You dont have javascript enabled! Please enable it!
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৩১ জানুয়ারি, বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জের জন্তারী গ্রামে। তার বাবা দিগেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন স্কুল শিক্ষক, পাশাপাশি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হিসাবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম রাজলক্ষ্মী ভট্টাচার্য। তাদের পরিবার ছিল সম্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবার। তিন ভাই ও তিন বােনের মধ্যে অনুদ্বৈপায়ন ছিলেন সবার বড়। তাঁর ডাকনাম ছিল ঝুনু। অনুদ্বৈপায়ন ১৯৬১ সালে নবীগঞ্জ যােগল কিশাের হাই স্কুল থেকে অংক ও সংস্কৃত বিষয় দুটিতে লেটার নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে এম. সি. কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে মেধা তালিকায় একাদশ স্থান অধিকার করে আই. এসসি, পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে বি. এসসি (অনার্স) এবং পরের বছর ১৯৬৭ সালে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে এম, এসসি, ডিগ্রি লাভ করেন।
 
অনুদ্বৈপায়ন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নব প্রতিষ্ঠিত ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র। স্কুল ও কলেজ জীবনে তিনি অনেকটাই রক্ষণশীল ছিলেন বলে তাঁর বন্ধুরা জানিয়েছেন। সে সময় আর দশটা সংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ ছেলের মতােই ছিল তাঁর আচরণ। মুসলিম সহপাঠীদের ছুঁয়ে দেওয়া পানি খেতেন না, ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে মেলামেশা করতেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে তিনি ধীরে ধীরে উদার মনােভাবের মানুষ হয়ে ওঠেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন দেখে চমকে যান তার সহপাঠীরা। তার সহপাঠী নবীগঞ্জ যােগল কিশাের হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ বন্ধু অনুদ্বৈপায়নের পরিবর্তন প্রসঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারে বলেছিলেন, “অনুদ্বৈপায়ন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এল। কথা প্রসঙ্গে বলল, “কিরে মাংস খাওয়াতে পারবি, তােরা মাংস খুব ভাল রাধতে পারিস!’ তাকে বলি, ‘তুই না কারও বাড়িতে জলই গ্রহণ করতি না, আর এখন বলছিস মাংস খাবি।’ প্রত্যুত্তরে অনুদ্বৈপায়ন বলেছিল, ‘বন্ধু, আগে ছিলাম ব্রাহ্মণ, এখন হয়েছি মানুষ।
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য চালচলন-বেশভূষায় ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে। তাঁর সহপাঠীরা জানিয়েছেন, তাঁর চলাফেরা ছিল বেশ অগােছালাে এলােমেলাে। শার্টের পকেট মাখামাখি থাকত কালিতে, খেয়ালই করতেন না। কিন্তু তুখােড় মেধায় প্রায়ই তর্ক চালাতেন শিক্ষকদের সঙ্গে। শিক্ষকরা অসীম মমতায় মেনে নিতেন তার এই মেধাদীপ্ত ঔদ্ধত্য। অনুদ্বৈপায়ন ১৯৬৮ সালের ১৪ মার্চ (কোনাে সূত্র বলছে ১৮ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পদে যােগ দেন। আর একই বছরের ১ জুলাই জগন্নাথ হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসাবে নিযুক্তি পান। ১৯৬৯-‘৭১ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে হাউস টিউটর হিসাবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষাজীবনে মেধার স্বাক্ষর রাখা শহীদ অনুদ্বৈপায়ন শিক্ষকতাকে জীবনের আদর্শ হিসাবে নিয়েছিলেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। তাঁর সহকর্মী শিক্ষকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে অনুদ্বৈপায়ন গবেষক হিসাবে সফল ও সুপ্রতিষ্ঠিত হবেন। কলম্বাে পরিকল্পনার আওতায় তিনি শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছিলেন। বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁর যাওয়ার সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত ছিল। ২৬ মার্চ রাতে তার লন্ডনের উদ্দেশে বিমানে ওঠার কথা। 
