You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৪ এপ্রিল ১৯৭১
১৪ এপ্রিল স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনাবলীতে বলা হয়-
দেশবাসী ভাই বোনেরা,
হানাদার পাকিস্তানী পশুশক্তিকে বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে হটিয়ে দেবার ও বাঙ্গালীকে শোষণমুক্ত করে একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার দীপ্ত শপথ ও ব্রত নিয়ে বাঙ্গালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও নেতৃত্বে গত ১২ই এপ্রিল রাত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার পর থেকে মুক্তি সংগ্রাম ঠিক পূর্বের মতই এক সুস্পষ্ট গতিতে চলছে। প্রতিটি বাঙ্গালী আজ নিজ নিজ ঘরে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলে সংকল্পকে দৃঢ় থেকে আরও দৃঢ়তর করে তুলছে। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বাসঘাতক জঙ্গী পশু সরকারকে বিনাশ করে বিশ্বের দরবারে আজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে বলে-বাঙ্গালীর যুদ্ধ আজ আরও তীব্রতর; বিশ্বাস আজ অটুট; প্রতিটি বাঙ্গালী আজ সংগ্রাম থেকে অবিচ্ছিন্ন।
বাঙ্গালীর আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনে এ সরকারের রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন স্বাধীন বাংলার মহানায়ক বাঙ্গালীর প্রিয় বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাঁর সহকারী হিসেবে রয়েছে ত্যাগী ও শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করবেন এবং দেশরক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব ও অতিরিক্তভাবে তাঁর উপর ন্যস্ত। খোন্দকার মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত। স্বাধীন বাংলা সরকারের মন্ত্রী পরিষদে আর যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন জনাব মনসুর আলী, জনাব এএইচএম কামরুজ্জামান।
জনযুদ্ধের আশু সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সরকার সম্প্রতি কতকগুলো নির্দেশাবলী জারী করেন।
পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠী ও তাদের ভাড়াটিয়া হানাদার সৈন্যবাহিনী আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের উপর নগ্ন, পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালীর অপরাধ তারা অবিচারের অবসান চেয়েছে, বাঙ্গালীর অপরাধ তারা তাদের মা-বাপ, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততিদের জন্যে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা চিকিৎসার দাবী জানিয়েছেন, বাঙ্গালীর অপরাধ তারা মানুষের মর্যাদা নিয়ে মাথা তুলে বাঁচতে চেয়েছেন। বাঙ্গালীর অপরাধ আল্লাহতালার সৃষ্ট এ পৃথিবীতে, আল্লাহর নির্দেশমতে সম্মানের সাথে শান্তিতে সুখে বাস করতে চেয়েছে। বাঙ্গালীর অপরাধ মহান স্রষ্টার নির্দেশমত অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে এক সুন্দর ও সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার সংকল্প ঘোষণা করেছে।
মানবতার বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনী দানবীয় শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সহায় আধুনিক মরণাস্ত্র আর আমাদের সহায় পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার সাহায্য, বাংলাদেশের জনসাধারনের অটুট মনোবল, মুক্তিলাভের দৃঢ় সংকল্প, শত্র“ সংহারের অবিচল প্রতিজ্ঞা।
বাংলাদেশের এ সংগ্রামে দল, মত, শ্রেণী, ধর্ম নেই। বাংলার মাটি, পানি, আলো, বাতাসে, লালিত-পালিত মানুষের আজ একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙ্গালী। তাই বাংলার ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, ধনিক-বণিক, নারী-পুরুষ সকলকেই মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সহায়তা করতে হবে, মুক্তি সৈনিকের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। বাংলার মাটি থেকে শত্র“কে উৎখাত করার জন্যে প্রত্যেককেই এগিয়ে যেতে হবে।
নির্দেশাবলীঃ
১। প্রতি শহর/ গ্রামে/ মহল্লায় এক-একজন অধিনায়ক নির্বাচিত করে সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে; আরও ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে শত্র“র সাথে অসহযোগ প্রতিরোধ সংঘাতের দুর্বার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
২। নিজ নিজ এলাকার খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদার হিসাব রাখতে হবে আর চাহিদা মেটাবার জন্যে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াবার আর সংগ্রহ করবার চেষ্টা করতে হবে।
৪। দৈনন্দিন জীবনে সংগ্রাম ও কৃচ্ছতা চালিয়ে যেতে হবে। সর্ব প্রকার বিলাসিতা ত্যাগ করে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে পারস্পরিক মমত্ববোধ ভ্রাতৃত্বের হাতকে দুঢ়তর করতে হবে। আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে আত্মনির্ভর বলিষ্ঠ গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
৫। শত্র“কে চিনতে হবে। অবাঙ্গালী সামরিক, বেসামরিক শত্র“ তো আছেই। তারা কমবেশী চিহ্নিত। মারাত্মক হলো ঘরের শত্র“। ধর্মের দোহাই দিয়ে, অখন্ডতার বুলি আওড়িয়ে কালোবাজারী মজুতদারী বেশে শত্র“র চর সরলপ্রাণ বাঙ্গালীর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। এরা দোস্ত হিসেবে মনে ঠাঁই পেতে চায়। একবার ওদের খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার পাওয়া যাবে না। এ ধরনের লোকদের চিনে রাখতে হবে। বিশ্বাসঘাতকতার পথ ছেড়ে দেয়ার জন্যে তাদের বলতে হবে। তবুও যদি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় না হয় তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তাদের নাম-ঠিকানা জানিয়ে দিতে হবে এবং কর্তৃপক্ষ দেশদ্রোহীর নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।
৬। গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষণশিবিরে রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা রয়েছে। গ্রামের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও এরা প্রয়োজনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন।
৭। গ্রাম/ শহর অথবা মহল্লার নেতারা নিজেদের মধ্যে নেতা নির্বাচন করে গ্রাম-গ্রামান্তরে যোগাযোগ ও পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা রক্ষার জন্যে প্রচেষ্টা চালাবেন। এর উপরের স্তরের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকবে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের হাতে।
৮। বাংলাদেশের সকল মুক্তি এলাকায় সরকারী, আধাসরকারী, বে-সামরিক কর্মচারীরা স্তরে স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশে কাজ করবেন। শত্র“ কবলিত এলাকায় জনপ্রতিনিধিরাই ব্যক্তি বিশেষে অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা করবেন।
৯। সকল সামরিক, আধা সামরিক, কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বাঙ্গালী কর্মচারী অনতিবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন এবং কোন অবস্থাতেই শত্র“র সহযোগিতা করবেন না।
১০। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষভাবে নৌ-চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোন অবস্থাতেই শত্র“র সাথে সহযোগিতা করবেন না এবং যতদূর সম্ভব যানবাহনাদি নিয়ে মুক্ত এলাকায় চলে আসবেন।
গুজবে কান দেবেন না। গুজব রটাবেন না। নিজের উপর বিশ্বাস হারাবেন না। মনে রাখবেন আপনার এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দুশমন বাঙ্গালী মুসলমান নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা কাউকে হত্যা করতে, বাড়ীঘর লুট করতে, জ্বালিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। মসজিদের মিনারে আজান প্রদানকালে মুয়াজ্জেম, মসজিদ-গৃহে নামাজরত মুসল্লী, দরগাহ-মাজারে আশ্রয়প্রার্থী হানাদারদের গুলি থেকে বাঁচেনি। এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তা’লার উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন।
স্মরণ করুণ ঃ আল্লাহ প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন
‘‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যত নিশ্চয়ই সুখকর’’।
বিশ্বাস রাখুন
‘‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী’’।
জয় বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব!
জয় বাংলা!

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!