিরকাল রয়ে গেলাে আমাদের সকলের মিলনক্ষেত্র হয়ে। কিন্তু সেসব কথা আজ নয়।
 
* ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণমূলক এই লেখ৯৫ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারী দৈনিক ভোরের কাগজে ছাপা হয়। + উপরােক্ত কাবছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম দলের নেতৃত্ব দিয়াছেন বলিয়া যে উল্লেখ আছে তাহা সঠিক নয়। প্রকৃত ঘটনা ছিল, মেডিকেল কলেজ ছাত্র আজমল হােসেন ১৪৪ ধাক্স জঙ্গর প্রথম দলের নেতৃত্ব দেন।-অলি আহাদ। 
সূত্র:   জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ – অলি আহাদ