অবিবাহিত অনুদ্বৈপায়ন জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর হিসাবে অ্যাসেম্বলি হলের পাঠাগারসংলগ্ন দুটি কক্ষে থাকতেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ২০ মার্চ গ্রামে গিয়েছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ সকালে ঢাকায় জগন্নাথ হলে নিজের আবাসে ফিরলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন বন্ধু নির্মল মণ্ডল। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যান বন্ধুবান্ধব-সহকর্মীদের কাছে বিদায় নিতে। এরপর রাতে গিয়েছিলেন অধ্যাপক জালালুর রহমানের পলাশী মােড়ের বাসায়। তিনি অনুদ্বৈপায়নকে তার বাসায় থাকার অনুরােধ করেছিলেন। কিন্তু অত রাতে শিক্ষককে বিব্রত করতে চাননি বলে অনুদ্বৈপায়ন জগন্নাথ হলে নিজের কক্ষে চলে আসেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ওই কক্ষ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জগন্নাথ হলের দক্ষিণ ভবনের সামনে গুলি করে হত্যা করে। জগন্নাথ হলের গণকবরে তিনি সমাহিত হন। তার মৃত্যুর খবর বহুদিন পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা জানতেন না। সে সময়ের ঘটনাবলি জানা যায় তার শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়ের রচনায়। তিনি লিখেছেন : খুব সম্ভব ১৯ মার্চ (৭১) তারিখে শহীদের সাথে আমার শেষ আলাপ হয়।  কলম্বাে প্ল্যানের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ওর যাবার প্রস্তুতি শেষ তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২৬ মার্চ রাতে। জানাল ওই রাতে (১৯ মার্চ) বাড়ি যাচ্ছে মাকে দেখতে, খুব সম্ভব ফিরে আসবে ২৪ বা ২৫ মার্চ। … সেই ভয়াল রাত্রে কখন কীভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কোনাে দিনই প্রকৃত তথ্য জানা যাবে না। তবে পরবর্তীকালে নানা তথ্য ও উৎস থেকে জানা। গেছে যে, অনুদ্বৈপায়ন ২৫ মার্চ সকালের দিকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেছিল।
২৭ মার্চ কারফিউ উঠলে ছুটে গিয়েছিলাম জগন্নাথ হলে সহকর্মী ও ছাত্রদের। অবস্থা দেখবার জন্য, যা দেখেছি বর্ণনার অতীত। দেখা হয়েছিল সেখানে দক্ষিণ বাড়ির দারােয়ান মাখনের সাথে (এখন মৃত)। ক্রন্দনরুদ্ধ কণ্ঠে ও অনুদ্বৈপায়নের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানাল : স্যারকে ওরা পিছমােড়া করে দুহাত বেঁধে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে টেনে নিয়ে যায় অ্যাসেম্বলি ভবনের দিক থেকে, তারপর দক্ষিণ বাড়ির সামনে আরও ২/১ জনের সাথে গুলি করে মারে।’ মাখন এ ঘটনা দক্ষিণ বাড়ির কাছে ওর ঘর থেকে লুকিয়ে দেখে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে। (স্মৃতি : ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড; সামান্য সম্পাদিত) অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের হত্যাকাণ্ড স্বচক্ষে দেখেছিলেন জগন্নাথ হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক পরিমল গুহ, শােভা পাল ও বই বিক্রেতা ইদু মিয়া। তারা দেখেছেন, অনুদ্বৈপায়নকে ধরে নিয়ে হাত দুটি পেছনে মােড়া করে বেঁধে উবু করে বসিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানি সেনারা। সারা শরীরে ছিল রাইফেলের বাট ও বুটের আঘাতের ক্ষতচিহ্ন। গায়ের সমস্ত জামা ছিড়ে ফেলেছিল হানাদারেরা। একটা সময় তার পরনে ছিল শুধু একটি অন্তর্বাস। বিড় বিড় করে তিনি ঠিক কী বলছিলেন তা বােঝা যাচ্ছিল না। নির্যাতনে নির্যাতনে অনুদ্বৈপায়ন যখন প্রায় আধমরা, তখন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক গােপাল কৃষ্ণনাথও তার বাসার জানালা দিয়ে হত্যাকাণ্ডটি দেখেছিলেন। তিনি দেখেন, হানাদার বাহিনী, বিকেলে বুলডােজার দিয়ে গর্ত খুঁড়ে প্রখ্যাত দার্শনিক ড, গােবিন্দচন্দ্র দেব ও অনুদ্বৈপায়নসহ অসংখ্য ছাত্র ও কর্মচারীদের মৃতদেহ মাটিতে চাপা দিয়ে রেখে যায়।
অনুদ্বৈপায়নের শহীদ হওয়ার খবর খােদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে আমলে না নিয়ে তাকে কাজে যােগ দেওয়ার জন্য নােটিশ দিয়েছিল তাঁর বাড়ির ঠিকানায়। আর কাজে যােগ না দেওয়ার অভিযােগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্তও করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখের এক চিঠিতে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় তাঁকে বরখাস্তের নােটিশ পাঠিয়েছিল। অথচ তখন তার লাশ জগন্নাথ হলের গণকবরে সমাহিত। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এস. এম. ফজলুর রহমান ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর এক চিঠিতে উপাচার্যকে জানান যে সহকর্মী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ২৫ মার্চ রাতেই নিহত হয়েছেন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি অনুদ্বৈপায়নের বাবার কাছে আসে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে পাঠানাে দুই হাজার টাকার চেক সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছ থেকে তােলার জন্য ওই চিঠিতে বলা হয়। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের পরিবারের সদস্যরা তখনই নিশ্চিত হন যে তাদের প্রিয়জন আর বেঁচে নেই। নানা মাধ্যম থেকে তার মৃত্যুর খবর শােনা সত্ত্বেও এতদিন ধরে বাড়িতে আসা চাকরিতে যােগদানের পত্র, বরখাস্তের পত্র ইত্যাদি নানা কারণে পরিবারের মনে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তাে তিনি বেঁচে আছেন, হয়তাে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন পৌছে গেছেন। এই চিঠির মধ্য দিয়ে তাদের সব প্রত্যাশার পরিসমাপ্তি ঘটে। তাঁর বাবা পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে রমনা থানা থেকে ছেলের মৃত্যুসনদ নিয়েছিলেন।

সর্বশেষ তথ্য মতে, শহীদ অনুদ্বৈপায়নের একমাত্র জীবিত স্বজন ছােটবােন প্রীতিলতা তাদের গ্রামের বাড়িতে বাস করছেন। এছাড়া তাদের পরিবারের সবাই ১৯৮০-র দশকে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। (প্রথম আলাে, ৪ নভেম্বর ২০১৬) স্বাধীনতার পর নবীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে তার গ্রাম জন্তারী পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল ‘অনুদ্বৈপায়ন সড়ক। কালের স্রোতে সেটি এখন ‘কলেজ রােড’ নামেই পরিচিত। আর ‘অনুদ্বৈপায়ন সড়ক’ ফলকটিও মাটিচাপা পড়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও অনুদ্বৈপায়নের পরিবারের সহযােগিতায় তার নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় তৈরির উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর আলাের মুখ দেখেনি। স্বাধীনতার পর জগন্নাথ হলের সংসদ ভবনটির নাম রাখা হয়েছিল ‘অনুদ্বৈপায়ন ভবন’। ১৯৮৫ সালে ভবনটি ভেঙে পড়ে অনেক ছাত্রের অকালমৃত্যু হয়। তাদের স্মরণে সেখানে তৈরি হয় ‘অক্টোবর স্মৃতি হল’। মুছে যায় অনুদ্বৈপায়নের নাম। পরে অবশ্য জগন্নাথ হলের একটি পাঠকক্ষের নাম রাখা হয় ‘অনুদ্বৈপায়ন স্মৃতি পাঠকক্ষ। ২০১৬ সালের অক্টোবরে জগন্নাথ হলের ৪৬ নং আবাসিক শিক্ষক ভবনের নাম রাখা হয়েছে ‘অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য আবাসিক শিক্ষক ভবন। এছাড়া নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নবীগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজ ও জন্তরী গ্রামের ত্রিমুখী রাস্তার মিলনস্থলের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের স্মৃতিস্তম্ভ’ ।

সূত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ-  আলী মো. আবু নাঈম , ফাহিমা কানিজ লাভা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!