মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ দিন দিন মারাত্মক হচ্ছে–সাদেক খান
বাংলাদেশে প্রতিদিনই মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে, তারা শ’দের মূলঘাটিতে আক্রমণ করে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে নির্বিঘ্নে ফিরে আসছে নিজেদের ঘাঁটিতে। এখন প্রায় প্রতিদিনই মুক্তি বাহিনী গেরিলা ও কমান্ডাে আক্রমণ চালিয়ে হানাদার দস্যুবাহিনীর অপরাজেয়তার রূপকথার ফানুস ফুটিয়ে দিচ্ছে। | মাত্র পাঁচ মাসের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য যুদ্ধের দিক পরিবর্তন সূচিত করেছে। এখন থেকে মুক্তিবাহিনীই পাল্টা আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিচ্ছে। শত্রু অধিকৃত বাংলাদেশের বহু অঞ্চল মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী সেখানে বাংলার সাধারণ মানুষকে বাস করতে সাহায্য করছে। এই পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী গেরিলা পদ্ধতিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৩০,০০০ পাক হানাদার দস্যু সৈন্য হত্যা করেছে। ফলে হানাদার পাকবর্বরদের বাংলাদেশ থাকা কষ্টকর হয়ে উঠেছে এবং বাইরে তারা যতই তড়পাক, ভেতরে ভেতরে তাদের মনােবল নিঃশেষিত ।। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে তারা এখন বেসামাল ও পর্যদস্ত। সেই জন্য তারা এখন আর রাতের অন্ধকারে ক্যাম্প বা ব্যারাক থেকে বের হতে সাহস পায় না। শহরের কোনদিকে গেরিলা আক্রমণ শুরু হলেও তারা ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে মুক্তি বাহিনীকে প্রতি আক্রমণ করতে ভয় পায় ।
বাংলাদেশের মুক্তি সম্রামের চূড়ান্ত পর্যায় হলাে শত্রুদের ঘাঁটি দখলের লড়াই। সালদা নদী এলাকার যুদ্ধও সেই পর্যায়ভূক্ত। মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে সেখানে শত্রুরা প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দুর্বার মুক্তিবাহিনী শত্রুদের মুখােমুখি আক্রমণ করে দুইশত বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। শত্রুদের চান্দিনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হটিয়ে দিয়ে গত দুই মাস ধরে মুক্তিবাহিনী সেই অঞ্চল দখল করে আছে। বর্তমানে কুমিল্লা একটি ভৌতিক শহরে রূপান্তরিত। প্রায় প্রতিদিনই কুমিল্লা শহরে শত্রুদের মূল ঘাঁটিতে কমান্ডাে ও গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ভীষণ ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। ফলে পাক সামরিক চক্রের পক্ষে কুমিল্লার তথা সারা বাংলাদেশে অবস্থান দুঃসহ হয়ে উঠেছে। এখন তাই বাংলাদেশে জঙ্গীশাহীর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে কূটবুদ্ধির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা নাকি বাঙালিদের উপর অতিমাত্রায় দয়া পরবশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাঙ্গালিদের উপর গত ছয় মাস ধরে তারা যে ভাবে বর্বর আক্রমণ ও অত্যাচার চালিয়েছে, তা বাঙ্গালিরা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। | বাঙ্গালিরা আজ মনে প্রাণে পাক দস্যুদের ঘৃণা করে, তারা আর এক মুহূর্তও দস্যুদের সহ্য করতে রাজী নয়। এমন কি অনেক রাজাকার পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে।
মৃত ও আত্মসমর্পণকারী রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে এই স্বীকারােক্তি করছে যে, তারা পাক-সৈন্যদের কাছ থেকে আন্তরিক সহানুভূতি তাে পায়ই নি বরং অনেক সময় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। | জঙ্গী ইসলামবাদ সরকারের বেতার কেন্দ্রগুলি মিথ্যা কথা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে বলা হচ্ছে যে, তারা নাকি ঢাকা আর চট্টগ্রামের মধ্যে সড়ক যােগাযােগ স্থাপন করেছে। এটা উদ্ভট ও অলৌকিক প্রচার মাত্র। এতে বরং জঙ্গী সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশ পাচ্ছে। দুটি বিষয় এই ব্যাপার থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমত ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যখানে রয়েছে কুমিল্লা শহর। যুদ্ধ শুরুর পর। থেকেই কুমিল্লার রেল ও সড়ক পথের উপর মুক্তিবাহিনীর পূর্ণকর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। এমনকি ঢাকা কুমিল্লা যােগাযােগ পর্যন্ত এখনাে বন্ধ কারণ দাউদকান্দি ফেরি মুক্তিবাহিনী বহুদিন আগেই উড়িয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত । বাংলাদেশের ভেতরের অবস্থা বিশ্ববাসীর কাছে এখন দিবলােকের মতাে স্পষ্ট। যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গীহীর পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং সেই প্রেক্ষিত যদি শান্তি শৃঙ্খলা পুরাে বজায় থাকত তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম যােগাযােগ পথ এখনাে বিচ্ছিন্ন থাকতাে না। | মুক্তিবাহিনী এখন তাদের তৎপরতা বহুস্থানে বহুল পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। কয়েকটি ঘটনা। নিঃসন্দেহে উল্লেখ করার মতাে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে যে-ভাবে ৬টি অস্ত্র ও মালবাহী জাহাজ ধ্বংস করেছে, তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তুলনা বিহীন। তার মধ্যে পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশনের “আল-আব্বাস’, ‘ফরমােজা’ নামক একটি জাপানি জাহাজ ‘লাইটনিং’ নামক একটি সােমালী ল্যান্ডের জাহাজের নাম উল্লেখযােগ্য। তাছাড়া অসংখ্য বােট, মােটর লঞ্চ, স্টিমার, ফেরি লঞ্চ প্রভৃতির শুধু তারা অকেজো করেই ক্ষান্ত হয় নি; এই সঙ্গে অনেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করার ছােট বড় কেন্দ্র, টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থাপনাও বানচাল করে দিয়েছে। | এখন রেলপথ, কালর্ভাট, সেতু প্রভৃতি মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যস্থূল। তারা পাটকলে যাতে উৎপাদন না চলে সেদিকেও অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা, হানাদার বাহিনী কর্তৃক বে-আইনী দখলীকৃত অসংখ্য পাটের গুদাম আগুন দিয়ে বিনষ্ট করেছে, পাটক, উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। শত্রুদের জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহ পথ প্রতিনিয়ত বিঘ্নিত করেছে। এই সমস্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে বিচার করলে আমরা বুঝতে পারি যে বাংলাদেশের মাটিতে হানাদার বাহিনীর আয়ু এখন শেষ হয়ে গেছে। তারা এখন পরাজয়কে রােধ করতে গিয়ে পদে পদে পরাজয়ই বরণ করে নিচ্ছে।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১:১1 ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আমরা মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক
“আমার হাতে আর্ণেন্ট মিংওয়ের লেখনী নেই, নেই মিথাইল শেখলবের লেখনী আমার চারপাশে স্থান হারানাে শশ্মানের নির্জনতা। আজ আমার পৃথিবীতে কেউ নেই। অভিশপ্ত ২৫শে রাত্রিতে মােল বছরের বােন মানােয়ারাকে আল্লাসে তুলে নিয়ে গেছে। আব্বা, আম্মা সেই রাত্রেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন উন্মত্তের বক্ত নেশার শিকার হয়ে। পাঁচ বছরের ছােটভাই কামাল, সেও রক্ষা পায় নি শত্রুর জীঘাংসা থেকে। ছাব্বিশের সকালে পাগলের মতাে ছুটে গেছি, বাড়ির দিকে। পথে চলছে সন্ত্রস্ত হয়ে, ভাবছি কখন গিয়ে উদ্বিগ্ন প্রিয়জনের উৎকণ্ঠা দূর করি। কত অলিগলি বেয়ে কত মৎস চক্ষুর দৃষ্টি আড়াল করে আমি জীবনের বার্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বাড়ির পাশে পেীছেই এক সকরুণ নিস্তব্ধতা এক মুহূর্তে যেন আমার প্রাণটাকে স্তব্ধ করে দিল; যষ্ঠ ইন্দ্রিয় এক লহমায় দুরাশার বাণী দিল ছড়িয়ে । তবু পা টিপে টিপে এগুচ্ছি কেননা মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে মানুষ নিদারুণ আশাবাপী। পর্টিকোতে গিয়ে পেীছে দেখি, আম্মা, আব্বা আর কামালের বক্তাল্পত লাশ পড়ে আছে। আমার একটি হাত তখনাে কামালকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। আব্বার দেহ শতচ্ছিন্ন, হাতদুটো প্রায় শরীর থেকে আলগা হয়ে আছে। আনােয়ার এর কোনাে হদিশ নেই । তার কয়েক সেকেণ্ডের
তারপর এগিয়ে চললাম ছাব্বিশের পাতায়। সেখান থেকে অবিরাম লেখা শুরু হয়েছে দিন তারিখের সীমানা ডিঙিয়ে একসুরে লেখা ছুটে চলেছে। গােটা লেখা পড়তে আমার মিনিট দশ পনেরাে সময় লাগলাে । তারপর লােভ সামলাতে না পেরে সেই অবিস্মরণীয় লেখা তুলে নিলাম আমার নােট বুকে। এমনি করে পৌনে দুটা বেজে গেল। লেখা আমার শেষ হয়ে গেছে। ভাবলাম একটা সিগারেট ধরাই। দেশলাইতে ঠোকা। দিতেই ক্যাপটেন সচকিতে উঠে জিজ্ঞেস করলে -“হ ইজ দেয়র?পরিচয় পেয়েই হাতে হাত রেখে বললাে -“আই এম সরি আই ওয়াজ ডেড টায়ার্ড” “আপনি বসুন আমি মুখ ধুয়ে আসছি।” | মুখ ধুয়ে এসেই আর্ডলিকে বললাে, নিয়ে এসাে। আমি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম ‘আই হােপ ইউ আর ফ্রী নাও” স্মিতহাস্যে উত্তর এল এ ফ্রীডম ফাইটার ক্যান নেভার বি ফ্রী আনটিল দি ফ্রীডম অফ দি মাদারল্যান্ড ইস এচিভড”, “দ্যাটস টু” বলে দুজনেই ক্ষানিকক্ষণ হাসলাম। ততসময়ে চা এসে গেছে দুটো। কালাই করা গ্লাসে। চায়ে চুমুক দিয়ে আমার দেড় ঘন্টায় অপকীর্তির ফিরিস্তি দিলাম। ক্যাপটেন বললাে “আমার ডায়েরির বক্তব্য আপনি কাগজে দিতে চান তাতে আমার আপত্তি নেই কিন্তু প্লিজ আমার নাম যেন, উল্লেখ করবেন না।” জানতে চাইলাম কোন সামরিক নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা। ক্যাপ্টেন বললেন “না, না সামরিক কোনাে নিষেধাজ্ঞা নেই আপত্তিটা আমার নিজেরই।
আমার বক্তব্যের কোনাে নূতন কথা নেই। যেখানে দশলক্ষ মানুষ নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসের বলি সেখানে কারও ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্ন স্বাতন্ত্রের কোনাে দাবিই রাখতে পারে না। এ বক্তব্যটা আমার ডায়েরির ছেড়াপাতায় আমি লিখে রেখেছি বলে বক্তব্যটা আমার বলা ঠিক নয়-বাংলার ঘরে ঘরে আজ একই বিয়ােগ ব্যথার কান্না, স্বজন হারানাে শ্মশীনভূমিতে প্রতিশােধের একই অনির্বাণ প্রতিজ্ঞা-ছয় কোটি পঞ্চাশ লক্ষ জীবিত বাঙ্গালির বুকে আজ একই ব্যাকুল সুরের অনুসরণ।” সাতাশ বছরের ক্যাপ্টেন তাঁর চিন্তার সার্বজনীনতার মধ্যে প্রােজ্জ্বল স্বকীয়তার পরিচয়ে আমাকে বিমুগ্ধ করলাে। আমিও স্কান্তিতে ফিরে গিয়ে বুঝতে পারলাম যুদ্ধরত একটা গােটা জাতির কাছে ব্যক্তির পরিচয় নগণ্য। বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতা যজ্ঞের একেকটি ঋত্বিক। প্রতিশ্রুতি দিলাম তার নাম আমি প্রকাশ করবাে না। তারপর শুরু হলাে আমার নানান প্রশ্ন। উদাত্ত কণ্ঠের স্থির নিশ্চয়তায় অনর্গল একের পর এক উত্তর আসতে লাগলাে। কষ্ঠে তার তিলমাত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত খাদ নেই। তবু আমার পেশাগত ধর্মে বার বারই তাঁকে বাজিয়ে নিতে ছাড়ি নি! | প্রশ্ন করলাম-বাংলাদেশ কি স্বাধীন হবে ক্যাপ্টেন? আমরা কি ফিরে যেতে পারবাে আমাদের বট, জাম, হিজলের ছায়ার ঘেরা সেই গৃহ কোণে; নাকি এই মরুপ্রান্তরেই আমাদের জীবনের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে? উত্তর এল- স্বাধীন হবে না মানে, আলবৎ হবে। কার ক্ষমতা আমার বুকে বসে আমাকে চিরকাল শোষণ করে যাবে? প্র:- আপনার কাছে থেকে ইমােশনাল উত্তর চাই না ক্যাপটেন, চাই লজিক্যাল উত্তর।
উ: – ইউ আর টকিং টু এ সােজার অন দি ফ্রন্ট। ইমােশন ইজ ইউর বিজনেসূ। হােয়াট আই মিন, আই মিন বাই একসন এন্ড নট বাই ইমােশন।
বুঝতে বাকি রইলাে একজন জাত সৈনিকের সঙ্গে আমি কথা বলছি তবু বৃত্তিগত ধর্ম ছাড়তে পারি না। প্রশ্ন করলাম- উড ইউ প্লিস জাস্টিফাই?” উত্তরে – দেখুন কোনও সৈনিকের পক্ষে যুদ্ধজয় অসম্ভব যদি তার পাশে ব্যাপক জনসমর্থন না থাকে। সৈনিকের লক্ষ্যস্থল তার শক্র। কিন্তু শত্রু যদি তার চারদিকেই থাকে কটা ফ্রন্টে সে যুদ্ধ করবে? তার চলার পথ প্রতি পদে পদেই ব্যাহত হতে বাধ্য। নিরস্ত্র জনতার হাতে কোনও অস্ত্র নেই কিন্তু তারাই প্রচণ্ড মার দিচ্ছে শক্রসেনাকে। স্থানে স্থানে তারা ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছে রাস্তা কেটে দিচ্ছে এর ফলে শত্রুসেনা বিপর্যস্ত হচ্ছে অতি প্রতি পদে পদে। যে যে দিকে পারছে হাতের সামান্য অস্ত্র দিয়ে লুটেরাকে খতম করছে। অথচ দেখুন আমরা যখন একশ্যনে যাই গ্রামের সাধারণ কৃষক বধুও তার বরণডালা নিয়ে এগিয়ে আসে। আমি কাব্য করছি না এটা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা। যেখানেই গেছি গ্রাম মানুষের আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করেছে।
শুধু তাই নয় শত্রু সৈন্যের অবস্থিতি সনাক্ত করতে এরা আমাদের নানা ভাবে সাহায্য করছে। এই তাে সেদিন মধ্যবয়সী কয়েকজন কৃষকভাই এসে বসলাে “ওমুক জায়গায় ত্রিশজন পাক সেনা রয়েছে। ওদের সঙ্গে গাড়িও আছে মনে হচ্ছে মেইন রােড ধরে এদিকে এগিয়ে আসবে। আমাদের তাে কোনও হাতিয়ার নেই কিন্তু কি ভাবে ওদের বধ করা যায়”। বললাম মেইন রোডের এদিকে (মানে আমাদের শিবির থেকে কয়েক ফার্লং দূরে) রাস্তার পেট কেটে আজ রাত্রের মধ্যেই সব মাটি বের করা চাই। অন্তত ‘শাট দশফুট যায়গা থেকে মাটি বের করতে হবে কিন্তু মাটি রাস্তায় পাশে ফেলা চলবে না। তারপর মাত্র একটি রাত। সেই রাতের গভীরেই নওজওয়ানেরা কাজ হাসিল করলাে। পরদিন সকাল এগারােটায় পাকসেনারা বিপুলবেগে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছে ঐ পথ ধরেই। আর যায় কোথায় চোরা বালির ধাঁধায় পড়ে ট্রাক নিয়ে হুড় মুড় করে পড়লাে ৩৫ জন পাক সেনা। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অপারেশন- মিনিট পাঁচেকের মামলা তারপর সব শেষ। বিপুল সংখ্যক অস্ত্র নিয়ে আমরা শিবিরে ফিরলাম। এমনি ঘটনা আজ বাংলার সর্বত্র অহরহ ঘটছে। বেঘােরে জল্লাদের হারাচ্ছে প্রাণ। সুতরাং আপনিই চিন্তা করুন এমনি করে আর কদিন ওরা টিকে থাকতে পারবে। টিকতে যে পারবে না তা বােঝাই যাচ্ছে। আজকাল ওরা আগের মতাে রেজিট্যান্স দেয় না, ছাউনি থেকে বেরােয় কম। ভাঙা ব্রিজ আর পথ ঘাট মেরামতও করে না। চূড়ান্ত প্রহরের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে পরমায়ুর হিসেব করে কেবলই ক্যাপ্টেন সাহেবের অনেকক্ষণ সময় নিয়েছি-তাই এবার আমার ওঠার পালা। বললাম-থ্যাঙ্ক ইউ ক্যাপ্টেন গুড নাইট-আবার দেখা হবে”। স্মিত হাস্য, দেখা হবে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে না হলেও আমার কবরের সঙ্গে তাে নিশ্চয়ই আমার কবরের বার্তাও একই থাকবে, আমাকে না পেলে খােলা দুনিয়ার কাছে আমার সেদিনের কবরের বার্তা বয়ে নিয়ে যাবেন আপনি -সােনায় মােড়ানাে সােনার বাংলা শশান করিল কে? পৃথিবী তােমায় আসামীর মতাে জবাব দিতেই হবে জিজ্ঞেস করলাম একি আপনার এফিটাফ হবে।” এপটাফ-উত্তরে আবার সেই নৈর্ব্যক্তিকতা শুধু আমার কেন মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত শহীদের।
বাংলার মুখ ।১:৬ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ১০