আবুল কালাম আজাদ
আবুল কালাম আজাদের জন্ম কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় রামকৃষ্ণপুর গ্রামে, ১ জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে। তিনি একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। ছাত্র হিসাবে তুখােড় ছিলেন আজাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতশাস্ত্রে রেকর্ড-ভাঙা নম্বর নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম, এ, পাস করেন এবং স্বর্ণপদক পান আজাদ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আজাদ ফ্লাইং অফিসারের পদমর্যাদা নিয়ে অধ্যাপক হিসাবে তঙ্কালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমিতে যােগ দেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যে পাঠানাে হয়। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তরল পদার্থ-সম্পর্কিত বলবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা, ফলিত গণিতে এম. এসসি, এবং ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের জন্যে তিনি লন্ডনের রাজকীয় (রয়্যাল) আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতি, যুক্তরাজ্যের ফলিত গণিত সমিতি এবং বােস্টনের আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতির ফেলাে নির্বাচিত হন।
বিমান বাহিনীতে তাঁর মেধা এবং কৃতিত্ব অবাঙালিরা ভালাে চোখে দেখেনি। এজন্যে তার চাকরির মেয়াদ তারা হঠাৎ শেষ করে দেয়। নিরুপায় হয়ে তিনি তখন ঢাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতির কাছে চাকরি চেয়ে চিঠি লেখেন। চিঠির উত্তরে তিনি সাক্ষাঙ্কারের সুযােগ পান এবং ১৯৫৮ সালে তিনি। সরকারি কলেজের গণিতের প্রভাষক হিসাবে যােগ দেন। আবুল কালাম আজাদ ১৯৬৮-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৭০-‘৭১ পর্যন্ত তিনি ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনােলজি টিচিং’-এ অধ্যাপনা করেন। নিখোঁজ হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি এখানে অধ্যাপনা করছিলেন। ভাষা আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আজাদ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলােতে নানা কর্মসূচিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অবরুদ্ধ ঢাকায় তিনি পরিবারসহ থেকে যেতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে না পারলেও যখনই পেরেছেন, গােপনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছেন, মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা করেছেন। অবিবাহিত আবুল কালাম আজাদ মা, চার ভাই ও চার বােনসহ থাকতেন ঢাকার আজিমপুরে।
ভাইবােনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার বাবা বেঁচে না থাকায় তিনিই ছিলেন তাঁদের অভিভাবক। অবরুদ্ধ জীবনের মধ্যে তাঁকে ভাইবােনদের আগলে রাখতে হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর সকালে আলবদর বাহিনীর পাঁচ খুনি তাদের আজিমপুরের বাসায় ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা আজাদের সামনে রিভলবার ধরে তাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে অকারণে তল্লাশি চালায়। তারপর আজাদকে বাসি মুখে ধরে নিয়ে যায়। ছােট বােনটি তখন তাদের পায়ে ধরেছিল। তার মা বার বার তাদের জড়িয়ে ধরে বলেন, “বাবা তােমরা বাঙালি, তােমরাও আমার ছেলে, ওকে তােমরা ছেড়ে দাও।” কিন্তু কেউ তার কথা শােনেনি, নরপশুরা এই নারীকে প্রতিবারই ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠে গেলে পরিবারের সদস্যরা আজাদের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়ান। আজাদের ছােট ভাই ‘ইভনিং পােস্ট পত্রিকার সম্পাদক হাবিবুল বাশার, বড় বােনের স্বামী ‘ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি’র মালিক গােলাম রসুল তার সন্ধান নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনাে ফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া গেল ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে, ড. ফজলে। রাব্বীসহ আরও কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর লাশের পাশে।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ- আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা