দল ভাঙ্গাভাঙ্গির রাজনীতিঃ
৫৫. জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের (জাগদল) আহবায়ক ও উপরাষ্ট্রপতি জনাব বিচারপতি আব্দুস সাত্তার জাগদল সম্পর্কে বলেন যে, ফ্রন্ট ঠিকই আছে, তবে আমাদের নিজস্ব পার্টি জাগদলকে সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মনােযােগ দিচ্ছি। তিনি পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশে জাগদল গঠিত হয়েছে। জাগদল আহবায়ক সুস্পষ্টভাবে জানান যে, সকল বাস্তব অর্থে রাষ্ট্রপতি হচ্ছে জাগদলের নেতা।জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারী উদ্যোগে কযেকটি দল নিয়ে এক দল গঠনের চেষ্টা চলছে। সরকারী মহলেরই কেউ কেউ একদল গঠনের ঘােরতর বিরােধী। বর্তমানে একদল গঠনের পক্ষে এবং বিপক্ষে বামপন্থী মন্ত্রী এনায়েত উল্লাহ খান সাম্প্রতিক ভাষণে বলেছেন যে, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে জাতীয় ঐক্য, তিনি সংগঠনের ভিতরে ও বাইরে ঐক্য গড়ে তােলার জন্য আহবান জানিয়েছেন। জনাব এনায়েত উল্লাহ খানের বক্তব্যের মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের সকল অংশও দলকে নিয়ে একটি দল গঠন করা। জনাব। এনায়েত উল্লাহ খানের এই আহবান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার আহবানেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। এদিকে জাগদলের আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও মৎস্যমন্ত্রী জনাব ওবায়দুর রহমান সম্প্রতি চাঁদপুরে এক জনসভায় ঘােষণা দিয়েছেন যে জাগদলের কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ তিনি চান না যে, কতিপয় দলকে একত্রিত করে নিয়ে জাগদলের বিলুপ্তি সাধন করা হােক। ৪ঠা জুলাই ‘৭৮ সমাপ্ত জাগদলের জেলা ও মহকুমার কমিটির আহবায়কদের সম্মেলন পন্ড হয়ে যায়। এই সম্মেলনের শুরুতেই এক দল গঠনের প্রশ্নে মতবিরােধ দেখা দেয় এবং সেদিন বিকেলে হােটেল ড্যাফোডিল প্রাঙ্গণে শ্লোগান পাল্টা শ্লোগানের পর এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ধাওয়া করে, হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নেয়া এবং পরিশেষে কোন সুরাহা ছাড়া অধিবেশন শেষ হয়। ড্যাফোডিলের ঘটনা শেষ হওয়ার পরে একটি গ্রুপ জনাব মােজাম্মেল হকের নামে এক বিবৃতি প্রচার করে। তিনি বলেন যে, তার হাত থেকে স্বার্থবাদী মহলের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা একটি কাগজ ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে মারতে উদ্যত হয়। বলা বাহুল্য, এই কাগজে এক দল গঠনের সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ছিলেন।পরদিন আরও ১৫ জন সদস্য ও ৬৪ জন আহবায়ক এক যুক্ত বিবৃতিতে অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য আহবান জানান। বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক ঐক্যবিরােধী ক্ষমতা লােভী অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য আহবান জানানাে হয়। সিনিয়র মন্ত্রী ও ন্যাপের জনাব মশিউর রহমান তার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন।
আভাসে ইঙ্গিতে তিনিও একদল গঠনের পক্ষপাতী। একদল গঠিত হলে কাজী জাফর আহমাদের অসুবিধা হবে, তবে কর্মীরা একদলে যেতে রাজী নয়। তারা তাদের পার্টির অস্তিত্ব বিলােপের বিরােধী। কাজী জাফর যদি একদল গঠনে রাজী হয়ে নিজের দলের পৃথক সত্ত্বার বিলােপ সাধনে রাজী হন তবে কর্মীদের হারাতে হবে। বর্তমানে কাজী জাফরের সামনে বিরাট সমস্যাএদিকে মুসলিম লীগের সাথে এক হওয়া, তাদের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করাটাও ইউপিপির ঘােষিত নীতির পরিপন্থী। এখন একটু তলিয়ে দেখা যাক, ঐক্য ও একদল গঠনের প্রশ্নে এই মতবিরােধ কেন? উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জনাব এনায়েতউল্লাহ খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, এদেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতি উত্থাপনের সম্ভাবনা খুবই কম। বামপন্থীরাই রাজনীতিতে প্রাধান্য পাবে জনাব খানের বর্তমান ভূমিকা ও তার উপরােক্ত বক্তব্যের অনেক মিল আছে। কিন্তু জনাব আবুল হাসানাত, জনাব মওদুদ, জনাব শাহ আজিজুর রহমানসহ মুসলিম লীগের সদস্যবৃন্দ, বিচারপতি জনাব সাত্তার, জনাব ওবায়দুর রহমান ও আরও অনেকে যারা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে আছেন তাদের পরিচয় কি? বর্তমান সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রী এবং সাবেক তথ্য উপদেষ্টা জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীও পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাদের দেশে বামপন্থী বলে কেউ আছে নাকি? এক সাথে ফ্রন্ট করছেন, মন্ত্রীসভায় আছেন, তাদের মধ্যে ডান-বামের লড়াই কেন? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শরীক হয়ছেন তাদের মধ্যে আদর্শের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না, আছে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে সংঘাত। অবশেষে জাগদল ২৯শে আগস্ট জিয়াউর রহমানের ঘােষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যােগদান করে।
দলকে টুকরাে টুকরাে করোঃ
৫৬. বাংলাদেশে দল ভাঙ্গা এবং দল গড়ার রাজনৈতিক খেলা জমে উঠছে। আর এর নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান। “জিয়া সাহেব সব দলই ভাঙ্গতে পেরেছেন, কিন্তু জাসদ তিনি এখনও ভাঙ্গতে পারেননি” দক্ষিণ বঙ্গের এক জনসভায় আ.স.ম. আব্দুর রবের এই উক্তির দিন পনের মধ্যেই জাসদে নাটকীয় ভাঙ্গন ধরেছে। মতাদর্শগত বিরােধ, নেতৃত্বের কোন্দল, এক শ্রেণীর নেতার লােভ-লালসা ও সুবিধাবাদী ভূমিকা ইত্যাদি ছাড়াও দেশে পাইকারী দল ভাঙ্গাভাঙ্গির আরেকটি কারণ হচ্ছে জিয়ার গােয়েন্দা বাহিনীর প্ররােচনা ও প্রয়াস। বাকশাল গঠিত হবার আগে দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল দেড় ডজনের মত। গত পাঁচ বছরে নিত্যনতুন দল গজাতে গজাতে এবং পুরানাে দলগুলাে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কম-বেশী শ’ খানেক। মুসলিম লীগ ভেঙ্গে চার টুকরো হয়েছে, ন্যাপ হয়েছে দুভাগ, ভাসানী ন্যাপ তিন চার ভাগ, জনতা পার্টি দু’ভাগ, সাম্যবাদী দল দু‘ভাগ, পিপলস লীগ দু’ভাগ, আইডিএল দু’ভাগ, জাগমুই দু’ভাগ, ইউপিপি তিন ভাগ এবং ভাসানী ন্যাপের নূরুল জাহিদ গ্রুপও আবার দু‘টুকরা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভাঙার চক্রান্ত অব্যাহত আছে।
জিয়ার মার্শাল ডেমােক্রেসী : পার্লামেন্ট নির্বাচন
৫৭. ‘৭৯ সনের নতুন বছরের শুরু। সামরিক বাহিনী,গােয়েন্দা বাহিনী, পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডিসি এসপি এদের বিরাট বহর নিয়ে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক
আইন প্রশাসক, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান, প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নির্বাচনী প্রচারে অবতীর্ণ হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচার না বলে এটা যেন নির্বাচনী যুদ্ধ। সিলেটের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বিরােধী দলের বিশেষ করে আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে চিরাচরিতভাবে বলেছেন, “কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের অতীত অপকর্মের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সামনে হাজির হতে ভয় পাচ্ছে।” ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে পার্লামেন্টে নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন জিয়াউর রহমান অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত ঘােষণা করে এবং নির্বাচন চাওয়ার অপরাধে র্যাংক এন্ড ফাইল আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কোনদিন ভয় পায়নি-বরং জিয়াই তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভীত হয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচন বন্ধ করেছিলাে।
৫৮. পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দাবী ছিল পরিষ্কার। দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ৪র্থ সংশােধণী বাতিল করে ১৯৭২ সনের সংসদীয় পদ্ধতির সংবিধান চালু, সেনাবাহিনীর পদ হতে পদত্যাগ, জরুরী আইন প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং উচ্চতর আদালতে আপীলের ব্যবস্থা-এসব দাবী জনগণের দাবী। জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যথার্থভাবেই নির্বাচনের পূর্বে এসব দাবী উত্থাপন করেছে।
৫৯. প্রেসিডেন্ট এসব দাবী যদি মেনে নিতেন তারপরও যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করতাে তাহলে প্রেসিডেন্টের ভাষণের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যেতাে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘােষণা দিয়েছেন। এই ঘােষণা যদি বাস্তব অর্থে কার্যকরী করতে হয় তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পূর্বেই মার্শাল ল প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মার্শাল ল তুলবেন জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে। মার্শাল ‘ল আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনক্রমেই জনগণের কাঙ্খিত নয়, এতে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলনও হবে না। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যখন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তখন সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষতা থাকে না, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্নই ওঠেনা।
৬০. প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানের মাথা গরম হয়ে আছে। ১৯৭৯ সনের ২রা জানুয়ারী নতুন দল বিএনপির জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত বাস-ট্রাক, লঞ্চ ব্যবহার করে ১০/২০ টাকা করে লােক ভাড়া করে আনার পর পল্টনের মিটিং-এ যে জনসমাবেশ হয়েছে, মিটিং কতটা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বচক্ষে দেখেছেন ও উপলব্ধি করেছেন। ভাড়া করা লােক এসেছে ঠিকই কিন্তু মিটিং-এ বসেনি। এদিক ওদিক ঘােরাফেরা করেছে। শ্লোগান দেয়নি, হাততালি দেয়নি বা দিতে অভ্যস্ত নয়-এমন লােকদের জড়ো করায় নিরুত্তাপ জনসভায় জিয়াউর রহমান ক্ষুব্ধ।
৬১. এই বিক্ষুব্দ চিত্র নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিএনপির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পার্লামেন্ট নির্বাচনকে ‘জনগণের জন্য এক অগ্নীপরীক্ষা” বলে অভিহিত করেছেন। জনগণের জন্য “অগ্নিপরীক্ষা না হলেও জিয়ার জন্য সত্যিই এটা অগ্নিপরীক্ষা। কেননা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট হতে সামরিক ফরমান, বিধি, প্রবিধান, বিজ্ঞপ্তি, জারী করে যে ৫ শতাধিক গণবিরােধী আইন, নির্দেশ, বলবৎ করা হয়েছে তা সংসদে পাশ করার জন্য প্রয়ােজন দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের। পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসন লাভ না করতে পারলে জিয়াউর রহমানের সামনে ভীষণ বিপদ অপেক্ষা করছে।
জিয়া সশস্ত্রবাহিনীর পােশাক পরতে পারেন নাঃ
৬২. জিয়াউর রহমান এটা যথার্থভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে সামনে তার সমূহ বিপদ। ২রা জানুয়ারী জনগণের চেতনা ও উপলব্ধি করে জিয়াউর রহমান সরাসরি মাঠে নেমে পড়লেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি হতে যে সমস্ত ব্যক্তিদের মনােনয়ন দিয়েছিলেন তাদের একটাই যােগ্যতা ছিল যে, তারা ক্ষমতাসীন দলের লােক। জিয়া নিজেই প্রার্থীদের সার্টিফিকেট দিয়ে চলেছেন। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, আনসার, ভিডিপি দ্বারা লােক জোগাড় করে এনে তিনি জনসভায় প্রার্থীর হাত ধরে উচু করে বলছেন যে, প্রার্থী সৎ ও ভালাে মানুষ। রাজাকার যে প্রার্থী হয়েছে তার সম্পর্কে সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বলছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য এর অবদান ভুলবার নয়,পাশে থাকছে শাহ আজিজ, মশিউর রহমান প্রমুখ। গাড়ী, হেলিকপ্টার, জলযান ব্যবহার করে দেশের প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট নির্বাচনে ঝাপিয়ে পড়েছেন।
Source: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
জিয়ার রাজত্ব (ধারাবাহিক পর্ব)দল ভাঙ্গাভাঙ্গির রাজনীতি৫৫. জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের (জাগদল) আহবায়ক ও উপরাষ্ট্রপতি জনাব বিচারপতি আব্দুস সাত্তার জাগদল সম্পর্কে বলেন যে, ফ্রন্ট ঠিকই আছে, তবে আমাদের নিজস্ব পার্টি জাগদলকে সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মনােযােগ দিচ্ছি। তিনি পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশে জাগদল গঠিত হয়েছে। জাগদল আহবায়ক সুস্পষ্টভাবে জানান যে, সকল বাস্তব অর্থে রাষ্ট্রপতি হচ্ছে জাগদলের নেতা।জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারী উদ্যোগে কযেকটি দল নিয়ে এক দল গঠনের চেষ্টা চলছে। সরকারী মহলেরই কেউ কেউ একদল গঠনের ঘােরতর বিরােধী। বর্তমানে একদল গঠনের পক্ষে এবং বিপক্ষে বামপন্থী মন্ত্রী এনায়েত উল্লাহ খান সাম্প্রতিক ভাষণে বলেছেন যে, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে জাতীয় ঐক্য, তিনি সংগঠনের ভিতরে ও বাইরে ঐক্য গড়ে তােলার জন্য আহবান জানিয়েছেন। জনাব এনায়েত উল্লাহ খানের বক্তব্যের মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের সকল অংশও দলকে নিয়ে একটি দল গঠন করা। জনাব। এনায়েত উল্লাহ খানের এই আহবান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার আহবানেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। এদিকে জাগদলের আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও মৎস্যমন্ত্রী জনাব ওবায়দুর রহমান সম্প্রতি চাঁদপুরে এক জনসভায় ঘােষণা দিয়েছেন যে জাগদলের কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ তিনি চান না যে, কতিপয় দলকে একত্রিত করে নিয়ে জাগদলের বিলুপ্তি সাধন করা হােক। ৪ঠা জুলাই '৭৮ সমাপ্ত জাগদলের জেলা ও মহকুমার কমিটির আহবায়কদের সম্মেলন পন্ড হয়ে যায়। এই সম্মেলনের শুরুতেই এক দল গঠনের প্রশ্নে মতবিরােধ দেখা দেয় এবং সেদিন বিকেলে হােটেল ড্যাফোডিল প্রাঙ্গণে শ্লোগান পাল্টা শ্লোগানের পর এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ধাওয়া করে, হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নেয়া এবং পরিশেষে কোন সুরাহা ছাড়া অধিবেশন শেষ হয়। ড্যাফোডিলের ঘটনা শেষ হওয়ার পরে একটি গ্রুপ জনাব মােজাম্মেল হকের নামে এক বিবৃতি প্রচার করে। তিনি বলেন যে, তার হাত থেকে স্বার্থবাদী মহলের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা একটি কাগজ ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে মারতে উদ্যত হয়। বলা বাহুল্য, এই কাগজে এক দল গঠনের সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ছিলেন।পরদিন আরও ১৫ জন সদস্য ও ৬৪ জন আহবায়ক এক যুক্ত বিবৃতিতে অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য আহবান জানান। বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক ঐক্যবিরােধী ক্ষমতা লােভী অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য আহবান জানানাে হয়। সিনিয়র মন্ত্রী ও ন্যাপের জনাব মশিউর রহমান তার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন।আভাসে ইঙ্গিতে তিনিও একদল গঠনের পক্ষপাতী। একদল গঠিত হলে কাজী জাফর আহমাদের অসুবিধা হবে, তবে কর্মীরা একদলে যেতে রাজী নয়। তারা তাদের পার্টির অস্তিত্ব বিলােপের বিরােধী। কাজী জাফর যদি একদল গঠনে রাজী হয়ে নিজের দলের পৃথক সত্ত্বার বিলােপ সাধনে রাজী হন তবে কর্মীদের হারাতে হবে। বর্তমানে কাজী জাফরের সামনে বিরাট সমস্যাএদিকে মুসলিম লীগের সাথে এক হওয়া, তাদের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করাটাও ইউপিপির ঘােষিত নীতির পরিপন্থী। এখন একটু তলিয়ে দেখা যাক, ঐক্য ও একদল গঠনের প্রশ্নে এই মতবিরােধ কেন? উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জনাব এনায়েতউল্লাহ খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, এদেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতি উত্থাপনের সম্ভাবনা খুবই কম। বামপন্থীরাই রাজনীতিতে প্রাধান্য পাবে জনাব খানের বর্তমান ভূমিকা ও তার উপরােক্ত বক্তব্যের অনেক মিল আছে। কিন্তু জনাব আবুল হাসানাত, জনাব মওদুদ, জনাব শাহ আজিজুর রহমানসহ মুসলিম লীগের সদস্যবৃন্দ, বিচারপতি জনাব সাত্তার, জনাব ওবায়দুর রহমান ও আরও অনেকে যারা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে আছেন তাদের পরিচয় কি? বর্তমান সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রী এবং সাবেক তথ্য উপদেষ্টা জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীও পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাদের দেশে বামপন্থী বলে কেউ আছে নাকি? এক সাথে ফ্রন্ট করছেন, মন্ত্রীসভায় আছেন, তাদের মধ্যে ডান-বামের লড়াই কেন? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শরীক হয়ছেন তাদের মধ্যে আদর্শের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না, আছে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে সংঘাত। অবশেষে জাগদল ২৯শে আগস্ট জিয়াউর রহমানের ঘােষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যােগদান করে।দলকে টুকরাে টুকরাে করোঃ ৫৬. বাংলাদেশে দল ভাঙ্গা এবং দল গড়ার রাজনৈতিক খেলা জমে উঠছে। আর এর নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান। “জিয়া সাহেব সব দলই ভাঙ্গতে পেরেছেন, কিন্তু জাসদ তিনি এখনও ভাঙ্গতে পারেননি” দক্ষিণ বঙ্গের এক জনসভায় আ.স.ম. আব্দুর রবের এই উক্তির দিন পনের মধ্যেই জাসদে নাটকীয় ভাঙ্গন ধরেছে। মতাদর্শগত বিরােধ, নেতৃত্বের কোন্দল, এক শ্রেণীর নেতার লােভ-লালসা ও সুবিধাবাদী ভূমিকা ইত্যাদি ছাড়াও দেশে পাইকারী দল ভাঙ্গাভাঙ্গির আরেকটি কারণ হচ্ছে জিয়ার গােয়েন্দা বাহিনীর প্ররােচনা ও প্রয়াস। বাকশাল গঠিত হবার আগে দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল দেড় ডজনের মত। গত পাঁচ বছরে নিত্যনতুন দল গজাতে গজাতে এবং পুরানাে দলগুলাে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কম-বেশী শ’ খানেক। মুসলিম লীগ ভেঙ্গে চার টুকরো হয়েছে, ন্যাপ হয়েছে দুভাগ, ভাসানী ন্যাপ তিন চার ভাগ, জনতা পার্টি দু’ভাগ, সাম্যবাদী দল দু'ভাগ, পিপলস লীগ দু’ভাগ, আইডিএল দু’ভাগ, জাগমুই দু’ভাগ, ইউপিপি তিন ভাগ এবং ভাসানী ন্যাপের নূরুল জাহিদ গ্রুপও আবার দু'টুকরা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভাঙার চক্রান্ত অব্যাহত আছে।জিয়ার মার্শাল ডেমােক্রেসী : পার্লামেন্ট নির্বাচন৫৭. '৭৯ সনের নতুন বছরের শুরু। সামরিক বাহিনী,গােয়েন্দা বাহিনী, পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডিসি এসপি এদের বিরাট বহর নিয়ে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিকআইন প্রশাসক, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান, প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নির্বাচনী প্রচারে অবতীর্ণ হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচার না বলে এটা যেন নির্বাচনী যুদ্ধ। সিলেটের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বিরােধী দলের বিশেষ করে আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে চিরাচরিতভাবে বলেছেন, “কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের অতীত অপকর্মের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সামনে হাজির হতে ভয় পাচ্ছে।” ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে পার্লামেন্টে নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন জিয়াউর রহমান অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত ঘােষণা করে এবং নির্বাচন চাওয়ার অপরাধে র্যাংক এন্ড ফাইল আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কোনদিন ভয় পায়নি-বরং জিয়াই তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভীত হয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচন বন্ধ করেছিলাে।৫৮. পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দাবী ছিল পরিষ্কার। দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ৪র্থ সংশােধণী বাতিল করে ১৯৭২ সনের সংসদীয় পদ্ধতির সংবিধান চালু, সেনাবাহিনীর পদ হতে পদত্যাগ, জরুরী আইন প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং উচ্চতর আদালতে আপীলের ব্যবস্থা-এসব দাবী জনগণের দাবী। জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যথার্থভাবেই নির্বাচনের পূর্বে এসব দাবী উত্থাপন করেছে।৫৯. প্রেসিডেন্ট এসব দাবী যদি মেনে নিতেন তারপরও যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করতাে তাহলে প্রেসিডেন্টের ভাষণের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যেতাে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘােষণা দিয়েছেন। এই ঘােষণা যদি বাস্তব অর্থে কার্যকরী করতে হয় তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পূর্বেই মার্শাল ল প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মার্শাল ল তুলবেন জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে। মার্শাল 'ল আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনক্রমেই জনগণের কাঙ্খিত নয়, এতে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলনও হবে না। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যখন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তখন সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষতা থাকে না, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্নই ওঠেনা। ৬০. প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানের মাথা গরম হয়ে আছে। ১৯৭৯ সনের ২রা জানুয়ারী নতুন দল বিএনপির জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত বাস-ট্রাক, লঞ্চ ব্যবহার করে ১০/২০ টাকা করে লােক ভাড়া করে আনার পর পল্টনের মিটিং-এ যে জনসমাবেশ হয়েছে, মিটিং কতটা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বচক্ষে দেখেছেন ও উপলব্ধি করেছেন। ভাড়া করা লােক এসেছে ঠিকই কিন্তু মিটিং-এ বসেনি। এদিক ওদিক ঘােরাফেরা করেছে। শ্লোগান দেয়নি, হাততালি দেয়নি বা দিতে অভ্যস্ত নয়-এমন লােকদের জড়ো করায় নিরুত্তাপ জনসভায় জিয়াউর রহমান ক্ষুব্ধ। ৬১. এই বিক্ষুব্দ চিত্র নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিএনপির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পার্লামেন্ট নির্বাচনকে ‘জনগণের জন্য এক অগ্নীপরীক্ষা” বলে অভিহিত করেছেন। জনগণের জন্য “অগ্নিপরীক্ষা না হলেও জিয়ার জন্য সত্যিই এটা অগ্নিপরীক্ষা। কেননা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট হতে সামরিক ফরমান, বিধি, প্রবিধান, বিজ্ঞপ্তি, জারী করে যে ৫ শতাধিক গণবিরােধী আইন, নির্দেশ, বলবৎ করা হয়েছে তা সংসদে পাশ করার জন্য প্রয়ােজন দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের। পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসন লাভ না করতে পারলে জিয়াউর রহমানের সামনে ভীষণ বিপদ অপেক্ষা করছে।জিয়া সশস্ত্রবাহিনীর পােশাক পরতে পারেন নাঃ৬২. জিয়াউর রহমান এটা যথার্থভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে সামনে তার সমূহ বিপদ। ২রা জানুয়ারী জনগণের চেতনা ও উপলব্ধি করে জিয়াউর রহমান সরাসরি মাঠে নেমে পড়লেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি হতে যে সমস্ত ব্যক্তিদের মনােনয়ন দিয়েছিলেন তাদের একটাই যােগ্যতা ছিল যে, তারা ক্ষমতাসীন দলের লােক। জিয়া নিজেই প্রার্থীদের সার্টিফিকেট দিয়ে চলেছেন। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, আনসার, ভিডিপি দ্বারা লােক জোগাড় করে এনে তিনি জনসভায় প্রার্থীর হাত ধরে উচু করে বলছেন যে, প্রার্থী সৎ ও ভালাে মানুষ। রাজাকার যে প্রার্থী হয়েছে তার সম্পর্কে সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বলছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য এর অবদান ভুলবার নয়,পাশে থাকছে শাহ আজিজ, মশিউর রহমান প্রমুখ। গাড়ী, হেলিকপ্টার, জলযান ব্যবহার করে দেশের প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট নির্বাচনে ঝাপিয়ে পড়েছেন। Source: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
Posted by সংগ্রামের নোটবুক on Friday, January 17, 2020