আহমদুর রহমান
আহমদুর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির প্রকৌশলী। তিনি দশ বছর পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির চট্টগ্রাম শাখায় বদলি করা হয়। এখানে তিনি লিয়াজো অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হলে আহমদুর রহমান তাতে জড়িয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম বন্দরে সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে অসহযােগিতায়ও তিনি যুক্ত ছিলেন। তার বাড়ি এবং অফিস ছিল ১৮ নম্বর মৌলানা মােহাম্মদ আলী রােডে, ভবনের নিচতলায় অফিস আর উপর তলায় বাসা। তিনি ওই বাড়ির ছাদে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছিলেন। এটা আশেপাশের অবাঙালিদের চোখে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আহমদুর মুক্তিযােদ্ধাদের ওষুধ, খাবার ইত্যাদি কিনে দিয়েছেন। ২৬ মার্চ নিজের অফিস ও বাসা ছেড়ে তিনি স্ত্রী ও তিন ছেলেকে শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু নিজে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে যাননি। ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের হামলার সময় রকেট লাঞ্চারের আঘাতে তাঁর বাড়ির অংশ। বিশেষ উড়ে যায়। ঘটনাক্রমে আহমদুর ও তার এক চাচা অক্ষত থাকেন। এ ঘটনার পর আহমদুর পাথরঘাটায় চলে যান। ১২ এপ্রিল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিতে যােগ দেওয়ার ঘােষণা আসলে ২১ এপ্রিল তিনি কাজে যােগ দেন। ২২ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে তাকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আহমদুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা তার আর কোনাে খোঁজ পাননি। আহমদুর রহমানের খোঁজ জানতে তারা পাকিস্তানিদের ঘনিষ্ঠ ফজলুল কাদের চৌধুরীর কাছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনাে ফল হয়নি। শহীদ আহমদুর রহমানের মৃত্যু সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায়নি।
এ. এইচ. নূরুল আলম
এ. এইচ, নূরুল আলম শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণ পাইকসা গ্রামে জন্ম নেন। তার ডাকনাম ছিল ‘মােহিত। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ১০ বছর বয়সে তাকে ঢাকায় তার মামার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকার শাহজাহানপুরে। থেকেইে তিনি পড়াশােনা করেছেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৫৬ সালে নূরুল আলম খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলসে চাকরি নেন। ১৯৭১ সালে তিনি খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলসের কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি মিল কলােনিতে বাস করতেন। সুন্দরবনের পাশে কর্মস্থল হওয়ায় তিনি শিকার করার জন্য একটি বন্দুক কিনেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকবাহিনী খুলনায় আক্রমণ করে। পাকবাহিনী মিলের। গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। নূরুল আলম নিজের বন্দুক নিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে বেরিয়ে যান। মিলের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বন্দুক ছিল। তাঁরা ২৬ জন মিলে একটি বাহিনী গড়ে তােলেন। আড়ালে লুকিয়ে থেকে তারা পাকবাহিনীকে গুলি করতে থাকেন। ভারী অস্ত্রের বিরুদ্ধে হালকা বন্দুক দিয়ে বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে অনেকেই ধীরে ধীরে পিছিয়ে যান। কিন্তু নূরুল আলম ও তার কয়েকজন সঙ্গী যুদ্ধ করতে থাকেন। তারা একটি নির্মাণাধীন বাড়ির তিনতলায় আড়াল নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন। মিলের অবাঙালি দারােয়ান পাকবাহিনীকে তাদের সন্ধান জানিয়ে দেয়। পাকবাহিনী ওই বাড়ি ঘেরাও করে তাদের সবাইকে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। এ. এইচ. নূরুল আলমের স্ত্রী রাশেদা আলম ওই সময় সন্তানসম্ভবা ছিলেন। পাকবাহিনী ও তাদের সহযােগী অবাঙালিরা মিলের ভেতর হত্যাকাণ্ড শুরু করলে তিনি সন্তানদের নিয়ে কোনােমতে পালিয়ে ভৈরব নদী পেরিয়ে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তাদের ছােট মেয়ে মুক্তির জন্ম হয়। শহীদ এ. এইচ. নূরুল আলমের সংসারে দুই মেয়ে ও এক ছেলে ছিল।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ- আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা