You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কোলকাতার ব্রিগেডগ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

৬ ফেব্রুয়ারি,  ১৯৭২

কোলকাতা

আমার ভাই ও বোনেরা,

আপনাদের আমি সাড়ে সাত কোটি বাঙালিদের পক্ষের থেকে শুভেচ্ছার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি। কৃতজ্ঞতার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি। (করতালি)। আপনারা জানেন যে,  ৭ কোটি বাঙ্গালি কীভাবে স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে। আমি আপনাদের যদি কৃতজ্ঞতা জানাতে চেষ্টা করি অন্যায় করা হবে,  কারণ,  পাকিস্তানের নরপশুর দল,  পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দল,  আমার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে,  দুনিয়ার ইতিহাসে তার কোন জাগাতে তার তুলনা হয় না। আইজ আমার গ্রামে-গ্রামে গৃহহারার আর্তনাদ। আইজ আমার গ্রামে গ্রামে সর্বহারার আর্তনাদ। আইজ আমার মানুষ পথের ভিখারি,  আজ আমার মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার প্রায় ১ কোটি লোক দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। যদি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী,  আপনাদের মহান নেতা,  ভারতের জনসাধারণ,  পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ,  ত্রিপুরার জনসাধারণ,  মেঘালয়ের জনসাধারণ,  আসামের জনসাধারণ তাদের স্থান না দিতো,  তাদের খাবার না দিতো,  তাদের আশ্রয় না দিতো,  তাদের সান্ত্বনা না দিতো,  তাদের অবস্থা কী হতো? আমি যদি কৃতজ্ঞতা না প্রকাশ করি তাহলে শ্রীমতী গান্ধী অন্যায় করা হবে। আমি আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারি,  এর বেশি জানাতে পারি না। (জনতার করতালি)

আপনাদের এই দান কোনদিন আমরা শোধ করতে পারবো না। স্বাধীনতা পেয়েছি,  বড় রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি। এত রক্ত,  কোনও জাত,  কোনও দেশে,  কোনও দিন দেয় নাই,  যা আমার বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। না হলেও ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। শতকরা চল্লিশখানা ঘর আমার বাংলাদেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কার্ফ্যু আইন জারি করে আমার জ্ঞ্যানি জ্ঞ্যানি জ্ঞ্যানি গুণী,  বৈজ্ঞানিক,  শিক্ষাবিদদের হত্যা করা হয়েছে। আমার এক কোটি লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সহকর্মীরা আপনাদের দুয়ারের কাছে,  আপনাদের কাছে এসেছে ভেগে,  জানের ভয় পেয়ে সংগ্রাম করার জন্য। সংগ্রাম তারা করেছে –  মানুষের মত সংগ্রাম করেছে। আমি যা বলেছি… আমি তাদের যাওয়ার সময়় অস্ত্র দিতে পারি নাই। আমাকে যখন তারা…গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়,  আমি জানতাম না আমি মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পারবো কিনা; কিন্তু আমার মানুষকে আমি বলে গিয়েছিলাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য… আমার কথা তারা রেখেছে। গত বার ৭ই মার্চ তারিখে আমি জানতাম পৈশাচিক বাহিনী আমার মানুষের আক্রমণ করবে। আমি বলেছিলাম,  আমি যদি হুকুম দেবার না পারি,  তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করো। আমি বলেছিলাম যা কিছু আছে সবকিছু দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। আমি বলেছিলাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার লোকেরা জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সকলেই সংগ্রাম করেছে। এ সংগ্রাম কামিয়াব হতে পারতাম না ভারতের জনসাধারণ,  ভারতের সরকার,  ভারতের সামরিক বাহিনী,  আর শ্রীমতি গান্ধীর নেতৃত্বে এগিয়ে না আসতো। আমি আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই। আমার দেবার মতো কিছুই নাই,  শুধু আমি এইটুকু দিতে পারি,  নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি দেবার কিছু নাই,  আছে শুধু ভালোবাসা,  দিলাম শুধু তাই।

ভাইয়েরা আমার,  আমাদের যে সংগ্রাম আজ থেকে শুরু হয় নাই। আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। কলকাতার কথা বলছি,  এই জাগা আমি লেখাপড়া করেছি। এই মাটির সঙ্গে আমার সম্বন্ধ বহুদিনের ছিলো। কিন্তু আমরা যদিও দু’দেশ হয়েছিলাম কিন্তু এমন একটা চক্রের হাতে পড়েছিলাম যে আপনাদের সঙ্গে আমরা সম্বন্ধ রাখতে পারি নাই,  তারা শুধু আমার স্বাধীনতা হরণ করে নাই,  তারা আমার মাতৃভাষার ওপর আঘাত করেছিলো। তারা আমার সংস্কৃতির ওপর আঘাত করেছিলো। তারা শুধু তাই করে নাই,  শোষণ করে বাংলাকে সর্বস্বান্ত করেছিলো। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম,  বার বার মোকাবিলা করেছি। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন আপনাদের জানা আছে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আমার ছেলেরা জীবন দিয়েছিলো। ১৯৫৪ সালে যখন সামান্য গণতন্ত্র সবাই আশা করলাম,  সেই দিন আমার আমাদের ওপর আক্রমণ করেছিলো,  আমাকে গ্রেপ্তার করেছিলো,  অনেক বন্ধুর বোধ হয় জানা আছে করাচী থেকে যখন আমি ঢাকায় পৌছি,  কলকাতায় কয়েক মিনিট আমি ছিলাম তারা জানতো তার কয়েক ঘণ্টা পরেই ঢাকার শহরে আমি গ্রেপ্তার হই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করেন পাকিস্তানে। এই আইন করা হয়েছিলো বাংলাকে শোষণ করার জন্য,  এই আইন করা হয়েছিলো বাংলাকে কলোনি করার জন্য,  এই সামরিক আইন করা হয়েছিলো বাংলার মানুষকে পথের ভিখারি করার জন্য,  আমরা রুখে দাড়িয়েছিলাম। আমার ভাইয়েরা জীবন দিয়েছিলো। আমরা কারাবরণ করেছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষ,  আপনারা খবর না পেলেও,  বাংলার মানুষ মাথানত করে নাই। বাংলা মানুষ সংগ্রাম চালিয়েছিলো এবং সংগ্রাম চালিয়েছিলো ১৯৬২ সালে আমার ছেলেদের ওপর গুলি চালালো। ১৯৬৪ সালে আমার ছেলেদের – মা-বোনদের উপর গুলি চালালো,  ১৯৭০ সালে ইতিহাস আপনারা জানেন। আপনাদের কাছে কী বলবো? এ সংগ্রাম আজ থেকে শুরু হয় নাই। বহুদিন থেকে শুরু হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের তিনটা আদর্শ ছিলো। সেই আদর্শ সভ্য জগতে চলতে পারে না। কী ছিলো তাঁদের আদর্শ? ভাগ করে দুটো দেশ হয়েছে; তাদের একমাত্র স্লোগান ছিল সব নেতাদের এসলাম কাত্রামে হ্যাঁয়,  কাশ্মীর কো ফতে পারণে কারেগা,  হিন্দু হামারা দুশমন হ্যায়,  আর কোনও স্লোগান নাই। আর কোনও আদর্শ নাই। মানুষ না খেয়ে মরছে,  তার কথা বলবে না। মানুষ… কতোটা মানুষ পথের ভিখারি হচ্ছে তার কথা বলবে না। দুঃখি মানুষের গায়ে কাপড় নাই তার কথা বলবে না। হিন্দুস্থান আমার শত্রু। হিন্দুস্থান কেন আমার দুশমন হবে? ভারতবর্ষ কেন আমার দুশমন হবে? তারা তো আমার ভাই। তাদের সঙ্গে আমরা ভাই হিসেবে বাস করবো। এর মধ্যে বাংলায় প্রতিবাদ উঠেছে। কিন্তু আমরা … আপনারা জানেন যে ২৩ বৎসর পর্যন্ত শতকরা ৯৬ জন লোক আমাদের সারা পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হতো। বাঙ্গালিদের সামরিক বাহিনীতে নেওয়া হতো না। কারণ বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র পাইলে তারা… তাদের উপায় ছিলো না। তাই বাঙালিদের অস্ত্র দেওয়া নিষেধ ছিলো। আমার মতো মানুষও যদি একটা বন্দুক লাইসেন্স দিতে হতো তাহলে দশবার ঘুরে একটা লাইসেন্স করতে হতো। মনে করেছিলো বন্দুক দিয়েই বাংলাদেশকে দাবায় রাখবে। আহাম্মকের দল জানে না যে জাতি একবার জেগে ওঠে,  সে জাতি মুক্তি পাগল,  যে জাতি স্বাধীনতাকে ভালোবাসে,  সে জাতিকে বন্দুক-কামান দিয়ে দাবায় রাখা যায় না- আহাম্মকের দল তা জানে না। ইতিহাস তারা পড়ে না।

ভাইরা আমার,

তাই আপনারা জানেন,  যা কিছু সামান্য আমার পুলিশের লোক ছিলো তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে,  শতকরা ৬০ জন বাঙ্গালি পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। যা কিছু আমার সামরিক বাহিনীর লোক ছিলো,  তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যা কিছু আমার শিক্ষিত লোক ছিলো তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রাস্তা বাংলাদেশে নাই,  শেষ করে দিয়ে গেছে। শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে,  যাওয়ার আগে যতগুলো খাবার গুদাম ছিলো,  যার মধ্যে আটা,  ময়দা,  চাউল ছিলো তা পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। কী অবস্থায় আমাদের ফেলে গেছে তারা। আমি নিশ্চয়ই মোবারকবাদ জানাবো,  স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর সরকার এবং ভারতের জনসাধারণ আমাদের সাহায্য দিয়েছেন,  যাতে অন্তত পক্ষে আমার লোকগুলো দাঁড়াতে পেরেছে। তবে একথা সত্য আমার লোক না খেয়ে সংগ্রাম করেছে,  আমার লোক দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে,  কিন্তু আমার লোকের একতা আছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে,  একতাবদ্ধভাবে যদি আমি সংগ্রাম করি তা আমার দেশকে গঠন করার জন্য,  বিশ্বাস করি সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে। কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। বাংলার মাটি বড় সুন্দর মাটি। বাংলার মাটি পলি মাটি। বর্ষাকালে বাংলার মাটি বড় নরম হয়ে যায়। আমি একবার এই বক্তৃতা করেছিলাম পল্টন ময়দানে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলাম যে,  ভুলে যেয়ো না,  এই বাংলা তিতুমীরের বাংলা। ভুলে যেয়ো না এই বাংলা সূর্যসেনের বাংলা,  ভুলে যেয়ো না,  এ নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের বাংলা,  ভুলে যেয়ো না এই বাংলা ফজলুল হকের বাংলা,  ভুলে যেয়ো না এ বাংলা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা,  এই বাংলা যেমন পলি মাটির বাংলা,  চৈত্র মাসের প্রখর রৌদ্রের সময় এই বাংলার মাটি এমন শক্ত হয় যার আঘাতে অনেকের মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। তারা আমার কোথা মানেনাই। তারা বারবার আমাকে …একবার আমাকে করল আগরতলা মামলার আসামি,  আমাকে ফাঁসি দেবে,  দিতে পারলো না। বাংলার মানুষ আমাকে কেড়ে আনলো ওদের কয়েদ খানার থেকে। এবার আমি আপনাকে মোবারকবাদ জানাই বেশি করে মিসেস গান্ধী,  আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়েছিলো,  আমাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য তারা সমস্ত কিছু ঠিক করে ফেলেছিলো,  আমি জানি আপনি দুনিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন,  আপনি দেশে দেশে ঘুরেছেন,  আমার দুঃখী মানুষের জন্য,  ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য। এজন্য আপনাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার দুঃখ ছিলো না,  আমি মরবার জন্যই প্রস্তুত হয়ে হুকুম দিয়েছিলাম। মৃত্যু স্বাভাবিক,  বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম যে আমার বাংলাদেশের মানুষকে পশ্চিমা শোষক গোষ্ঠী এবং দানব গোষ্ঠী দাবায় রাখতে পারবেনা। দুনিয়ার অনেক দেশ আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছে। বা ইংরেজ গ্রেট ব্রিটেনের জনসাধারণ… অন্যান্য জনসাধারণ আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এমেরিকার জনসাধারণ এবং তাঁদের সাংবাদিকরা আমাদের অনেক সমর্থন করেছেন – আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এমেরিকার সরকারকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারবোনা। ভারত যখন এগিয়ে এলো আমার জনসাধারণকে সাহায্য করার জন্য,  যখন আমার গ্রামে গ্রামে হত্যাকাণ্ড চলছিলো,  যখন দুধের বাচ্চারদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিলো,  এমেরিকান গভারমেন্ট কি জানতেননা সে খবর?! তার মেশিনারি আমার বাংলায় ছিলো। তারা জানতেন। কেমন করে তিনি অস্ত্র দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীর হাতে? কেমন করে তিনি ভারতবর্ষে সাহায্য বন্ধ করে দিলেন? ভারতের জনসাধারণও দুঃখী জনসাধারণ। তাদেরও কষ্ট আছে। তাঁরাও তাঁদের মুখের গ্রাস ভাগ করে আমার বাংলার মানুষকে খাইয়েছে। সেই সময় তাঁদের সাহায্য বন্ধ করার অর্থ কী? ৭ কোটি লোকের বাজার রাখার জন্য? আপনাদের দালালরা পশ্চিম পাকিস্তানের দালালরা বাংলাদেশকে বাজার রাখবে? এই উদ্যেশ্যে? আমি এমেরিকার সরকারকে … আমি তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাইনা- এইটুকু বলতে চাই – আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারলাম না। আর আপনাদের অনুরোধ করছি,  আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন,  মুখে মুখে,  মেহেরবানি করে গণতন্ত্রের কথা না বলে গণতন্ত্র যেভাবে চলে সেই দিকে একটু খেয়াল রাখুন। সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীর দিন চলে গেছে,  ভারতবর্ষেও আর বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদীর খেলা চলবেনা – এ বিশ্বাস আমার আছে।

ভায়েরা আমার,

নীতির জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। আইজ আমার দেশ স্বাধীন। আইজ আমার দেশ সর্বভৌম। বিশ্বাস করেন,  পশ্চিম পাকিস্তানের গরিব ভাইদের বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার নাই,  আমি চাই তারা সুখে থাকুক,  আমি প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করিনা। কিন্তু,  তাঁরা যদি মনে করে থাকেন এখনো বিদেশে ঘুরে ঘুরে বলেন যে বাংলাদেশ তাদের অংশ তাহলে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হবে – তাঁদের পাগলা গারদে ছাড়া তাদের কোন জাগায় স্থান নাই। (জনতার করতালি)। আমরা ছিলাম সংখ্যায় বেশি,  আমরা ঘোষণা করেছি আমার দেশ স্বাধীন,  তুমি কোন জাগার মাদবার হয়ে পড়লা – তুমি বলছো বাংলাদেশ তোমাদের অংশ! ভুলে যাও বন্ধু,  সুখে থাকো বন্ধু। বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। তোমার ক্ষমতা নাই বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে পারো। বিনা অস্ত্রে যদি আমার বাংলার মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা নিয়ে থাকতে পারে- আইজ বাংলাদেশকে যদি ষড়যন্ত্র করতে চাও,  আর কোনও খেলা খেলতে চাও মনে রেখো ৭ কোটি বাঙালির একটা প্রাণ বেঁচে থাকতে বাংলার মাটিতে ঢুকবার ক্ষমতা তোমাদের নাই। আমি জানি তোমরা সাপ। আমার জানার আছে। সেই জন্য কবিগুরুর একটা কবিতা পড়তে হয়। যে নাগিণীরা চারদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,  শান্তির দ্বৈত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস,  যাবার বেলায় ডাক দিয়ে যাই,  দানবের তরে লড়িবারে প্রস্তুত হতে হবে ঘরে ঘরে। আমার বাঙালি প্রস্তুত আছে। নাগিণীদের আমরা চিনি,  ভয় নাই। আমাদের নীতি আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে,  যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ায় দুনিয়ায় ঘুরে আপনার জন্য মুক্তি কামনা করেন আর বাংলার স্বাধীনতার অনুরোধ করেন ব্যাপারটা কী? আমি বলি ব্যাপারটা পরিষ্কার এবং সোজা আপনারা যদি বুঝতে চান বুঝতে পারেন,  বুঝবার চান না বলেই বোঝেন না। এটা হলো নীতির মিল,  এটা হলো আদর্শের মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে,  তিনি বিশ্বাস করেন গণতন্ত্রে। আমি বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে,  তিনি বিশ্বাস করেন সমাজতন্ত্রে। আমি বিশ্বাস করি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র,  তিনি বিশ্বাস করেন ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমি বিশ্বাস করি জাতীয়তাবাদ,  তিনি বিশ্বাস করেন জাতীয়তাবাদ। এটা নীতির মিল,  এটা আদর্শের মিল। এ জন্য হয়েছে আমাদের বন্ধুত্ব। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। কেউর ক্ষমতা নাই আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারে।

ভাইয়েরা আমার,

আমি ও আমার দেশে সাম্প্রদায়িকতা বাংলার বুকে নাই আপনারা দেখেছেন। ভারতের জনসাধারণকে আমি অনুরাধো করবো যে ভারতের বুকে যেন সাম্প্রদায়িকতার বীজ আর না আসে। কারণ,  এটা মনুষ্যত্বের বাইরে। এটা মানবতার বাইরে। এটা যে কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে। সেই জন্যই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র,  যেখানে বলা হয় তা পুরাপুরি আপনাদের পালন করতে হবে। আমি আপনাদের কোনো রকমের অ্যাডভাইস দিতে চাই না,  আমি শুধু বলতে চাই,  কারণ আমার অনেক সময় আমি দেখেছি,  যখন আমি বাংলার জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি তখন মাঝে মাঝে পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রকারীরা পূর্ব বাংলায় চেষ্টা করেছে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে। তার ফল হয়েছে ভারতবর্ষে – যাতে আমার আন্দোলন অনেক পিছিয়ে গেছে। সেই জন্যই আপনাদের কাছে আমার আমাদের আবেদন থাকবে। আর আমি আপনাদের এই আশ্বাস দিতে পারি যে বাংলাদেশ চারটি স্তম্ভের ওপর চলবে। জাতীয়তাবাদ,  সমাজতন্ত্র,  গণতন্ত্র,  আর ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এর মধ্যে কোনও কিন্ত ফিন্ত নাই। এর মধ্যে কেউ হাত লাগাতে পারবেনা। এটা সোজাসুজি আমরা করবো। আর আপনারা জানেন আমি সোজা মানুষ। সোজা কথা বলি। যা বলি সেটা বুঝি,  সেটা বলি এবং সেটা করি। এর মধ্যে আমি ভয়ও করি না কাউকে কিছু করিনা। আমার মানুষ বড় সোনার মানুষ। সোনার বাংলা সত্যিই সোনার বাংলা। তাই আমরা আমাদের জাতীয় সংগীত করেছি- সোনার বাংলা তোমায় বড় ভালোবাসোি। তাই আমি আপনাদের সকলকে আবার আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেওয়ার সমা বলে যাই আপনাদের বন্ধুত্ব অটুট এবং অক্ষয় থাকবে।

আপনারা আমার সঙ্গে স্লোগান দ্যান।

জয় ভারত,  জনতা একসাথে,  “জয় ভারত”

জয় ভারত,  জনতা একসাথে,  “জয় ভারত”

জয় বাংলা,  জনতা একসাথে,  “জয় বাংলা”

জয় বাংলা,  জনতা একসাথে,  “জয় বাংলা”

জয় শ্রীমতি গান্ধী,  জনতা একসাথে,  “জয় শ্রীমতি গান্ধী”

জয় শ্রীমতি গান্ধী,  জনতা একসাথে,  “জয় শ্রীমতি গান্ধী”

আমি যদি বলি বাংলাদেশ-ভারতবর্ষ,  আপনারা বলবেন অমর হোক।

বাংলাদেশ- ভারতবর্ষ,  জনতা একসাথে,  “অমর হোক”।

বাংলাদেশ- ভারতবর্ষ,  জনতা একসাথে,  “অমর হোক”।

Reference:

বঙ্গবন্ধুর অডিও ভাষণ, পিপলস ভয়েস, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!