You dont have javascript enabled! Please enable it!
আবদুল আলীম চৌধুরী
চক্ষু বিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে (বাংলা ১৩৩৫ সালে ৩ বৈশাখ), কিশােরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার খয়েরপুর গ্রামে। বাবা আবদুল হেকিম চৌধুরী। ছিলেন জেলা স্কুল পরিদর্শক, মা সৈয়দা ইয়াকুতুন্নেছা গৃহিণী। তিন ভাই ও এক বােনের মধ্যে আলীম ছিলেন তৃতীয়। তার পারিবারিক নাম আবুল ফয়েজ মােহাম্মদ আবদুল আলীম চৌধুরী, ডাকনাম টুনু। ছােটবেলা থেকেই অসম্ভব জেদি ছিলেন আলীম চৌধুরী। তার জেদের কাছে। কড়া মেজাজের লােক হেকিম চৌধুরীরও হার হয়েছিল। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত খয়েরপুরের গ্রামের স্কুলেই পড়েছেন আলীম। পরে ভর্তি হন কিশােরগঞ্জ হাই স্কুলে। চাচাত বােনের বাড়িতে থেকে তাকে পড়াশােনা করতে হতাে। কিন্তু ব্যাপারটা আলীমের মনে ধরেনি। এক সময় বেঁকে বসলেন তিনি। বাবাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া তিনি করবেন না। বাধ্য হয়ে বাবা তাকে টাকা-পয়সা বাড়িয়ে দিলেন, যাতে তিনি নিজের মতাে থাকতে পারেন। কিন্তু যে টাকা মাসিক বরাদ্দ দিলেন, তাতে চলছিল না। খরচের টাকা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জিদ ধরলেন তিনি। বাবাকে বললেন, না হলে পড়ালেখা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ করবেন। আবারও ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হলাে বাবাকে।
আবদুল আলীম ১৯৪৫ সালে কিশােরগঞ্জ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৪৮ সালে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই, এসসি. পাস করেন। এই দুই পরীক্ষায়ই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এরপর ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. বি, এস, এবং ১৯৬১ সালে লন্ডন থেকে ডি. ও. ডিগ্রি লাভ করেন। ছবি তােলা ও লেখালেখির শখ ছিল আবদুল আলীম চৌধুরীর। ছাত্রজীবনে ১৯৪১-৪২ সালে মাসিক পত্রিকা ‘খাপছাড়া’, ১৯৫২-৫৩ সালে মাসিক ‘যাত্রিক নামে দুটি প্রগতিশীল মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এছাড়া তিনি দৈনিক ইত্তেহাদ’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল জার্নালের সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। কিশাের বয়স থেকেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আবদুল আলীম চৌধুরী। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সফল করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। এজন্য ১৯৫৩ সালে তাকে কারাবরণ করতে হয়। এরপর ১৯৫৪-‘৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন আলীম। ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসােসিয়েশনের (তত্ত্বালীন পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসােসিয়েশন) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পরে ১৯৬৭ সালে তিনি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় তিনি জোরালাে ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯ সালে ‘ইস্ট পাকিস্তান অপথালমােলজিক্যাল সােসাইটির সাধারণ সম্পাদক হন আলীম চৌধুরী।
আলীম চৌধুরী তার কর্মজীবনে বহু জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের সেন্ট জেমস হাসপাতালের রেজিস্ট্রার (১৯৬১১৯৬৩), মীর্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের প্রধান চক্ষু চিকিৎসক (নভেম্বর ১৯৬৩ থেকে অক্টোবর ১৯৬৫), ঢাকার পােস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চক্ষু বিভাগের সহযােগী অধ্যাপক (জুন-ডিসেম্বর ১৯৭০), ঢাকা মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের সহযােগী অধ্যাপক (জানুয়ারি ১৯৬৮ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৭০), রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের সহযােগী অধ্যাপক (জুন-অক্টোবর ১৯৭১) এবং ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহযােগী অধ্যাপক (নভেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১)।
১৯৬৩ সালে লন্ডন থেকে ফিরে টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালে চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসাবে যােগ দিয়েছিলেন আলীম। শ্যামলী তখন মাস্টার্সে পড়াশােনার পাশাপাশি টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হােমসে শিক্ষকতা করছেন। আলীমের যােগ দেওয়ার বিষয়টি ভারতেশ্বরী হােমস ও কুমুদিনী হাসপাতালের লােকজনের কাছে একটা আলােচনার বিষয় ছিল। শুনতে শুনতে ডাক্তার আলীম সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে ওঠে শ্যামলীর মনে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫- দুই বছরে দুজনের মধ্যে জানাশােনা হয়। ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে ঢাকায় চলে আসেন আলীম। এরপর দুজনের মধ্যে চিঠিপত্রে ভাব বিনিময় আরও নিবিড় হয়। পারস্পরিক বােঝাপড়ার এক পর্যায়ে আলীমকে বিয়ে করতে রাজি হন শ্যামলী। দুজনের মধ্যে ছিল ধর্মীয় ব্যবধান। সে বাধাও পার হন তারা।
শ্যামলীর বাবার পরিবার অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল শ্যামলীর ওপর। বিয়ের পর শ্যামলীর ভাইবােন ও বাবা-মাকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় নিজেদের আজিমপুরের বাসায় নিয়ে আসেন তারা নিজের বাবা-মা ও ভাইবােনকে যেমন ভালােবাসতেন, শ্যামলীর বাবা-মা ও ভাইবােনকেও তেমনি ভালােবাসতেন আলীম। ১৯৭১ সালের কিছু আগে আজিমপুরের বাসা ছেড়ে পরিবারসহ পুরানা পল্টনের একটি তিনতলা বাড়িতে এসে উঠেছিলেন আলীম চৌধুরী। দুই ও তিনতলায় থাকার ব্যবস্থা, আর নিচতলায় ক্লিনিক। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে একদিন সকাল ১০টার দিকে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। এরকম বৃষ্টির মধ্যেই প্রতিবেশী মতিন সাহেব (যিনি তঙ্কালীন রাজনৈতিক দল পিডিপি’র সদস্য ছিলেন) পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা মান্নানকে নিয়ে এলেন আলীমের কাছে। মতিন সাহেব বললেন, “এই ভদ্রলােক পরিবার নিয়ে অত্যন্ত বিপদে পড়েছেন। তার গ্রামের ঘরবাড়ি কে বা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। একেবারেই নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছেন। এই মুহূর্তে তাকে আশ্রয় না দিলে ভদ্রলােক খুবই অসুবিধায় পড়বেন।” বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করতে গেলে শ্যামলী এক কথায় না করে দিলেন। কিন্তু মতিন ও মান্নানের কাকুতি-মিনতি শুনে আবার উপরে উঠে এলেন আলীম। এবার নিজের মাকে অনুরােধ করলেন শ্যামলীকে রাজি করানাের জন্য। শাশুড়ির অনুরােধ ফেলতে পারলেন না শ্যামলী।
অনুমতি পেয়ে মান্নান স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এক কাপড়ে উঠে এলেন বাড়িটার একতলায়। ক্লিনিকের রােগীদের বিছানা-চাদর পাল্টে তাদের থাকতে দিলেন আলীম। ক্লিনিক তাে বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। এবার চেম্বারটিও সরিয়ে আনা হলাে নিচতলা থেকে দোতলায়। চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত মান্নানের পরিবারের খাবার ব্যবস্থা করলেন আলীম। সপ্তাহখানেকের মাথায় মান্নানের ঘরগুলাে জিনিসপত্রে ভরে উঠতে লাগল। আগে বলেছিল কিছুই নেই, সব জ্বালিয়ে দিয়েছে কিন্তু এই লােকটা এই কয়েকদিনের মধ্যে এত এত আসবাবপত্র পাচ্ছে কোথায়? সন্দেহ বাড়ছিল আলীম ও শ্যামলীর। দশবারাে দিনের মাথায় সব জানা গেল। তারা তখন বুঝতে পারলেন কী বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই লােকটা আলবদর বাহিনীর সংগঠক, স্বাধীনতাবিরােধীদের নেতৃস্থানীয় একজন। তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী।
সব জেনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন আলীম। সিদ্ধান্ত নিলেন, অন্য কোথাও সরে যেতে হবে। বাড়ি খোজাও চলছিল। চুপিসারে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন তারা। এদিকে সারারাত মাওলানার বাসায় দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস আর পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হৈ-হল্লা লেগেই আছে। পালিয়ে যাওয়ারও কোনাে উপায় পাচ্ছিলেন না। এর মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধাদের একটা চিঠি এল মান্নানের কাছে। চিঠিতে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে : “আলীম ভাই ওপরে না থাকলে তােকে কবেই বােমা মেরে উড়িয়ে দিতাম।” এরপর থেকেই আলীম চৌধুরীর বাসার নিচতলার সিড়ি দরজার বাইরে দুজন আলবদর দিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারা বসানাে হলাে। ব্যাপারটা যাতে আলীমের পরিবার বুঝতে না পারে, সেজন্য মান্নানের গেটেও পাহারায় ছিল আরও চার-পাঁচজন। মনে মনে দুরভিসন্ধি থাকলেও মুখে সবসময় আলীম চৌধুরীর সঙ্গে ভালাে ব্যবহার করত মান্নান। দেখা হলেই বলে, “ডাক্তার সাহেব, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলব না। আপনার কোনাে ভয় নাই। আপনার কোনাে বিপদ হবে না। যদি কখনও কোনাে অসুবিধায় পড়েন, সােজা আমার কাছে চলে আসবেন। আমি আপনাকে রক্ষা করব। আমার জীবন থাকতে আপনার কোনাে ক্ষতি কেউ করতে পারবে না।”
১৫ ডিসেম্বর। বিকেল তখন সাড়ে ৪টা। শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। পুরানা পল্টনের বাসার দোতলার বারান্দায় স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে বসেছিলেন আলীম চৌধুরী। ভারতীয় বােমারু বিমানগুলাে বােমা ফেলছে হানাদার পাকিস্তানিদের ঘাটিগুলােতে। এসব দেখে আনন্দে-উত্তেজনায় টগবগ করছিলেন আলীম। বলছিলেন, “এদেশের পাকিস্তানিরা বােকার স্বর্গে বাস করছে। ভারতীয় বিমানগুলােকে বাধা দেওয়ার কোনাে ক্ষমতাই তাদের নেই। দেখাে, দেখাে, বিমানগুলাে ইচ্ছেমতাে বােমা ফেলছে। আর এখনও মাওলানা মান্নানের মতাে পাকিস্তানিরা বলে কিনা আমেরিকা তাদের রক্ষা করবে। সপ্তম নৌবহর নাকি এসেছে।” বলেই প্রাণখুলে হাসলেন তিনি। অনেক দিন অনিশ্চতায়-আশঙ্কায় এই হাসি তিনি হাসতে পারেননি। আজ তিনি নিশ্চিন্ত। হাসতে হাসতেই বললেন, “দেখাে, আর দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা স্বাধীন হয়ে যাব।”
এমন সময় একটা গাড়ির শব্দে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কাদা মাখানাে একটা ছােটখাটো মাইক্রোবাস এসে নিচতলায় মাওলানা মান্নানের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার কাছে এ রকম মাইক্রোবাস প্রায় প্রতিদিনই আসে। এ ধরনের মাইক্রোবাস যতবার এসে গেটে দাঁড়ায়, ততবারই একটা আশঙ্কা হয়। আলীম মাইক্রোবাসটা দেখে বললেন, “উকিঝুঁকি দিও না। ভেতরে যাও।” বলে তিনি বাথরুমে ঢুকলেন আর তার স্ত্রী ও শাশুড়ি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। এর প্রায় ৪৫ মিনিট পর তাদের সিঁড়ির নিচের দরজার বেল বাজল। আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ওপর থেকেই দেখলেন, বন্দুক উঁচিয়ে দুজন আলবদর দরজা খুলতে বলছে। কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না শ্যামলী। স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করব?” অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলীম বললেন, “খুলে দাও।” বলেই তিনি নিচের তলায় মাওলানা মান্নানের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। শ্যামলী জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাচ্ছ?” তিনি বললেন, “মাওলানা সাহেবের কাছে। তিনি তাে কোনাে অসুবিধা হলেই যেতে বলেছেন।”  আলীম সিড়ি দিয়ে নেমে মান্নানের দরজায় টোকা দিলেন। ভেতর থেকে কেউ কোনাে সাড়া দিল না। আলীম এবার একটু জোরে আঘাত করতে করতে বললেন, “মাওলানা সাহেব, দরজাটা খুলুন, দরজাটা খুলুন। এবারও ভেতর থেকে কোনাে সাড়াশব্দ এল না। এবার প্রাণপণে দরজায় আঘাত করতে করতে মাওলানা মান্নানকে ডাকলেন তিনি। অনেকবার ডাকার পরও মান্নান দরজা খুলল না। ভেতর থেকে শুধু একবার বলল, “ভয় পাবেন না। আপনি যান। আমি আছি।” আলীম চৌধুরী তখন দৌড়ে ওপরে উঠতে যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে বন্দুকধারী আলবদররা ভেতরে ঢুকে গেছে। আলীম চৌধুরী বলার পর বাসার কাজের ছেলে হাকিম ও মােমিন দরজা খুলে দিয়েছিল। বন্দুকধারীরা তাঁকে দৌড়ে ওপরে উঠতে দেখেই বলল, “হ্যান্ডস আপ! আপনি আমাদের সাথে চলুন।”
তিনি জানতে চাইলেন, “কেন? আপনাদের সঙ্গে যাব কেন?” ওরা বলল, “দরকার আছে। খুবই জরুরি দরকার।” তিনি বললেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। ভেতর থেকে কাপড়চোপড় পাল্টে আসি।” ওরা বলল, “না, না, অন্য কাপড়ের দরকার নেই।” বন্দুকধারীরা কথা বলছিল শান্তভাবেই। তবে তাদের কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। আলীম চৌধুরী তাদের কাছে জানতে চাইলেন, “তা কোথায় যেতে হবে আমাকে?” ওরা বলল, “সেটা গেলেই জানতে পারবেন। চলুন।” আলীমকে নিয়ে বন্দুকধারীরা গেটের বাইরে যেতেই দৌড়ে দোতলায় উঠে এল হাকিম আর মােমিন। শ্যামলীকে বলল, “সাহেবকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে।” | শ্যামলী এতদিনেও মান্নান লােকটার সাথে কোনাে কথা বলেননি। কোনােকিছু ভেবে না পেয়ে ছুটে তার কাছেই গেলেন। দরজায় কয়েকবার আঘাত করে ডাকতেই ভেতর থেকে সাড়া দিল মান্নান। দরজা খুলে দিল সে। মান্নান এই ফাকে একটু যেন দেখেও নিল, তার স্যাঙ্গাতরা ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে কিনা। শ্যামলী মান্নানের সামনে কাতর অনুনয়ে ভেঙে পড়লেন : “মাওলানা সাহেব, গাড়িটা এখনও ছাড়েনি। আপনি একটু দেখুন। দয়া করে ওদের বলুন, ওকে যাতে ওরা ছেড়ে দেয়।” মান্নান শ্যামলীর অনুনয় শুনছিল না। সােফায় বসতে বসতে সে বাইরের দিকে কান পেতে ছিল। এ সময় মাইক্রোবাস ছাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। গাড়ির শব্দে কান্না আর ধরে রাখতে পারলেন না শ্যামলী। গাড়ি ছাড়ার শব্দে নিশ্চিত হয়েই যেন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেল মান্নান। বলল, “অস্থির হবেন না। ওরা আমার ছাত্র। ওরাই ওনাকে নিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার রাব্বীকেও নিয়ে গেছে।”
ডাক্তার ফজলে রাব্বীর নাম শুনে শ্যামলী বললেন, “কেন নিয়ে গেছে? কোথায় নিয়ে গেছে?” মান্নান বললেন, “নিয়ে গেছে সি. এম. এইচ.-এ (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল)।” মান্নানের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে দোতলায় ফিরে এলেন শ্যামলী। অনেক চেষ্টার পর ফোনে পেলেন ডা. ফজলে রাব্বীর স্ত্রী জাহানারাকে। জাহানারা রাব্বী বললেন, “চারটার দিকে ডাক্তার রাব্বীকেও নিয়ে গেছে।” কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বললেন, “ওরা কি আর ফিরবে?” জাহানারার কথায় আঁতকে উঠলেন শ্যামলী। দ্রুত ফোন রেখে আবার ছুটে গেলেন মান্নানের কাছে। এবার সরাসরি জানতে চাইলেন, “আপনি আমাকে সঠিক খবর দিন, ও কোথায় আছে?” শ্যামলীর কাছ থেকে এ রকম সােজাসাপ্টা প্রশ্ন শুনে খানিকটা মিইয়ে গেল মান্নান। বলল, “ভাবি সাহেব, এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। বললাম তাে, চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেছে। কাজ শেষ হলেই দিয়ে যাবে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সাথে আমার কথা হয়েছে।” মান্নানের কথায় শ্যামলী যেন আবার একটু আশ্বাস পেলেন। বললেন, “শীতের কাপড় নেয়নি। ওগুলাে তাহলে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিন।” মান্নান বলল, “সে ব্যবস্থা ওরাই করবে।”
পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন খুঁজেও আলীমের কোনাে সন্ধান পাওয়া যায়নি। শ্যামলী বাসার কাজের ছেলেদের পাঠিয়েছিলেন গেন্ডারিয়ায় আলীমের ছােট ভাই আবদুল হাফিজ চৌধুরীর কাছে। রাস্তায় এলােপাতাড়ি গুলি চলার কারণে তারা যেতে পেরে ফিরে এল। আলীমকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা এলেন। আলীমের খবর জানতে। তারা জানতে চাইলেন, “মাওলানা মান্নান কোথায়?” বিপদ বুঝতে পেরে তাদের খাবার ঘরে এসে লুকিয়েছিল মান্নান। কোনাে এক সুযােগে। সেখান থেকেও পালিয়ে গেছে মান্নান, কেউ তা খেয়াল করেনি। মান্নানকে খুঁজে না। পেয়ে ফিরে গেল মুক্তিযােদ্ধারা। ১৭ ডিসেম্বর হাফিজ এসে গাড়ি নিয়ে খুঁজতে বেরােলেন। ভাইয়ের খোঁজ জানার জন্য মান্নানকে খুঁজছিলেন তিনি। খুঁজতে খুঁজতে আজিমপুরের এক বাসায় মান্নানকে পেলেন। লােকজন তাকে পিটিয়ে মেরেই ফেলতে চাচ্ছিল। হাফিজ ভাবলেন, মেরে ফেললে অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে। সব খোজখবর জেনে নিয়ে পরে মারতে হবে। মান্নানকে তিনি রমনা থানায় সােপর্দ করলেন। এই মাওলানা মান্নান পরে ছাড়া পেয়ে যায়। 
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। রায়েরবাজারের ইটখােলার বধ্যভূমিতে অনেক মৃতদেহের সন্ধান মিলেছে। লােকজন সেখানে খুঁজছে তাদের হারানাে স্বজনের মৃতদেহ। হাফিজও ভাইকে খুঁজতে গিয়েছিলেন সেখানে। সাথে ছিল পারিবারিক বন্ধু এরশাদ এবং আলীমের বাসার কাজের লােক হাকিম ও মােমিন। পাকিস্তানি বর্বর হানাদার আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের নারকীয় হত্যাকাণ্ড এতই বীভৎস যে সহজে কোনাে মৃতদেহ শনাক্ত করা যাচিছল না। অনেকক্ষণ সেসব মৃতদেহের ভিড়ে ঘুরে ভাইকে পেলেন না হাফিজ, বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে ফিরে আসতে যাচ্ছিলেন। আলবদররা। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আলীমের পরনে ছিল শার্ট আর লুঙ্গি। গায়ে শার্ট ও লুঙ্গি, উবু হয়ে পড়ে থাকা একটি মৃতদেহ দেখে সন্দেহ হয় সঙ্গী এরশাদের। তিনি হাফিজকে ডেকে মৃতদেহটি দেখতে বলেন। হাত দুটো পিছমােড়া করে বাঁধা। ছড়ানাে ছিটানাে ইটের ওপর মৃতদেহটি পড়ে আছে। চারপাশে শুকিয়ে আসা ছােপ ছােপ রক্ত। কাছে গিয়ে মৃতদেহের মুখের দিকটি তুলে ধরলেন হাফিজ। আর কোনাে সন্দেহ রইল না, এটাই তার প্রাণপ্রিয় ভাই। বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তলপেট ও কপালের বাঁ দিকে বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন। ১৮ ডিসেম্বর আজিমপুর গােরস্তানে তার বাবার কবরেই পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী শ্রেণিহীন, শােষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী উদয়ন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাদের দুই মেয়ে, দুজনই চিকিৎসক।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!