১৭ এপ্রিল ১৯৭১ তৌফিক ইলাহি চৌধুরী
১৭ই এপ্রিল আমি আর মাহবুব সেই ঐতিহাসিক স্থানে ছুটলাম। অনাড়ম্বর আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। আমি তাঁদের নিয়ে এলাম বদ্যনাথতলার মণ্ডপে। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনটার একটা হাতল নেই, কোনটার একটা পায়া খোয়া গিয়েছে। মণ্ডপ পাহাড়া দেবার জন্য নিয়োজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। মাহাবুব আর আমি দ্রুত একটা অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করে ফেললাম। অন্যদেরও তা দেখালাম। আমরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেবার মত কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও মুজাহিদ মোতায়েন করি। মাহাবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার মহড়া শুরু করলো্ আমি তখন কর্ণেল ওসমানী ও অন্যদের সাথে ককেটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হাজার দুয়েক লোক জমায়েত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তাদের মধ্যে অন্তত: শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান।
নীরব আম্রকুঞ্জ। সমবেত গ্রামের মানুষের নিকট অতীতেও এমন কোন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়নি। আমরাও অনুষ্ঠানের কথা গোপন করে রেখেছিলাম। গ্রামের মানুষের শূন্যদৃষ্টির ভাষা আমরা বুঝতে পেরেছি। তারা যেন এক অঘটন ঘটতে দেখেছে- বিস্ময়াবিষ্ট, নিষ্পলক।
বেলা ১১ টা নাগাদ বহুপ্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানের সূচনা হল। আমি জীপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এমএজি ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তোরণের কাছে নিয়ে এলাম। মাহাবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে দাঁড়িয়ে জেনারেল ওসমানী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। একটা ছোট দল জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলো। একটা জাতির জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম। এমন জন্মের কাহিনী ইতিহাসে বহুবার পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস হয়না চোখের সম্মুখে একটি জাতি জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে। গার্ড অব অনারের পর ভাবী মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করলেন। সৈয়দ নজরুল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। তারপর এক এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দান করলেন। রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঘোষণা করা হলো, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নীচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর এই সমাধির উপরে একটি জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই জাতি হলো বাংলাদেশ। মানুষ এই ঘোষণাকে অভিনন্দিত করলো।
আমাদের মধ্যে কয়েকজন সম্মেলন কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার সহযোদ্ধারা প্রতিরক্ষাবুহ্য রচনা করে বসে রয়েছেন। মাহাবুব আর আমি চললাম আমাদের কর্মক্ষেত্রে। পথে আমরা উপলদ্ধি করলাম, একটি জাতি আজ জন্ম নিল বটে কিন্তু আজ যে শিশু জন্ম নিল সেই শিশুকে বিশ্বসভায় আসন গ্রহণের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা জানি এই পথ পাড়ি দেবার জন্য আরও রক্তমূল্য দিতে হবে। আমাদের কাহিনী রক্তাক্ষরে লিখতে হবে। এই মুহুর্তে আমাদের চিন্তা হলো, সদ্যজাত জাতি বড় হবে যেদিন, যেদিন বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন পাবে, সেদিন কি আমরা তা আজকের মত দেখার জন্য বেঁচে থাকবো?
সরকার গঠনের পর আমাদের সাথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একত্রীকরণ হয়। মেজর ওসমানের নেতৃত্বাধীনে আমাদের সৈন্য শার্শা-নাবারণ এলাকায় মোতায়েন করা হয়। এই সময় উল্লেখযোগ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন এবং ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে মেহেরপুরে এসেছিলেন তারাও এপ্রিলের আনুমানিক দশ তারিখে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের সাথে যুদ্ধে যোগ দেন। এই সময় আরো দুজন সামরিক অফিসার আমাদের সাথে যোগ দেন। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন হুদা, যিনি পাবনা থেকে পিছু হটে আমাদের সাথে যোগ দেন। আর অন্যজন ছিলেন ক্যাপ্টেন ওহাব। যিনি যশোহর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। শার্শা নাভারনের নতুন প্রতিরক্ষাবুহ্যকে আমরা শক্তিশালী করতে থাকি। এই সময় আমরা আর একজন নতুন মুক্তিযোদ্ধাকে পাই, যাকে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হয়। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনি সরাসরিভাবে প্রতিরক্ষাবুহ্যতে মোতায়েন ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন।