You dont have javascript enabled! Please enable it!

“দ্রোহের উন্মাদনায় মুক্তির স্বপ্ন” ভারত অভিমুখে যাত্রা!!

প্রায় এপ্রিলের মাঝা মাঝি।পাকসেনারা যশোর,কুস্টিয়া,মাগুরায় তাদের সৈন্য সংখ্যা ক্রমশঃজোরদার করছে।আমাদের সামান্য অস্ত্র এবং স্বল্প সংখ্যক সেনা ও বাকী হাল্কা প্রশিক্ষন প্রাপ্ত আনসার দিয়ে মাগুরা রক্ষা করতে পারবনা।যে কোন সময় মাগুরা ফল করতে পারে।ঝিনেদা ফল করলে আমাদের সমস্ত রাস্তাই বন্ধ হয়ে যাবে।এমন কি আর ইন্ডিয়াও যেতে পারবো না।আমাদের এ মুহূর্তে আগে প্রয়োজন ভারত যাওয়ার,ভারত গিয়ে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা এবং অস্ত্র সংগ্রহ সরবাগ্রে প্রয়োজন।আমরা রিট্রিটের প্রস্তুতি নিই।বিশেষ ভাবে এম,পি সোহরাব সাহেব এবং আসাদুজ্জামান আমাকে ভারত যাওয়ার ব্যাপারে অনুরোধ করলেন।
আমার চলে আসার সময় ঘনিয়ে এলে কর্মী বাহিনী আমার কাছে এসে কান্না করতে থাকে।এদের মদ্ধে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল আবুল খায়ের, ফাত্তাহ,রুস্তম আলী।আমি তাদের সান্তনা দিয়ে বললাম আমরা চলে যাচ্ছি তোমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও।তাছাড়া বৃহত্তর স্বার্থে এখন আমাদের যেতে হচ্ছে।দু’দিন আগে পরে তোমাদেরও যেতে হবে।দেশকে শত্রু মুক্ত করে স্বাধীন করতে হলে আরো শক্ত হতে হবে।তাছাড়া আমরা অস্ত্র সংগ্রহ করেই ফিরে আসব।তোমরা আমাদের জন্য দোয়া করো।
১৩ই এপ্রিল রাত ৮টায় আমি এস,ডি,ও অলিউল ইসলাম,আসাদুজ্জামান ও সামসুদ্দিন সাহেব একটা জীপে করে মাগুরা থেকে রওয়ানা হই।আমরা ঝিনেদা পৌছে ওয়াপদার রেস্ট হাউজে উঠলাম।রেস্ট হাঊজে গিয়ে দেখি গরম ভাত এবং গোশত পড়ে আছে কিন্তু কোন লোক নেই।বুঝতে পারলাম এরা রিট্রিট করেছে।এখানে আছেন এস,ডি,পি ও,মাহাবুব উদ্দীন এবং লেঃমতিউর রহমান।এরা সবাই অপারেশনে আছেন এবং যুদ্ধ করছেন।

এ মুহূর্তে তারা কোথায় কি অবস্থায় যুদ্ধ করছে যানতে পারিনি। আমরা আবার রয়ানা হই,চুয়াডাঙ্গা পৌছে মেজর ওসমানের সংগে দেখা করলাম।ওস্মান চৌধুরী সাহেব আমাদের ডাক বাংলোয় থাকতে বললেন।পথে আমাদের কোন খাওয়া-দাওয়া হয়নি।রাতে মুক্তিযোদ্ধা কর্মীরা খিচুরী খাওয়ালো।রাত কাটিয়ে সকালে আওয়ামী লীগের লিডার ডাঃআসাব উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করলাম।এখানে তখন দু’একজন লোকাল লিডারও ছিলেন।উনারা বললেন মেহেরপুর যান মেহেরপুরে যুদ্ধ চলছে।

যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তৌফিক এলাহী সাহেব-মেহেরপুর এর এস,ডি,ও।উনার সংগে দেখা করলে খুবই উৎসাহিত হলেন,আমাদের ক্যাম্পে যেতে বললেন।আমরা ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিলাম।দুপুরে খেয়ে দেয়ে যা টাকা পয়সা ছিল ফুরিয়ে গেল।এখন ভরসা রইলো ক্যাম্পের খাবার উপরেই।আমরা ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে ভাবতে থাকলাম এখানে লোকাল পিপল এবং লিডারদের নিয়ে একটা মিটিং করার প্রয়োজন।এ উদ্দেশ্যে ১৪ই এপ্রিল আমরা স্থানিয়ভাবে একটা মিটিং ডাকি।এ মিটিং-এ কুস্টিয়ার জেলা প্রশাসক সামসুল হক,পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের যোগ দিলেন।মীটিঙয়ে এখানকার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হলো পাবনার ডিসি নুরুল কাদের সাহেবকে।উনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এবং যুদ্ধ সম্পর্কে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন।বক্তৃতায় বললেন আমাদের কাছে যা আছে এবং আমরা যারা আছি এরাই গেরিলা কায়দায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব।চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে সবাইকে উদবুদ্ধ করলেন।আমরা দৃপ্ত শপথ নিলাম মেহেরপুর বাঁচানোর জন্য।
আমরা যখন মেহেরপুরে যুদ্ধের জন্য এভাবে সর্বাত্মক প্রস্তুতী গ্রহন করছি ঠিক তখনই আমাদের উপর নির্দেশ এলো রিট্রিটের জন্য।অর্থাৎ মাত্র ১ দিন পরই তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের ভারত ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন।আমরা যেভাবে মেহেরপুরে যুদ্ধের প্রস্তুতী নিয়েছিলাম তাতে খুবই আত্ম প্রত্যয়ী ছিলাম।মরনপন লড়াইয়ের জন্যই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা।তাছাড়া শুরু থেকেই কুস্টিয়া,মেহেরপুর,চুয়াডাংগায় ব্যাপক আক্রমন চালিয়ে আসছে।তাই এখানে ওদেরকে প্রতিরোধ করা ছিল একান্ত প্রয়োজন।এখানে ওদের প্রতিরোধ না করতে পারলে আমাদের সিমান্ত পথ নিস্কন্টক হবে না।কিন্তু কি করা যাবে,কেন্দ্রীয় নেতার নির্দেশ আমাদের মানতেই হবে।অতঃপর আমরা ওয়ার কাউন্সীল ডিসলভ করে ভারত যাবার প্রস্তুতী নিলাম।
কেবলমাত্র স্বদেশ ত্যাগ করলেই দেশের গভীরে যে মমতার শীকড় ডুবে থাকে তা উপলদ্ধি করা যায়।য়ামরা অবশেষে ভারত অভিমুখে যাত্রা করলাম।সীমান্তে পা রেখে একবার পেছন ফিরে তাকালাম প্রিয় মাতৃভূমির দিকে।দেশের আর এক ইঞ্চি মাটিও পায়ের নিচে রইল না।চিরায়ত সৌন্দর্যের লীলাভুমি সুজলা সুফলা মাতৃভুমি পূর্ববাংলাকে পেছনে ফিরে চললাম।জানি না এ মাটিতে আর কখনো ফিরে আসতে পারব কি না?দেখতে পাব কিনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।তবে আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল এদেশ স্বাধীন হবেই।আজ হোক আগামীকাল হোক এই ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে আমরা মুক্তি পাবই ইনশায়াল্লাহ।।যাবার প্রাক্কালে আমাদের কর্মী আতাউর রহমান এম,পি মাগুরা এবং ডি,সি নুরুল কাদের সাহেবের একজন সিপাহী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।আমরা তাদের সান্তনা দিলাম।এই আতাউর রহমান এম,পি পরবর্তীকালে ভারত থেকে আর ফিরে আসেনি।ভারতের মাটিতেই তিনি মারা যান।

আমরা একেবারেই নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় ভারত রওয়ানা হলাম।এস,ডি,ও অলিউল ইসলাম সাহেব চিন্তা করলেন আমরা যদি ডি,সি নুরুল কাদের সাহেবের সংগ পাই তাহলে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।এই Understanding এ আমাদের যাত্রা শুরু হলো।বেতাই বর্ডার দিয়ে ঢুকে প্রথমে উনি বি,এস,এফ-এর কাছ থেকে আমাদের সেইফ করে নিলেন;কিন্তু আমার কাছে একটা এস,এম,জি ছিলো,বর্ডার ক্রস করার পর বি,এস,এফরা আমার এস,এম,জিটা সিজ করে নিয়ে নিলো।এতে করে আমার খুব দুক্ষ লাগলো।আমি শেস সম্বলটুকু হারানোর বেদনায় রীতিমত কেঁদে ফেললাম।কিন্তু বি,এস,এফের সদস্যরা আমাকে বোঝালো ভারতের অভ্যন্তরে নকশাল বাহীনি আছে।তারা এ সমস্ত কেড়ে নিবে।আপনার দুক্ষ করার কিছু নেই।আমি কিছুটা সান্ত্বনা খুজে পেলাম।আর্মস দিয়ে আবার রওয়ানা হলাম।আমরা সবাই তখন নুরুল কাদের সাহেবকে ফলো করছি।উনি আমাদের গাইড এবং নেতা হিসাবে কাজ করছেন।
রাত ১১টা নাগাদ আমরা কৃষ্ণনগর পৌছলাম।নুরুল কাদের সাহেব প্রথমেই আমাদের ডি,সি কৃষ্ণনগর এর বাসায় নিয়ে গেলেন।কৃষ্ণনগরের ডিসি আমাদের ডাক বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমি আসাদুজ্জামান এম,পি, আতাহার আলী এম,পি,ডিসি নুরুল কাদের প্রমুখ ডাক বাংলোয় উঠলাম।থাকার বন্দবস্ত আপাত;বেস ভালোই হলো।কিন্তু খাবার পাব কোথায়?কয়েকদিনই আনাহার অর্ধাহারে কেটে যাচ্ছে।রাতে খুব ক্ষুদা লাগলো।আসাদুজ্জামান ১০ টাকা দিলেন।সে টাকা এক্সচেঞ্জ করে ভারতীয় মুদ্রা পেলাম ৭ রুপী।তাই দিয়ে কোন মতে ভাত খেয়ে ক্ষুন্নি বৃতি করলাম।ভীষণ ভাবে হতাশ হয়ে পড়লাম।কি হবে,কি ভাবে বাচবো?কোথায় পাব টাকা পয়সা,অস্ত্রশস্ত্র?তবুও সামনে ছিল একটিই আদর্শ,যুদ্ধ করতে হবে,যুদ্ধ করেই মুক্তি অর্জন করব।এর কোন বিকল্প নেই।তাই শেস পর্যন্ত আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকি।মনকে সান্ত্বনা দেই একদিন শত্রুমুক্ত দেশে ফিরতে পারলে জীবনের এসব দুঃখ বেদনা ঘুচে যাবে।

১৫ই এপ্রিল সোহরাব সাহেব এলেন।উনি এখানে এক এরিয়া লিডারের কাছে আমাকে পাঠালেন।তাঁর কাছে মাগুরার খবর আদান প্রদান করতে হবে।অন্য দিক সোহরাব সাহেব কিছু টাকা দেওয়ার জন্যও বলে দিলেন।এই আনসার এডজুটেন্ড এর কাছ থেকে আমি দু হাজার টাকা নিয়ে এলাম।এটা আবার কারেন্সি করতে আমাকেই পাঠালেন।এডজুটেন্ড তখন মুর্শিদাবাদের তেহাট্টা নামক এক স্থানে থাকেন।যা হোক আমার সাথে আর একটি ছেলেকে দেওয়া হলো।এই ছেলেটি দেশে থাকতে আমার সাথেই ব্যবসা বানিজ্য করত।আমাকে পেয়ে ও খুবিই আনন্দিত।মনের অনেক জ্বালা দুঃখ কস্ট নিয়ে আমার সাথে আলাপ করল।

১৬ই এপ্রিল বাংলাদেশে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর উদ্বোধন এবং বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার গঠন হয়।কিন্তু দুঃখিত আমাকে থেকে যেতে হলো।সোহরাব সাহেব আসাদুজ্জামান সবাই গেলেন।
এরপর আমরা কোলকাতার প্রিন্স অফ স্ট্রীট এম,পি হাউজে উঠলাম।এখানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা উঠেন তারপর কেউ কেউ অন্যত্র অবস্থান নিয়েছেন।এখানে এসে মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো।এক রুমে দুই সীট এক সীটে সোহরাব সাহেব অন্য সীটে প্রফেসর ইউসুফ সাহেব।আমি প্রফেসর ইউসুফ সাহেবের সঙ্গে রইলাম।

প্রফেসর ইউসুফ রাত্রে সোহরাব সাহেবকে বললেন’ কামরুজ্জামান ভাইকে বর্ডারে পাঠিয়ে দিন।উনি যোদ্ধা মানুষ এখানে থেকে কি করবেন?ওখানে গেলে বাংলাদেশের অনেক যুবকদের পাবেন তাদের সংগঠিত করে দেশের মদ্ধে কিছু অপারেশনেও করতে পারবেন’।সোহরাব সাহেব সেই মোতাবেক আমাকে অনুরোধ করলে আমি বনগাঁ চলে গেলাম।
বনগাঁয় গিয়ে আমার সাথে দেখা হলো এস,ডি,পিও মাহাবুবুদ্দীনের সংগে।উনি এখানে যুদ্ধ করছেন,যুবকদের সংগঠিত করছেন।আমি এলে মাহাবুব উদ্দীন সাহেব খুবিই খুশি হলেন।আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথেই গ্রহন করলেন।মাহবুব সাহেব আমাকে বেনাপোল কাস্টম হাউজে যেতে অনুরোধ করলেন।এখানে আমাদের অনেক ই,পি,আর সৈন্য,ছাত্র এবং নেতারা আছেন।তখন এখানে প্রায় ২০০/২৫০ জন ছাত্রই ছিল।সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।কিন্তু এদের তেমন কোন প্রশিক্ষণ ও ভারী অস্ত্র নেই।তবু এদের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমার খুব ভালো লাগলো।আমি এদের উদ্দেশ্যে উৎসাহ মূলক ক্তৃতা দিলাম।

২৩শে এপ্রিল আমদের ফল-ইন হলো আর্মি কায়দায়।এরপর আমরা পরবর্তী প্রোগ্রামের জন্য সমবেত হলাম।এ সময় ই,পি,আর এর একজন হাবিলদার নাম মুজিবর রহমান সবার উদ্দেশ্যে খুবই জ্বালাময়ী বক্তৃতা করলেন।তিনি বললেন;দেখুন অফিসাররা কখনো ফিল্ডে ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন না।যুদ্ধ করে সাধারন সিপাহীরা।প্রিয় বন্ধুরা;যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে।আমরাই যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করব।অত এব সকলেই মনে মনে জান কোরবানীর জন্য প্রস্তুত থাকুন।এই বক্তৃতার পর সবার মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার সঞ্চার হলো।যুদ্ধের জন্য সকলের মধ্যে গভীর আগ্রহ।২৪শে এপ্রিল আমরা বেনাপোলের অদুরে পাক সেনাদের একটা অবস্থানের উপর হামলার প্রস্তুতী নিলাম।সকাল বেলাই আমরা ফ্লাংক করে আমরা পজিশন নিলাম।ফিল্ডে আমি রাইট ফ্লাংক পেলাম।পাকবাহিনী ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জীত।ওরা আমাদের অদুরে পূর্ব দক্ষিন কোন ধরে পজিশন নিল।এরপর জিপের সাহায্যে আর, বোমা নিক্ষেপ করতে লাগলো।এই বোমার প্রচন্ডতা এতই ছিল যে এক একটা আঘাতে বড় বড় পুকুর সৃস্টি হয়ে যাচ্ছিলো।আমরা ফ্লাংক পরিবর্তন করে পুনরায় পজিশন নিলাম।ফায়ার দিয়ে যাচ্ছি অনবরত কিন্তু তেমন কিছুই করতে পারছিনা।ক্রমশঃদুপুর হয়ে এলে,ই,পি,আর এর একজন হাবিলদার এল,এম,জি কাঁধে আমার ফ্লাংকে এসে বললেন কি ব্যপার আপনারা এখনো আছেন?আমরা অনেক আগেই ফ্লাংক ছেড়ে দিয়েছি।আমাদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছে।পিছু হটে যান নইলে মারা পড়বেন।খুব দুঃখ ভরা মন নিয়ে ফিরে এলাম।খুব উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও আমাদের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হলো।

ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গনী ওসমানীকে নিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের মধ্যে এলেন।উনী তখন বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী।আমরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলাম সরকার গঠিত হওয়ার জন্য।কেননা সরকার গঠিত হলে বৈদেশিক সমর্থন ও সাহায্য পেতে সুবিধা হবে।এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সঠিক ও সুস্টহভাবে পরিচালনার জন্য অচিরেই বিপ্লবী সরকার গঠন ছিল একান্ত অপরিহার্য।সরকার গঠন হলে ধীরে ধীরে সব অসুবিধা দূর হবে,একটি সুস্টহ সমন্যয় ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।এটাই ছিল আমাদের প্রত্যাশা।কিন্তু জানি না আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পুরন হচ্ছে?

আমাদের দুক্ষ কস্ট দেখে তাজউদ্দীন সাহেব অনেক স্বান্তনা দিলেন।স্বাধীনতা যুদ্ধ করলে কস্ট ও ত্যাগ স্বীকার এবং অসুবিধার মুখোমুখি হওয়াটা স্বাভাবিক।সবকিছু পরিহার করে স্বাধিনতা যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে।যুদ্ধ মানেই কস্ট,জীবন বাজি রাখা।ধৈর্য ধরে সবকিছুর মোকাবেলা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু কোথায় আছে তখনও আমরা জানি না।বঙ্গবন্ধুর কথায় সবার চোখ ছল ছল করে উঠে।উনারা স্বান্তনা দেন বন্ধু আমাদের সাথেই আছেন।তাজউদ্দীন সাহেবের নির্দেশে পরবর্তীতে আমরা ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ আবার বনগাঁও যাওয়ার সিধান্ত নিলাম।রাস্তার এক পাশ ধরে আমরা বনগাঁর দিকে অগ্রসর হচ্ছি,রেল স্টেশনে এসে দেখলাম Indian army Arms নিয়ে আমাদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হচ্ছে।পথে আমাদের সাথে দেখা হলে তারা আমাদের অভয় দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন।এবং সর্বতও সাহায্যের ও আশ্বাস জানিয়ে বললেন ভয় নেই তোমাদের পিছনে আমরা আছি।ওদের বড় বড় কনভয় আর রেলের ওয়াগনে সুসজ্জিত অবস্থায় দেখে বুক ভরে গেল আমার।অনেক স্বপ্ন চোখের তারায় দুলছে।আবশ্যই আমরা স্বাধীন হব।

আমরা এখন শুধু একটি বাস্তহারা উদ্ধাস্ত জাতি নই।আমাদের অনেক বন্ধু আছে।তারা প্রয়োজনে যে কোন সাহায্য করবে আমাদের।আমার সহযোদ্ধা প্রশক্ষনারথী সবাই হরসৎফুল্লো।সন্ধ্যে নাগাদ পেট্রপোল হাই স্কুলে এসে উঠলাম।রাতে সমস্ত আর্মস ক্লোজ করলাম।তারপর একটি অস্থায়ী আরমার তৈরি করে সেখানে সমস্থ অস্ত্র জমা করলাম।এরপর সেনাবাহিনীর নিয়মে আরমারীতে পর্যায় ক্রমিক ডিউটি দিলাম।আমাদের মধ্য থেকে বেছে বেছে যুবকদের নিয়ে একটি রোস্টার করলাম।এতে করে পরিবেষটা সুশৃঙ্খল হলো।
আমার সাথের সমস্ত ছাত্র যুবক নেতাদের নিয়ে এই একটি স্কুলে জায়গা সংকুলান হচ্ছিলনা।ফলে কিছু সংখ্যক ছাত্র নিয়ে পাশের এক প্রায়মারী স্কুলে আশ্রয় নিলাম।ভারতে আসা অবধি প্রতিদিনই খুদার কস্ট করছি।বিভিন্ন যায়গায় প্রচুর শিবির,আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে।সুস্টহ যোগাযোগ,ব্যেবস্থাপনার অভাবে প্রতিটি ক্যেম্পে নানা রকম সমস্যার সৃস্টি হচ্ছে।এর মধ্যে অন্যতম সমস্যা খাধ্য ও পানি সংকট।ভারত সরকার ও স্থানীয় জনগন সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে।তারা যথেস্ট সাহায্য করছে আমাদের।কিন্তু এত ব্যাপক পরিসরে কোন নেট ওয়ার্ক গড়ে উঠতে পারছেনা,ফলে এক যোগে সমাধান সম্ভব হচ্ছে না।

আমরা একটা অপারেশন শেষ করে এত দূর থেকে পায়ে হেটে এসে অত্যন্ত ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি।কিন্তু হঠাত করে রাতে এত লোকের খাবার যোগাড় করা সম্ভব নয়।আমাদের যা সাথে যা সামান্য চিড়া,মুড়ি,গুড় ছিল তাই খেয়ে কোনমতে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম’।

তাছাড়া আমাদের মধ্যে সেই হাবিলদার মুজিবর রহমান যিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।তিনি এবং তাঁর একজন সহযোগি যোদ্ধা মারা যান।আমরা এদের ডেড বডি পর্যন্ত আনতে পারিনি।সবাই ছিলাম তাই শোকে মুহ্যমান।আর এই অপারেশনে নেতৃত্ত দেন মেজর ওসমান (পরবর্তীতে করনেল)চৌধুরি।এরপর ঘুমানোর পালা;বিছানা বালিশ মশারীতো দুরের কথা।সামান্য মাথা গোঁজার মত একটু খানি জায়গাই ছিল তখন বড় কথা।স্কুলের বেঞ্চগুলি কয়েকটি একত্রীত করে তার উপর ৫/৭জন করে শুয়ে কোনমতে রাতটি কাটিয়ে দিলাম।
পরদিন ফল-ইন হলো।সকাল ৮টার সময় আমরা রিপোর্ট করলাম।
ইতোমধ্যে জানতে পারলাম “বাংলাদেশ সাহায্য সংস্থা” নামক একটি আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে।এখানে অনেক বাঙ্গালী ছাত্র-যুবক নেতারা আছেন।এদিকে আমাদের অপারেশনের পর অস্ত্র জমা নিয়ে নেওয়া হলো।তৎকালীন মেজর আবু ওসমান চৌধুরি(বর্তমান অবঃলেঃ করনেল) ইনি ছিলেন ক্যাম্প ইনচারজ।আমাদের সব অস্ত্র জমা নিয়ে নিলেন।কেননা আশেপাশে নকশাল পার্টী আর্মস সিজ করে নিতে পারে ভেবে এ ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
অতঃপর আমরা সিভিলিয়ান হয়ে গেলাম।বনগাঁও কালি বাড়ি নামক স্থানে একটা শীবির তৈরি হয়েছে।আমরা সে শিবিরে গিয়ে উপস্থিত হলাম।এখানে এসে অনেক নেতা কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাত হলো।এর মধ্যে ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান,যশোহরের নুরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ ছিলেন।এই শিবিরটির ব্যবস্থাপনা ছিল বেশ সুস্টহ ও সু শৃখল।নিয়মিত খাবার এবং রেশনিং এর ব্যবস্থা আছে।কেন্দ্রের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এর ব্যবস্থা আছে।আমাদের কেন্দ্রিও নেতা ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট সম্ব্যকারী গন খোঁজ খবর রাখছেন।এতদিন পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।দু’এক্টা দিন বেশ স্বস্তিতেই কাটিয়ে দিলাম।

“বিসয়খালী রণাঙ্গনে’
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ।বিভিন্ন এলাকা ফল করছে পাকবাহিনীর হাতে।আমাদের ভারত গিয়ে আশ্রয় নেয়ার সমস্ত পথঘাটও ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে।ইতোমধ্যে আমি মাগুরার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্তভার গ্রহন করেছি।মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠীত করে ছোট খাটো কিছু অপারেশন পরিচালনা করছি।সিতালী অপারেশনের পর পরই আবার পাক বাহিনীর মুখোমুখি হই।স্বাধীনতা যুধ্যের প্রথম দিকে ঝিনেদার মাহাবুবুদ্দীন ও লেঃ মতিউর রহমানের নেতৃত্তে অপারেশন বিসয়খালী ছিল অত্যন্ত গুরত্তপুর্ন।এই অপারেশনে আমরা বিসয়খালী ব্রিজ উড়িয়ে দেই।এ সময় বিসয়খালী ব্রিজ উড়িয়ে পাক সেনাদের প্রতিরোধ না করতে পারলে ওরা সংগে সংগে ঝিনেদা অধিকার করতো ফলতঃ আমাদের ভারতে আশ্রয় গ্রহনেরও সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে যেত।ঝিনেদার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ কালিন সময়ে সিংহ ভাগ শরণার্থীরা প্রত্যহ গমন করেছে।এসব বিবেচনায় এনে দেখা যায় ভারত যাবার প্রাক্কালে আমাদের যে সমস্ত অপারেশন সংঘঠিত হয় বিসয়খালী ছিল তার অন্যতম।
মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর থেকেই পাক বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্টে সাদা পতাকা উড়িয়ে যুদ্ধ বিরতির আপাততঃ ছদ্যাবরন নিয়ে ভেতরে ভেতরে খুবই সংঘঠিত হতে থাকে।তারা U S Made C-130 B Air Craft-এ করে চট্রগ্রাম এবং ঢাকা থেকে অস্ত্র ও সৈন্য আমদানী করতে থাকে।আমরা ওদের গতিবিধি দেখে পূর্বেই অনুমান করতে পারলাম ভেতরে ওদের সংঘঠিত হওয়া সম্পর্কে। ফলে ওদের প্রতিরোধ করার জন্য আমরা বিভিন্য পথে ও স্থানে ক্যাম্প তৈরী করি।এ সমস্ত ক্যাম্পের মদ্ধে উল্লেখযোগ্য ছিল যশোর ঝিনেদার মাঝখানে বিসয়খালী নামক ব্রিজের অদুরে বিসয়খালী ক্যাম্প, মাগুরা কামারখালীর মাঝখানে বেলনগর ক্যাম্প,মাগুরা এবং ঝিনেদার মাঝখানে আলমখালী ক্যাম্প, মাগুরা থেকে যশোরের সরাসরি রাস্তায় চিত্রানদীর পাড়ে সীমাখালী ক্যাম্প,সীমাখালী থেকে যশোরের রাস্তায় খাজুরা নামক স্থানে খাজুরা ক্যাম্প।এই খাজুরা ক্যাম্পে ই,পি,আর এর একটি পুরো কোম্পানী ছিল।
এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি একটি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।যাতে আমাদের দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।এদেরকে পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য স্থানন্তিরিত করা হয়।
অত্যন্ত সল্প সময়ের মধ্যে তৈরি এ সমস্থ ক্যাম্পের উদ্দেশ্য ছিল রাস্থায় পাকবাহিনীকে চরম ভাবে প্রতিরোধ করা।মাগুরার কমান্ডার হিসাবে এ সমস্থ ক্যাম্প গুলোর দায়িত্ত ছিলো আমার উপরে।এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা জানতে পারলাম যশোহর থেকে পাকবাহিনীর অত্যন্ত সুসংগঠিত একটি অগ্রবর্তীদল ঝিনেদা আক্রমনের জন্য এগিয়ে আসছে।তখন আমরা বিসয়খালী থেকে ১০/১২ মাইল দূরে আলমখালী ক্যাম্পে অবস্থান করছিলাম।সংবাদ শুনে প্রায় ১০০ শত মুক্তি যোদ্ধা নিয়ে বিসয়খালীতে আমরা পূর্বে নির্মিত ট্রেঞ্চে অবস্থান নেই।এই অপারেশনে যৌথ ভাবে নেতৃত্ত দেন ঝিনেদার এস,ডি,পি ও মাহবুব উদ্দীন,লেঃ মতিউর রহমান এবং আমি নিজে।অত্যন্ত ভারী এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর সাথে আমাদের এক তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়।যুদ্ধের এক পর্যায়ে ভারী কামান দিয়ে ওরা শেলিং করতে থাকে।প্রচন্ড আক্রমনে ওদের প্রতিহত করতে না পেরে আমরা রিট্রিট করে পিছিয়ে এসে বিসয়খালী ব্রিজ উড়িয়ে দেই।এভাবে এক শক্তিশালী বাহিনীকে আমরা সেদিন ঠেকিয়ে দেই এক প্রচন্ড লড়াইয়ে।এখানে এই ব্রীজ উড়িয়ে না দিলে ঝিনেদা ফল করত ফলে আর কোন শরণার্থীই ভারত গমন করতে পারতনা।

লেখক ও সোর্স –

ছবি – বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ কামরুজ্জামান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!