You dont have javascript enabled! Please enable it! আয়েশা বেদোরা চৌধুরী - সংগ্রামের নোটবুক
আয়েশা বেদোরা চৌধুরী
ইমামউদ্দিন চৌধুরী ও কানিজ ফাতেমা মাহমুদা দম্পতির ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন আয়েশা বেদোরা চৌধুরী। ১৯৩৫ সালের ৬ এপ্রিল কলকাতার বৈঠকখানা রােডের নানাবাড়িতে আয়েশার জন্ম। তার ডাকনাম ছিল ডােরা। আয়েশা বেদোরার পড়াশােনা শুরু কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে। এই ইনস্টিটিউশন থেকেই তিনি ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। কিন্তু তখনও তার ১৭ বছর পূর্ণ হয়নি বলে ভালাে ফলাফল নিয়েও সে বছর তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। এক বছর তিনি বি, এসসি, পড়েন। তার বয়স যখন ১৭ হয়, তখন তিনি ভর্তি হন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অব ইন্ডিয়া’তে। সেখান থেকে মাত্র ২১ বছর বয়সে গােল্ড। মেডেল নিয়ে এম. বি. বি, এস, পাস করেন ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরী। ছাত্রজীবন শেষে তার প্রথম চাকরি হয় ভারতের আসাম সরকারের অধীনে। কিন্তু বেশিদিন সেই চাকরি ভালাে লাগেনি আয়েশা বেদোরা চৌধুরী ডােরার । তাই চাকরি বদল করে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কিছুদিন ডা. জোহরা কাজীর সাথে কাজ করেন। পরে তিনি ঢাকায় অবস্থিত। ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের মেডিকেল অফিসার হিসাবে যােগ দেন। ১৯৬৮ সালে ডােরা বিয়ে করেন ইঞ্জিনিয়ার ড. আবুল বাশারকে। তারা থাকতেন মিন্টু রােডের স্টেট ব্যাংক কোয়ার্টারে। তার স্বামী ড. বাশার তখন আই, সি, আই.-এর জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। তাদের সংসারে দুই মেয়ের জন্ম হয়। 
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আয়েশা মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সরাসরি যােগাযােগ রেখেছেন ও নানাভাবে সহযােগিতা করেছেন। তিনি নিজের বাসায় মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন, তাদের চিকিৎসা করতেন। তার খালা কানিজ ফাতেমা মােহসিনার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, আয়েশা বেদোরা চৌধুরী ডােরা তখন থাকতেন ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রােডের একটি বাড়িতে, তার মা ও দুই মেয়েকে নিয়ে। ডােরার ভাই-বােনদের মধ্যে কেউই তখন দেশে ছিলেন না। ভােরা যােগাযােগ করতে শুরু করেন তার খালাত ভাই হায়দার আকবর খান রনাে ও হায়দার আনােয়ার খান জুনাের সাথে। হায়দার আনােয়ার খান জুনাে এবং তাদের বাহিনী তখন ঢাকার অদূরে শিবপুর এলাকায় যুদ্ধ করছিল। জুনাে নিয়মিত যােগাযােগ রাখতেন ভােরার সাথে, তার কাছ থেকে ওষুধপত্র আনতেন। মাঝে-মধ্যে তিনি ডেরার বাসায় গিয়ে থাকতেন। ডােরা গােপনে অনেকের কাছ থেকে টাকা এবং ওষুধপত্র সংগ্রহ করত। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্যে।
১৬ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর শােনা গেলে ডােরা সেই দৃশ্য সরাসরি দেখার জন্য তার মা, দুই মেয়ে, নানি, খালা, খালু ও আরও কয়েকজন আত্মীয়সহ নিজেদের গাড়িতে করে রেসকোর্স ময়দানের দিকে রওনা দেন। সেদিন তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, “আহা! যারা এই স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে, তারা তাে আজ আনন্দ করতে পারছে না। তাদের গাড়িটি ধানমন্ডি ১৮ নম্বরের যে বাড়িতে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা তাঁর দুই মেয়েসহ বন্দি ছিলেন, সে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই বাড়ির সামনে অবস্থানরত পাকসেনাদের দল গাড়ির ওপর গুলি চালায়। গুলিতে ডােরা এবং গাড়ির ড্রাইভার মনির আহমেদ সাথে সাথে মারা যান। খালাসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। আয়েশার খালা কানিজ ফাতেমা মােহসিনা লিখেছেন : দুটি ফুটফুটে শিশু কন্যাকে অসহায় করে ডােরা মারা গেল। ঢাকা তখন আনন্দে মুখর, উত্তেজিত। আবার একই সঙ্গে অস্ত্র জমা দিতে যাওয়ার সময় পাক আর্মিদের গুলিবর্ষণে অসংখ্য উল্লসিত মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। সেদিন হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা ছিল না।
চপল মাথায় ও আমি হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ডােরা ফিরল জীবন দান করে শহীদ নাম নিয়ে। শহীদ ডােরার লাশ আমার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডের বাড়ির ভেতরের বারান্দায় শােয়ানাে ছিল। শহরে তখন ব্ল্যাক আউট। সারারাত ডােরার পােষা কুকুর মৃত ডােরার পাশে ঠায় বসেছিল। কুকুরটাকে সেদিন সরানাে যায়নি মােটেও। পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর বেগম সুফিয়া কামাল, মিসেস সায়েম (প্রেসিডেন্ট সায়েমের স্ত্রী) এবং মিসেস হাফিজ এলেন। ডােরাকে ওনারা গােসল করালেন। মাথায় গুলি লেগে যে এক গােছা চুল উড়ে গিয়েছিল সে গােছাটা যত্ন করে তুলে রাখা হলাে। যে মেয়েটা আগের দিন বাড়ির সবাইকে নিয়ে দেশের মানুষের সাথে আনন্দ ভাগ করে নিতে চেয়েছিল, পরের দিন তার লাশ কবরস্থানে নেওয়ার মানুষ ছিল। গাড়ির ছাদের ওপর দড়ি দিয়ে বেঁধে ডােরাকে আজিমপুর গােরস্তানে নেওয়া হলাে। পরিজনদের অতি প্রিয় একটি প্রাণবন্ত, সম্ভাবনাময় প্রাণের যবনিকাপাত ঘটল। ডা. আয়েশা বেদোরা চৌধুরীর দুই মেয়ে মােনালিসা ও বেলারােসা। তারা দুজনেই ডাক্তার এবং দেশের বাইরে থাকেন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা