You dont have javascript enabled! Please enable it!
আবদুল ওয়াহাব তালুকদার
১৯৪৩ সালের ৩ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক করদ রাজ্য কুচবিহারের অন্তর্গত দিনহাটা মহাকুমার। কালমাটি গ্রামে জন্ম নেন আবদুল ওয়াহাব তালুকদার। বাবার নাম ছামান আলী তালুকদার। পাঁচ ভাই এক বােনের মধ্যে ওয়াহাব ছিলেন চতুর্থ। ছাত্র হিসেবে ওয়াহাব মেধাবী ছিলেন। ১৯৫০ সালের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ওয়াহাবের পরিবার বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার সিংঝাড় গ্রামে চলে আসে। তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। এর কিছুদিন পর তার বাবা মারা যান। ১৯৫৮ সালে তিনি ভুরুঙ্গামারী পাইলট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬২ সালে ডিগ্রি পাস করেন ওয়াহাব। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এম. এ. পাস করেন। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ওয়াহাব তালুকদার পড়াশােনা শেষ করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। ১৯৬৫ সাল থেকে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বর্তমান কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। আবদুল ওয়াহাব ছিলেন ক্রীড়ামােদী এবং সংস্কৃতিমনা। কুড়িগ্রামের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিল। স্থানীয়ভাবে তিনি একজন ভালাে খেলােয়াড় হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি নিয়মিত কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে টেনিস খেলতেন। ভলিবল, ফুটবল ও ক্যারামেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছাত্রদের সাথেও খেলাধুলার জন্য মাঠে নামতেন। তিনি প্রতিদিন ক্লাবে যেতেন এবং অবসর সময়ে বই ও পত্রিকা পড়তে ভালােবাসতেন। ছােট থেকেই মাছ ধরার প্রচণ্ড নেশা ছিল।
ওয়াহাবের তাই শিক্ষকতা করা অবস্থাতেও প্রায়ই গ্রামে গিয়ে মাছ ধরতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওয়াহাব তাতে যােগ দেন। ১ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত ৬ নম্বর। সেক্টরের অধীন বামনহাট যুব শিবিরে প্রশিক্ষণ নেন ওয়াহাব। পরবর্তীতে তিনি  বামনহাট যুব শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যাচাইয়ের মাধ্যমে যুবকদেরকে যুব শিবিরে ভর্তি করাতেন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এম. কে. আবুল বাশার (বীর উত্তম), যিনি পরে বিমান বাহিনীর প্রধান। হয়েছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে ওয়াহাব মুক্তিযােদ্ধাদের দেখাশােনা এবং তাদের খাবার, রেশন ইত্যাদি পরিচালনা করতেন, তাঁদের নানা পরামর্শ দিতেন। আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের শহীদ হওয়ার ঘটনা জানা যায় তার ছেলে মাে. মিজানুর রহমান তালুকদারের লেখা থেকে : (ওয়াহাব) অন্যান্য দিনের মতাে ৭ আগস্ট ১৯৭১ ঘুম থেকে উঠে আনুমানিক সকাল ৯টায় সামান্য নাশতা খেয়ে বাইরে কিছু লােকের সাথে কথা বলেন এবং কর্মস্থল বামনহাটের দিকে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে তাঁর বড় ভাই আব্দুস সামাদ তালুকদারের সাথে দেখা হয় এবং বলেন, “আমি বামনহাট থেকে ঘুরে আসি।” তার ভাই তাকে যেতে নিষেধ করলেও সে কথা শােনেননি ওয়াহাব। বামনহাট থেকে কয়েকজন সহকর্মী আবুল কাশেম মাস্টার, ডা. মুজিবর রহমান, ভারতের আব্দুল হামিদ পঞ্চায়েতসহ সিংঝাড় গ্রামে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত বগনী-ব্রিজে অবস্থানরত একদল মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে আলােচনা করেন। এমন সময় মুক্তিযােদ্ধারা বলেন, “স্যার আমরা এখনও ভাত খাইনি, পাশের বাড়িতে ভাত রান্না করতে দিয়েছি, এখুনি নিয়ে আসব।” বাবা তাদের ভাত খাওয়ার অনুমতি দেন এবং ফরহাদ নামক এক তরুণকে পাহারা রাখেন। বেলা তখন বিকেল। রেললাইনটি তখন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল।
এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একদল সিপাই রেললাইনের পাশ দিয়ে এসে অতর্কিত আক্রমণ করে। পাহারারত ছেলেটি চিঙ্কার দেওয়ার সাথে সাথে ব্রাশফায়ারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধা দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযােগ তারা পায়নি, ফলে পিছু হঠতে বাধ্য হন। ইতােমধ্যে বৃষ্টির মতাে গুলির শব্দে এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। বাবার অন্যান্য সঙ্গী তাঁকে সােজা রেলপথে না গিয়ে অন্যদিকে যেতে বললেও তিনি কর্ণপাত করেননি। তিনি সােজা দৌড়াতে থাকেন। লম্বা এবং সুঠাম দেহের অধিকারী এই বত্রিশ বছরের টগবগে যুবকটিকে দেখেই পাকবাহিনীর দলটি তাকে লক্ষ করে ব্রাশফায়ার করতে থাকে। সম্ভবত এক পর্যায়ে বাবার পায়ে গুলি লাগে। ফলে আহত অবস্থায় জঙ্গলে আত্মগােপন করেন। নরপিশাচের দলটি বাবাকে অতিক্রম করে আরও ভিতরে ঢুকে পড়ে। তিনি ততক্ষণে তার প্রাণপ্রিয় বাংলা এবং বাঙালির জন্যে জীবন উৎসর্গ করে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে এসেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে বাবা বুলেটে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে উহ! আহ! শব্দে কাতরাচ্ছিলেন। শব্দ শুনে রক্তপিপাসু দলটি তাকে ধরে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র পেয়ে হয়তােবা আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং তার হাতের ঘড়ি ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে নেয়। আর সে আক্রোশেই বুকসহ দেহের বিভিন্ন অংশে বেয়ােনেটের খোঁচায় ঝাঝরা করে দেওয়া হয়। তখন তার পরনে ছিল লুঙ্গি এবং শার্ট। হানাদাররা রক্তাক্ত দেহটিকে পার্শ্ববর্তী একটি ডােবায় ফেলে চলে যায়।
(স্মৃতি ২ ৭১, অষ্টম খণ্ড) ওয়াহাবের শহীদ হওয়ার সংবাদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন শহীদের মা সালমা বেগম এবং স্ত্রী বেগম মেরুন্নাহার। প্রচণ্ড গােলাগুলির কারণে ওয়াহাবের মরদেহ বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়নি। তাঁর ভাইয়েরা এলাকাবাসীর সহযােগিতায় ভারতের বগনী নদীর কিনারে অবস্থিত কালিমাটি মসজিদ চত্বরে তাকে সমাহিত করেন। যতদিন পর্যন্ত সীমান্তে কাটাতারের বেড়া ছিল না ততদিন পর্যন্ত অধ্যাপক ওয়াহবের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার লােকজন তার কবর জিয়ারত করতে পারতেন। কিন্তু সীমান্তে কাটাতারের বেড়া দেওয়া এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার ফলে এখন ওয়াহাবের আত্মীয়-স্বজন আর তার কবরে যেতে পারেন না। তার মরদেহ বাংলাদেশে আনাও সম্ভব হয়নি। মাে. মিজানুর রহমান তালুকদার আরও লিখেছেন : কুড়িগ্রামে শহীদ ওয়াহাব রােড, কলেজে ওয়াহাব ছাত্রাবাস দেখে যেমন গর্ববােধ। করি, দেশের সার্বিক চিত্র দেখে তেমনি অন্যান্য শহীদ সন্তানের মতােই কষ্ট বেড়ে যায়।  শহীদ আবদুল ওয়াহাব তালুকদারের স্ত্রীর নাম বেগম মেরুন্নাহার। তাঁদের সংসারে তিন ছেলে- মিজানুর রহমান তালুকদার, শামীম ও স্বপন।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!