আ. ন. ম. গােলাম মােস্তফা
সাংবাদিক আ. ন. ম. গােলাম মােস্তফার জন্ম নীলফামারীর পঙ্গা গ্রামে, বাংলা ১৩৪৮ সনের ২৪ অগ্রহায়ণ। তাঁর বাবা জহিরউদ্দিন আহমেদ ছিলেন আইনজীবী সহকারী, মা গৃহিণী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মােস্তফাই ছিলেন সবার বড়। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় মেলাপাঙ্গা মাদ্রাসায়। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দিনাজপুর জেলা স্কুলে। ১৯৫৮ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ভর্তি হন কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৬০ সালে আই. এ. এবং ১৯৬৩ সালে বি. এ. পাস করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম, এ. পাস করেন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। এবং স্কুল ছাত্র সংসদের সম্পাদক নির্বাচিত হন। আইয়ুব স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনের সময় তিনি এ সংগঠনের দিনাজপুর জেলা শাখার যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হয়ে প্রায় আট মাস বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ছাত্র আন্দোলনে দ্বিগুণ মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ফলে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাকে আবার গ্রেফতার করে।
সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময়ই গােলাম মােস্তফা সাহিত্যচর্চার ব্যাপারেও আগ্রহী। হয়ে ওঠেন। সাহিত্যচর্চার জন্য দিনাজপুর শহরে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। তিনি এ সময় স্থানীয় সাহিত্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সাহিত্যচর্চা ও রাজনীতির প্রতি একাগ্রতার কারণে এক সময় তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দুইভাগে ভাগ হয়ে গেলে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের পিকিং-পন্থি গ্রুপের সাথে (মেনন গ্রুপ) যুক্ত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশায়ও গােলাম মােস্তফা। মনােযােগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার বার্তা বিভাগে সাংবাদিকতা শুরু করেন। কিছুদিন সংবাদে কাজ করার পর ১৯৬৬ সালে চলে যান দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। সেখানে তিনি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পাশাপাশি মাসিক মােহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করতেন। এ সময় নিজের সম্পাদনায় বের করতেন সাহিত্য পত্রিকা ‘অন্তরঙ্গ’। ছাত্র আন্দোলন, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, নিজের লেখাপড়া সবকিছুতেই তিনি একসাথে সক্রিয় ছিলেন। | ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম. এ. পাস করেন গােলাম মােস্তফা। ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে তিনি দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটর হিসাবে যােগ দেন। এ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বও তিনি পালন করতেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পূর্বদেশেই তিনি কর্মরত ছিলেন। গােলাম মােস্তফা রচিত দুটি বইয়ের মধ্যে আছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘অন্তরঙ্গ আলােকে’ এবং অনুবাদ বই ‘শ্বেত কুন্তলা’।
২৫ মার্চ ১৯৭১। মােস্তফা তখন পবিবার নিয়ে থাকতেন গােপীবাগ রেললাইনের পাশে। ২৫ মার্চ যখন ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু হলাে, তখন গােলাগুলির শব্দে পরিবারের সবার ঘুম ভেঙে যায়। মােস্তফা তার ভাইদের নিয়ে ছাদের উপরে। গেলেন। দেখলেন চারদিকে আগুনের কুণ্ডলী আর ধোয়া। নিজের ঘরে ফিরে তিনি “পূর্বদেশ’ অফিসে ফোন করলেন, কিন্তু কোনাে উত্তর পেলেন না। একইভাবে অনেক জায়গাতেই ফোন করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনাে খবর পেলেন না। বাসার পাশে ছিল একটা বস্তি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এক সময় সেই বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বস্তিবাসীরা চিৎকার শুরু করে। তখন মােস্তফা বাড়ির সব আলাে নিভিয়ে দিয়ে ডাইনিং রুমে সবাইকে নিয়ে রাত কাটালেন । কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সন্তান অভিকে নিয়ে। ভয়ে সে একটু পরপরই কেঁদে উঠছিল। বাবা-মা তখন ছেলের মুখ চেপে রাখছিল যেন তার কান্নার শব্দ কিছুতেই বাইরে যেতে না পারে। পাকবাহিনীর এই গণহত্যা দেখেই তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন বাঙালির স্বাধীনতার ব্যাপারে। স্ত্রীকে বললেন, “ঝর্ণা, যুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গেল।”
এই অবস্থায় সারা রাত কাটিয়ে পরদিন সকালেই মােস্তফা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ঢাকা শহর ছেড়ে তখন অনেকেই গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। মােস্তফা পরিবারের সবাইকে নিয়ে রওনা দিলেন অজানার উদ্দেশে। বাসা থেকে বেরিয়েই দেখেন সামনের খােলা মাঠে কতকগুলাে মৃতদেহ পড়ে আছে। বােঝার বাকি রইল না, পাকিস্তানি বাহিনী এদেরকে ধরে এনে এখানে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। গােপীবাগ থেকে হেঁটে হেঁটে খানিকটা দূর যাওয়ার পরই পথে পরিচয় হয় আজিজ নামে এক যুবকের সাথে। তাকে মােস্তফা চিনতেন না। তবু ওই যুবকই মােস্তফার পরিবারকে তাদের বেগুনবাড়ির বাসায় নিয়ে আশ্রয় দেয়। তারপর প্রায় এক মাস মােস্তফা সেখানেই ছিলেন। সেখান থেকেই প্রতিদিন মতিঝিলের অফিসে যাতায়াত করতেন। এপ্রিলের শেষের দিকে মােস্তফা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আবার গােপীবাগের বাসায় ফিরে আসেন।
যুদ্ধের এই ভয়াবহতার মধ্যেও মােস্তফা ছিলেন অকপট। দেশ স্বাধীন হচ্ছেএই কথা তিনি স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে চড়া গলায় বলে বেড়াতেন। যুদ্ধের সময় মানুষ যখন ফিসফিস করে কথা বলত, তখন মােস্তফা বলতেন চিকার করে। বন্ধুরা আস্তে কথা বলার উপদেশ দিলেও মােস্তফা তাতে কান দিতেন না। মনে করতেন, তাঁর কোনাে ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। এই সময়ে বাড়ির সবাইকে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন ভয় না পেতে। কারণ, পাকিস্তান সরকার কথা দিয়েছে, সাংবাদিকদের কোনাে ক্ষতি করবে না।
হয়তাে সরকারের এই আশ্বাস ও নিজের উপর গভীর আস্থার কারণেই মােস্তফা দেশ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। অবশ্য কতকগুলাে বাস্তব সমস্যাও তার ছিল। পরিচিত বন্ধুরা যখন একে একে দেশ ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখন অনেকে তাকেও চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু মােস্তফার কথা ছিল, “আমি কী করে পালাব, আমার বাড়িতে ন’মাসের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা রয়েছেন। এদের আমি কার কাছে। রেখে যাব? তার উপর আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।”
মােস্তফার পালিয়ে না যাওয়ার পেছনে আরও একটা কারণ ছিল। ঢাকায় থেকেই তিনি তখন মুক্তিযােদ্ধাদের নানাভাবে সহযােগিতা করছিলেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ঢাকায় আসত, তাদের অনেকের সঙ্গেই মােস্তফা নিয়মিত যােগাযােগ রাখতেন। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খাবার, অর্থ, ওষুধসহ নানা জিনিস তিনি বিভিন্নজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তাদের হাতে তুলে দিতেন। মােস্তফার ভাবনা ছিল, সবাই যদি দেশত্যাগ করে, তাহলে দেশের ভেতরে থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা করবে কে? যারা যুদ্ধ করছে তাদের কাজটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মুক্তিযােদ্ধাদেরকে নানাভাবে সহযােগিতা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় মােস্তফা সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় তিনি সংবাদ নিয়েও সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকদের সাথে কথা বলতেন।
মােস্তফা চাইতেন না ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় পাকিস্তানিদের কোনাে খবরাখবর যাক। এ নিয়ে তার সঙ্গে অনেকের তর্ক-বিতর্ক হতাে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই মােস্তফার এই আচরণ পাকিস্তান-ভক্তরা মেনে নিতে পারত না। অনেকের ধারণা, পাকিস্তান-ভক্ত এই ব্যক্তিরা পূর্বদেশে কর্মরত সকল স্বাধীনতাপন্থি সাংবাদিকদের খবরাখবর পাক হানাদার বাহিনীর কাছে পৌছে দিত। ১০ ডিসেম্বর, মােস্তফা অফিস থেকে ফিরে দেখেন অভি খুব কান্নাকাটি করছে। অভিকে শান্ত করতে কোলে তুলে নিলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় অভি বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লেও তাকে বিছানায় শােয়ানাে গেল না, কোল থেকেও নামানাে গেল না। এ অবস্থায় মােস্তফা অভিকে কোলে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। ভাের ৪টার দিকে অভি আবার কাঁদতে শুরু করল। মােস্তফা আবার তাড়াতাড়ি অভিকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তখনও অন্ধকার কাটেনি। ঢাকার বিভিন্ন মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। ঝর্ণাসহ আর সবাই তখন ঘুমিয়ে, শুধু মােস্তফার বাবা জহিরউদ্দিন প্রতিদিনের মতাে নামাজ পড়তে উঠেছেন।
মােস্তফা অভিকে কোলে নিয়ে হাটছিলেন বাড়ির সামনের খােলা জায়গায়। এমন সময় দশ-বারােজন লােক এসে দাঁড়াল বাড়ির সদর দরজার সামনে। তাদের সকলেরই পরনে ইউনিফর্ম, হাতে বন্দুক। হুটহাট করে দুজন লােক সদর দরজা খুলে ঢুকে গেল বাড়ির ভেতরে। মােস্তফার বাবা তখন বারান্দায় দাঁড়ানাে ছিলেন। লােকগুলাে জহিরউদ্দিন আহমেদকে জিজ্ঞেস করে, “এটা কি মােস্তফা সাহেবের বাড়ি? মােস্তফা কোথায়?” এই প্রশ্নগুলাে শুধু শুধুই করা হয়েছিল। কারণ বাড়িটা যে মােস্তফার, এটা তারা নিশ্চিতভাবে জানত। কারণ পাক হানাদার ও তাদের সহযােগী রাজাকাররা মােস্তফার সম্বন্ধী শামসুজ্জোহাকে বাড়ি চেনানাের জন্য সাথে নিয়ে এসেছিল।
হানাদাররা যখন জহিরউদ্দিন আহমেদের সাথে কথা বলছিল, তখন মােস্তফা। নিজেই এগিয়ে আসেন। তার কোলে অভি। তিনি নিজেই বললেন, “আমিই মােস্তফা।” ওরা বলে, “আমাদের সাথে একটু আসুন। বাচ্চাকে রেখে আসুন। ভয়ের কিছু নেই। আমরা আপনাকে পূর্বদেশ অফিসে নিয়ে যাব। ওখানে আপনার পরিচয়পত্র কার্ডটা একটু পরীক্ষা করব।” মােস্তফা বললেন, “আমার পরিচয়পত্র কার্ড সাথে আছে।” ওরা বলল, “তারপরও আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।” মােস্তফা কোনােরকম ভয় বা আতঙ্কিত না হয়েই অভিকে বাবার কোলে রেখে ওদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। কারণ, উনি তাে জানতেন যে সাংবাদিকদের কেউ কোনাে ক্ষতি করবে না। পরনে যে পাজামা-পাঞ্জাবি ছিল, সেভাবেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। একবার নিজের ঘরেও গেলেন না। ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১, হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গেল সাংবাদিক আ, ন. ম. গােলাম মােস্তফাকে। মােস্তফার স্ত্রী ঝর্ণা হঠাৎ ঘুম ভেঙে এত সকালে তার ভাই শামসুজ্জোহাকে দেখে একটু অবাক হন। শামসুজ্জোহাই প্রথম ঝর্ণাকে জানান যে মােস্তফাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে পূর্বদেশ’ অফিসে। মােস্তফার ছােট ভাই ‘পূর্বদেশ’ অফিসে গেলেন তার খোজে। গিয়ে জানতে পারলেন যে ওখানে কেউ মােস্তফাকে নিয়ে যায়নি। অফিসে মােস্তফার সহকর্মীরা তখনও সবাই আসেননি। অনেক খোঁজ-খবর নেওয়া হলাে, কিন্তু কেউ বলতে পারলেন না, কোথায় নিয়ে যাওয়া হতে পারে মােস্তফাকে। এরই মধ্যে ১০টা বাজার সাথে সাথে কারফিউ জারি হয়ে গেল। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত এভাবে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা বিরতি দিয়ে একনাগাড়ে কারফিউ চলল। কিন্তু যথাসাধ্য খোঁজাখুঁজির পরও আর পাওয়া গেল না মােস্তফাকে। মােস্তফা নিখোজ হওয়ার পর তার এক বন্ধু জানান, আসলে মােস্তফার পরেরদিনই ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল।
স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই মারা যান তার বাবা জহিরউদ্দিন আহমেদ। তার পরের বছর মারা যান তার মা। মােস্তফার স্ত্রী ঝর্ণা তখন পর্যন্ত মােস্তফার পরিবারের সাথেই ছিলেন। কিন্তু একে একে অন্য ভাইয়েরা সবাই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে বেরিয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর সরকার এবং পূর্বদেশ’ পত্রিকা অফিস থেকে যে অনুদান পাওয়া গিয়েছিল, তা দিয়ে মােস্তফাদের গ্রামের বাড়ি ঠিকঠাক করা হলাে। কিন্তু সেই বাড়িতে মােস্তফার স্ত্রী বা তার দুই সন্তানের জায়গা হয়নি। তারা গিয়ে উঠলেন ঝর্ণার বাবার বাড়িতে। এর মধ্য দিয়েই একসময় মােস্তফার স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে মােস্তফার পরিবারের সম্পর্কের ইতি ঘটে। স্বাধীনতার পর ঝর্ণা তার বাবার বাড়ির সহযােগিতায় অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন। যুদ্ধাপরাধী ও পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১২তম সাক্ষী ছিলেন শহীদ সাংবাদিক আ. ন. ম. গােলাম মােস্তফার ছেলে অনির্বাণ মােস্তফা অভি। জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন, তার বাবাসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে মুঈনুদ্দীন জড়িত ছিলেন। জবানবন্দিতে অনির্বাণ মােস্তফা জানান, একাত্তরে তার বয়স ছিল নয় মাস। তিনি বড় হয়ে মা, চাচা ও বাবার সহকর্মীদের কাছ থেকে দুজন মানুষ সম্পর্কে জেনেছেন। তাদের একজন তার বাবা ও অপরজন চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। একাত্তরে ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় তাঁর বাবার সহকর্মী মুঈনুদ্দীন ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) সক্রিয় নেতা ও আলবদরের অপারেশন ইনচার্জ। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের মানুষ যখন একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছিলেন, কেউ উচ্চস্বরে কথা বলতে পারতেন না, তখন তাঁর বাবা কর্মস্থলে পাকিস্তানি সেনা ও পাকিস্তানি সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালােচনা করতেন। একপর্যায়ে সহকর্মী মুঈনুদ্দীনের সঙ্গে তার এ নিয়ে বাগবিতণ্ডা হয়। এর ফলাফল ভালাে হবে না বলে মুঈনুদ্দীন হুমকি দেন। তিনি জানান, একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারির পূর্বদেশ’ পত্রিকায় মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। অনির্বাণ মােস্তফা জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি জেনেছেন যে একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর রাতে তার ঘুম হয়নি বলে পরদিন (১১ ডিসেম্বর) ভােরে তাকে নিয়ে তাঁর বাবা বারান্দায় হাঁটছিলেন। এ সময় তাঁর বড় মামা প্রকৌশলী শামসুজ্জোহাকে নিয়ে কয়েকজন একটি জিপে করে তাদের গােপীবাগের বাসায় এসে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর চাচা গােলাম রহমান বাবাকে খুঁজতে ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় গিয়ে বাবার সহকর্মী প্রধান প্রতিবেদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও আতিকুর রহমানকে বিষয়টি জানান। তারা তখন মুঈনুদ্দীনকে ডেকে পাঠান ও তাঁর বাবাকে খুঁজতে বলেন। তার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে মুঈনুদ্দীন বিভিন্ন স্থানে যান। এর মধ্যে মােহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটে গেলে সেখানকার প্রহরীরা মুঈনুদ্দীনকে দেখে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখায়। সে সময় তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীনের পরও বিভিন্ন স্থানে খুঁজে তাকে পাওয়া যায়নি। ১৯৭০ সালের ১৬ জানুয়ারি, গােলাম মােস্তফার সাথে বিয়ে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে রেহানা আখতার ঝর্ণার। এই দম্পতির দুই ছেলেমেয়ে- অভি ও উর্মি ।
সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ- আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা