You dont have javascript enabled! Please enable it! আবু সাঈদ - সংগ্রামের নোটবুক
আবু সাঈদ
আবু সাঈদ পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁর জন্ম নরসিংদীর দইগাঁও গ্রামে। ১৯৪৯ সালে কৃষি দফতরে চাকরি পেয়ে তিনি রাজশাহী শহরে আসেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। তার পারিবারিক নাম মাে. আবু সাঈদ। আবু সাঈদ দৈনিক আজাদ’ ও ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত লােকসেবক’ পত্রিকার রাজশাহী প্রতিনিধি ছিলেন। সংবাদপত্র পড়তে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য তিনি নিজে কখনও হেঁটে, কখনও সাইকেলে সংবাদপত্র বিলি করতেন। রাজশাহী প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় আবু সাঈদ রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অনেকের কাছ থেকে জানা যায়, উনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় তিনি ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের পক্ষে লিখেছেন। সে সময় রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলের সংবাদ পাওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার। আর সে কারণে আবু সাঈদ রাজশাহী শহরের গােরহাঙ্গায় অবস্থিত “দৈনিক আজাদ’ সংবাদপত্র অফিসটি সকলের সংবাদ পাঠের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। # আবু সাঈদ একইসাথে ছিলেন একজন নাট্যশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ ও পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের রাজশাহী শাখার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন তিনি। এ সংস্থার রাজশাহী শাখার সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। রাজশাহীর নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠতা। টিপু সুলতান’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ’, ‘মাটির ঘর ইত্যাদি নামকরা নাটকে অভিনয় করে তিনি দেখিয়েছেন দারুণ পারদর্শিতা।
আবু সাঈদ সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের রাজশাহী স্টেশনের সঙ্গেও। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে স্বাধীনতার দাবিতে রাজশাহী উত্তাল হয়ে ওঠে। আবু সাঈদ সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে থাকেন। সে সময় তিনি পরিবার-পরিজনদের নিয়ে থাকতেন রাজশাহী পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন টিবুল এস্টেট কলােনিতে। এখানে বসবাসরত পাকিস্তানপন্থিদের রােষানলে পড়লেন সাঈদ। কিন্তু কোনাে কিছুর তােয়াক্কা না করেই তিনি তার কাজ চালাতে থাকলেন। অনেকে তাকে সীমান্ত পার হতে বললেও তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হননি। পরিস্থিতির কারণে তিনি পরিবার-পরিজনদের নিয়ে রাজশাহী শহর থেকে ৩৫ কিলােমিটার দূরে পুঠিয়ায় আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহর দখল করে নিলে পাকিস্তানপন্থি অবাঙালিরা আবু সাঈদের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কিছুদিন পর স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েন উদ্দিনের কথায় আবু সাঈদ পুঠিয়া থেকে তার পরিবারের সকলকে রাজশাহী শহরের ষষ্টিতলা এলাকায় নিয়ে আসেন। ২৮ জুন দুপুরে আবু সাঈদ বাড়িতে ভাত খাচ্ছিলেন।
এ সময় পাকিস্তানি সেনারা সেখানে গিয়ে তার স্ত্রী শামসুন নাহারকে জিজ্ঞাসা করে যে আবু সাঈদ ঘরে আছে কিনা, তাকে ইউনিভার্সিটিতে মিটিংয়ে যেতে হবে। তিনি তাদের জানান যে আবু সাঈদ ভাত খাচ্ছেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ভাত খেতে না দিয়েই ধরে নিয়ে যায়। পরের দিন ২৯ জুন সকালে পাকিস্তানি সেনারা আবু সাঈদের ছেলে বুলবুলকেও ধরে নিয়ে যায়। আবু সাঈদের স্ত্রী শামসুন নাহার তার স্মৃতিচারণে বলেছেন, স্বামী আবু সাঈদ ফিরে না আসায় এবং পরেরদিন ছেলে বুলবুলকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েন উদ্দিনের সাথে যােগাযােগ করেন। আয়েন উদ্দিন তাকে জানায় যে ব্যাপারটি উনি দেখছেন। কিন্তু তার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তিনি জামায়াতে ইসলামী কর্মী ও পাকিস্তানি সেনাদের দোসর সাংবাদিক আল-আমিনকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েন উদ্দিন তাকে বলেন যে পরেরদিন। সাঈদকে পাকিস্তানি সেনারা ছেড়ে দেবে। সন্ধ্যার সময় ছেলে বুলবুল জীবিত ফিরে এলেও ফিরে আসেননি আবু সাঈদ।
শহীদ আবু সাঈদের ছেলে বুলবুল তার স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, পাকিস্তানি সেনারা তাকে বাড়ি থেকে ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসাররা উর্দুতে তার বাবা সম্পর্কে জানতে চায়। বুলবুল উর্দু জানতেন। বুলবুল তাদের জানালেন যে তার বাবা আওয়ামী লীগ করেন না, কোনাে কিছু করেন না। তখন ওই অফিসাররা একটি ফাইল বের করে সভামিছিলের ছবিতে কালাে ব্যাজ পরা তাঁর বাবাকে দেখিয়ে বলল, এটা তাহলে কে? এ সময় তিনি তাদের কোনাে উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি পাশের ঘর থেকে আসা ভয়াবহ চিকার শুনে বুঝতে পারলেন সেখানে চলছে নির্যাতন। তার বাবাকে কোনােভাবে দেখা যায় কিনা, সে চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। একজন বালুচ অফিসার কৌশলে নিজের জিম্মায় বুলবুলকে সন্ধ্যার আগে রাজশাহী। শহরের বােয়ালিয়া থানায় এনে ছেড়ে দিলে বুলবুল বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু অনেক অপেক্ষার পরও তার বাবা ফিরে আসেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শােনা গেল যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকের লাশ। পাওয়া গিয়েছে। সেখানে গেলে আবু সাঈদের লাশ পাওয়া যাবে, এই আশায় শামসুন নাহার সেখানে গিয়ে খুঁজেও স্বামীর লাশ পাননি। পাকিস্তানিদের হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া একজনের দেওয়া তথ্যে তারা জানতে পারেন, পাকবাহিনী ৫ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রেললাইনের ধারে আবু সাঈদকে হত্যা করে গর্তে ফেলে মাটিচাপা দিয়েছে। সংবাদপত্র থেকেও তারা এমন তথ্য পেয়েছেন। তৎকালীন রাজশাহী পৌরসভা কর্তৃপক্ষ আবু সাঈদের স্মরণে রাজশাহী শহরের ষষ্টিতলা এলাকার একটি রাস্তার নামকরণ করে। ১৯৯৫ সালে ডাকবিভাগ প্রকাশ করেছে তার প্রতিকৃতি সম্বলিত ডাকটিকিট। সাংস্কৃতিক কর্মীরা একসময় রাজশাহী পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনের সামনের উন্মুক্ত মঞ্চটি তার নামে নামকরণ করেছিলেন। মঞ্চটি এখন আর নেই। শহীদ আবু সাঈদের স্ত্রী শামসুন নাহার, ছেলে বুলবুল, সামিউল আজাদ ও সামসুদ্দিন মিন্টু এবং মেয়ে লাকি।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা