২৩ এপ্রিল ১৯৭১ রাজশাহী
উত্তর বঙ্গে ১৬ ডিভিশন মোতায়েন সম্পন্ন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীর গোদাগাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে পাকবাহিনী প্রচণ্ড হামলা চালায়। এ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করে। আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি চিঠি সহ পাক বাহিনী প্রচুর ভারতীয় অস্র আটক করে। রাজশাহী থেকে সড়কপথে পাকবাহিনীর একটি কনভয় ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় নওগাঁ প্রবেশ করে। নওগায়ে ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করা হয়।
মেজর জেনারেল এম.এ. রব
মুক্তিযুদ্ধের যে কয়েকজন বীর সৈনিক চির উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো প্রস্ফুটিত আব্দুর রব এদের একজন। ১৯১৯ সালে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার খাগাউড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল রবের।
শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চাকুরী নিয়োগ সংস্থা কর্তৃক সেনাবাহিনীতে কমিশনার পদের জন্য নির্বাচিত হন এবং পরের বছর ডি.টি.এস হতে ট্রেনিং সমাপ্তির পর তিনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিয়মিত কমিশন অফিসার হিসেবে যোগ দেন। কাবুল মিরাট, দিল্লী ঐতিহাসিক লাল কেল্লা এবং কুমিল্লা সেনানিবাসে বিভিন্ন সামরিক ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও তার ভূমিকা বীরত্বপূর্ণ ছিল। বিশ্বযুদ্ধে রব বার্মার আরাকান সীমান্তে সরাসরি রণক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি ২৬ নং ব্রিটিশ-ভারতীয় সামরিক ডিভিশন সৈন্য দলের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। জাপানের পতনের পর তার সেনাবাহিনী সহ যুদ্ধক্ষেত্র হতে বাঙ্গালোর ফিরে আসেন। কিছুদিন পর এই সামরিক ডিভিশন দখলদার বাহিনী হিসেবে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানো হলে তিনিও সেখানে যান। দখলদার বাহিনীর ইউনিট কমান্ডে কৃতিত্বের পরিচয় দিলে তাকে সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রমোশন দেয়া হয়। ইন্দোনেশিয়া হতে ফিরে আসার পর ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত দিল্লী সেনানিবাসে অবস্থান করেন। ভারত বিভাগের পর দিল্লীতে অবস্থান করে ভারতে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত থাকেন। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে তিনি তার বাহিনীসহ পাকিস্তানের লাহোরে চলে আসেন এবং ৮৫ হাজার অমুসলমান শরণার্থীদের অবরুদ্ধ এলাকা হতে উদ্ধার করে বিশেষ ট্রেনযোগে তাদের ভারতে পাঠান। শরণার্থী সমস্যা সমাধানের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এডজুটেন্টের পদে বহাল করে তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠানো হয়। ভারত বিভাগের পর তিনি স্টাফ মেজর, ডেপুটি এসিণ্ট্যোন্ট এডজুটেন্ট, লেঃ কর্ণেল, কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে চট্টগ্রাম এমবারকেষন কমান্ডেন্ট পদে নিযুক্ত থাকাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকুরী হতে অবসর গ্রহণকরেন।
চাকরি জীবন থেকে অবসর নেয়ার পরে সেনা ছাউনীর নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে তিনি জনতার কাতারে আসতে রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা বক্ত করেন। আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক জীবনের অভিষেক ঘটান। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নিবাচনে বৃহত্তর সিলেটের বানিয়াচং, নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা হতে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা তাকে বিক্ষদ্ধ করে তোলে। তিনি নিজ উদ্যোগে হবিগঞ্জ শ্রীমঙ্গল এলাকায় নিজস্ব বাহিনি তৈরি করে পাক বাহিনির সাথে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাইয়া যান। তার এলাকায় পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আগরতলা চলে যান। পরে তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরে যান। ১৯৭১ সালে মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর তাকে সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে নিয়োগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে ইষ্টার্ণ জোন(১-৪ নং সেক্টর) পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের হেড কোয়ার্টারের একটি অংশের পুরো দায়িত্ব পালন করেন এবং ভারতের আগরতলায় তাঁর কর্মস্থল স্থাপন করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ৭ মে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য ভারতের ালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন। ডিসেম্বর মাসে জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী, মিত্র বাহিনীর লিয়াঁেজা অফিসার ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌঃ, মোস্তফা আল্লামা এবং সর্বাধিনায়কের এডিসি শেখ কামাল সহ হেলিকপ্টারে সিলেট রণাঙ্গণ পরিদর্শণে যাওয়ার পথে অন্যান্যের সাথে এই বীর সেনানী অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। পাক বাহিনী এই হেলিকপ্টারকে গুলি করলে ভিতরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং হেলিকপ্টারটি অল্পের জন্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। দেশে স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল সেনাবাহিনীর চীপ অফ স্টাফ পদ হতে পদত্যাগ করেন। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে প্রদান করেন। সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহণের পর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অবৈতনিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হন।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন এবং ইংল্যাণ্ড ও ইতালী সফর করেন। প্রচারবিমুখ এম এ রব (বীর উত্তম) মারা গেছেন নিভৃতে এবং প্রায় বিনা চিকিৎসায়; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার কিছু দিন পর। ১৫ আগস্টের পর ইতিহাসের আরেক শোকাবহ ঘটনা ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার কযেক দিন পর ১৪ নভেম্বর। তাঁর মৃত্যুর খবর তখন ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষজন ছাড়া দেশের মানুষ জানতেই পারেননি। চিরকুমার এম এ রবকে সমাহিত করা হয় হবিগঞ্জ শহরের খোয়াট নদের তীরে এক নিভৃত স্থানে।
জিয়াউর রহমান বীরউত্তম এর ৭১ এর ৯ মাস
অপারেশন সার্চ লাইটে যে প্লান প্রোগ্রাম সাজানো হইয়াছিলো সে অনুযায়ী ৮ ইস্ট বেঙ্গল পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাওয়ার কথা ছিল আর এই ব্যাটেলিয়নের সকল অস্র প্যাক করা অপেক্ষায় ছিল। সেই হিসাবে জিয়ার পাকিস্তানে চলিয়া যাওয়ার কথা। ২৫ মার্চের রাত্রে এখানেই সর্বাধিক বাঙালি সৈন্য অবস্থান ছিল যাদের বেশির ভাগ ছিল শিক্ষানবিশ। তাদের দিয়ে গঠন করা হইতেছিল ১০ ইস্ট বেঙ্গল। এদের বেশির ভাগই সেই রাত্রে নিহত হয়। সেই রাত্রে জিয়া কোন প্রতিরোধের বেবস্থা না নিয়েই পরদিন নেভির সাথে শোয়াত জাহাজের অস্র খালাশে চলিয়া যান। পথে মেজর খালেকুজ্জামানের বাধায় ফিরে আসেন এবং মৌখিক বিদ্রোহ ঘোষণা করে চলিয়া যান কালুরঘাট এলাকায়। এরি মধ্যে রাত্রে বিদ্রোহী সেনাদের হাতে জিয়ার ব্যাটেলিয়নের সিও রশিদ জাঞ্জুয়া নিহত হন। কালুরঘাটে তিনি কাপ্তাই থেকে আগত ইপিআর সদস্যদের তার কাছে রাখিয়া দেন। তার নিজের ৩০০ সহ মোট ৫০০ সৈন্য হওয়া সত্তেও তিনি তাকে অপর্যাপ্ত বলে যুদ্ধ না করেই ২৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে বেতার ট্রান্সফরমার সহ ভারত চলিয়া যান ৩০ মার্চ (রামগর, সাব্রুম)। এর পর তিনি ভারতীয় বিএসএফ এর নিয়ন্ত্রণে চলিয়া যান। আগরতলায় ব্রিগ্রেডিয়ার বিসি পাণ্ডে তার প্রশাসক ছিলেন। পাণ্ডের নিয়ন্ত্রণে খালেদ মোশারফ, শফিউল্লাহ থাকলেও তাদের পাণ্ডে স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। তার কারন খালেদের ভাই আওয়ামী এমপিএ ছিলেন। শফিউল্লাহ ২৫ মার্চের আগেই বিদ্রোহ করে ছিলেন। ফলে এদের ২ জনের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে নাই। তখন অন্যান্য সেক্টর গঠন না হলেও যশোরে ক্যাপ্টেন হাফিজ, কুষ্টিয়ায় মেজর ওসমান, রাজশাহিতে ক্যাপ্টেন গিয়াস, সৈয়দপুর দিনাজপুরে ক্যাপ্টেন আনোয়ার নিজের মত করেই যুদ্ধ করছিলেন। যখন সেক্টর পুনর্গঠন হল জিয়াকে সেক্টর থেকে সরাইয়া দিয়া সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই সময় টুকু প্রায় ২ মাস তিনি পাণ্ডের নিয়ন্ত্রনে থেকে সময় অতিবাহিত করিয়াছেন। তিনি মেঘালয়ের তেলঢালায় গেলেন সেখানে তার বস হইল আইএস গিল। তার একজন কর্নেল রাজ সিংহ কে দেয়া হল জিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অর্থাৎ এখানেও তিনি অন্যদের মত স্বাধীন নন। জুলাই মাসে কামালপুর যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানির পর উনাকে সিলেটের দিকে নিয়ে আসা হয়। এখানেও উনি স্বাধীন নন। সকল সিদ্দান্ত নেন এবং দেন ব্রিগ্রেডিয়ার সাহবেগ সিংহ এবং ব্রিগ্রেডিয়ার ওয়াটকি। এই দুই ব্রিগ্রেডিয়ার আবার উঠা বসা করেন দেওয়ান ফরিদ গাজির কথায়। তা ছাড়াও ব্রিগ্রেডিয়ার কুইন, মেজর জেনারেল কেভি কৃষ্ণা রাও ত ছিলেনই। অতএব জিয়া ৯ মাসই নজরবন্দী কম্যান্ডার হিসাবেই দায়িত্ব পালন করেছেন যা অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের ক্ষেত্রে হয়নি। তবে যশোরে কর্নেল মেঘ সিংহ হাফিজ কে নিয়ন্ত্রণ না করলেও নিজে যুদ্ধে জড়াইয়া ভারত সরকারের বদনাম টা আগাইয়া আনেন।
(সুত্র ঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ৯,১০ খণ্ড, সাফায়েত জামিল ও মেজর নাসিরের লেখা বই)
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র ৯ম খণ্ড
সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন চৌধুরী