You dont have javascript enabled! Please enable it!
আব্দুল কাদির
আব্দুল কাদিরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২ জানুয়ারি, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মােস্তফাপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মােহাম্মদ আব্দুল হােসেন, মায়ের নাম বেগম আসতুন্নেছা । দুই ভাই ও এক বােনের মধ্যে কাদির ছিলেন দ্বিতীয়। তার পারিবারিক নাম মােহাম্মদ আব্দুল কাদির। আব্দুল কাদির রংপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আই. এসসি. পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বি. এসসি, পাস করেন। পরে তিনি বর্তমান বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউ, ও. টি. সি.’র একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আব্দুল কাদির ১৯৪৭ সালের পর পরই তৎকালীন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসাবে যােগ দেন। ১৯৪৯ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন পান এবং ১৯৬২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে ইঞ্জিনিয়ার অফিসার্স ক্যারিয়ার কোর্স-৩ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন এবং ১৯৬৬ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। লে. কর্নেল হিসাবে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনা সদর ইঞ্জিনিয়ার পরিদপ্তরে জেনারেল স্টাফ অফিসার-১ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে তকালীন ‘অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান হিসাবে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন।
বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি আব্দুল কাদিরের পূর্ণ সমর্থন ছিল। তিনি খােলামেলাভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা ছয় দফা দাবির বিষয়ে কথা বলতেন। এ জন্য পাকসেনাদের কেউ কেউ তাঁকে ‘ভাসানী” বলে ডাকত।
বাঙালিদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানােয় এক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তাকে চড় মেরে কোর্ট মার্শালের মুখােমুখি হয়েছিলেন আব্দুল কাদির। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সমর্থনে তিনি নিজের বাসা ও কর্মস্থলে কালাে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একদিন পর তিনি তাঁর সন্তানদের জন্য স্বাধীন বাংলার একটি বড় পতাকা কিনে আনেন এবং সেটি বাঁশে পুঁতে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে অবস্থিত তাঁদের কোয়ার্টারে লাগিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, নিজের গাড়িতেও তিনি লাগাতে শুরু করেছিলেন স্বাধীন বাংলার ছােট একটি পতাকা। এছাড়া, তার অফিসেও তিনি নুরুল ইসলামসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। তখন অনেকে তাকে বলেছেন, “কর্নেল সাহেব, আপনি যে এসব করছেন, দেখবেন শিগগিরই হয়তাে আপনার বিপদ হবে।” কিন্তু তিনি এসবের তােয়াক্কা করেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তেল-গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানের জন্য ব্যবহৃত বিস্ফোরক গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের সরবরাহ করেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধারা শােভাপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বিস্ফোরক ব্যবহার করে। ৭ এপ্রিলের পর তিনি গােপনে চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, সকাল ৯টার দিকে একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। একদল সেনা নিয়ে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় । তিনি আর ফিরে আসেননি। এমনকি তার লাশেরও কোনাে সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, স্বাধীনতাকামী সামরিক অফিসারদের সাথে তার গােপন যােগাযােগের খবর পাক সেনাবাহিনী জানতে পারে এবং সে কারণেই তাকে হত্যা করা হয়। লে. কর্নেল আব্দুল কাদির ১৯৫৫ সালের ১২ জুলাই বিয়ে করেন রংপুরের মেয়ে হাসনা হেনাকে। সন্তানসম্ভবা হাসনা হেনার সামনে থেকেই পাকসেনারা কাদিরকে ধরে নিয়ে যায়। হাসনা হেনা বহু কষ্টে ছােট ছেলেমেয়েদের নিয়ে আত্মরক্ষা করেন। ছদ্মনামে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ছােট ছেলের জন্ম দেন। স্বাধীনতার পর পরই রেড ক্রিসেন্ট তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের সূত্র ধরে লে. কর্নেল আব্দুল কাদিরের পরিবারকে জানিয়েছিল, “কর্নেল কাদির ওয়াজ কিল্ড ইন অ্যাকশন।” কিন্তু তারা এর পক্ষে কোনাে প্রমাণ দেখাতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত হাসনা হেনা কোনােদিনই বিশ্বাস করেননি যে তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলতেন, “আগে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাই, তারপর না হয় বিশ্বাস করব।”
স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে তার আত্মাৎসর্গের প্রতি সম্মান জানাতে তল্কালীন সরকার নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার দয়ারামপুর সেনানিবাসের নাম পরিবর্তন করে ‘কাদিরাবাদ সেনানিবাস করে, যা ইঞ্জিনিয়ার সেন্টার ও স্কুল অফ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং’ হিসাবেই বেশি পরিচিত। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে এই সেনানিবাসে ‘হােম অব স্যাপার্স’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সরকার। তাঁকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং তার নামে একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে।  দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে ২০০৭ সালে শহীদ লে. কর্নেল এম, এ, কাদিরের বড় ছেলে সাংবাদিক নাদীম কাদির চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে তার বাবার কবরস্থান চিহ্নিত করেন। পরে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ও সরকারের নির্দেশে ২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আব্দুল কাদিরের দেহাবশেষ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম থেকে নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসে নিয়ে আসা হয় এবং ‘হােম অব স্যাপার্সে’ নির্মিত স্মৃতিসৌধের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনঃসমাহিত করা হয়।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!