১১ এপ্রিল কালুরঘাট যুদ্ধ নিয়ে মীর শওকত এর সাক্ষাতকার
প্রঃ আপনার কমান্ডে সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ কোথায় এবং কখন সংঘঠিত হয়েছিল?
উঃ প্রথম ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল কালুরঘাটে ১১ই এপ্রিল’ ৭১। ঐ সময় জেনারেল জিয়া আমার সাথে ছিলেন না। তিনি ৩০শে মার্চ’ ৭১ এর পর ই রামগড় চলে গিয়েছিলেন।
এই যুদ্ধ পরিচালনা আমার কমান্ডে হয়। সৈন্য ছিলেন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বি ডি আর এবং স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী যেমন ছাত্র, শ্রমিক এবং অন্যান্য যারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন এমন কিছু লোকজন। আমার পক্ষে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর দুটি ব্রিগেড।এ ছাড়া কর্ণফুলীতে তাদের যে নৌ জাহাজ ছিল সেটি তারা শংখ নদী হয়ে কালুরঘাটের কাছাকাছি নিয়ে এসে ওখান থেকে নেভাল গান দিয়ে আমাদের এলাকায় বম্বিং শুরু করে দিয়েছিল। তাদের ব্রিগেডের যে আর্টিলারী ছিল সেই আর্টিলারী দিয়েও তারা বম্বিং করতে থাকে ১০ই এপ্রিল ‘৭১ থেকে। ১১ই এপ্রিল তাদের কিছু সৈন্য মহিলার পোশাক এবং কিছু সৈন্য সিভিল এর পোশাক পরে জয়বাংলা বলতে বলতে আমাদের দিকে অর্থাৎ কালুরঘাটের পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চট্টগ্রামে আমাদের পক্ষে এবং তাদের বিপরীতে ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুন, শমসের মবিন চৌধুরী, লেঃ মাহফুজ এবং অন্য কয়েকজন অফিসার। এই অবস্থায় আমাদের লোকজন প্রথমে বুঝতে পারেন নি তারা পাকিস্তানী। যখন শত্রু জয়বাংলা বলতে বলতে একেবারে কালুরঘাটের পুলের ওপর চলে এলো, তখনই মাত্র আমাদের লোকজন বুঝতে পারলেন যেতারা সিভিলিয়ান বা মহিলা কেউ নন। তখন আমাদের পক্ষ ফায়ার করতে শুরু করলেন। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন হারুন এবং শমসের মবিন আহত হলেন। মাহফুজ চলে আসতে পেরেছিলেন। কালুরঘাট ছেড়ে আমরা পটিয়ার দিকে চলে এলাম।
প্রঃ তখন আপনারা মোট কতজন ছিলেন?
উঃ আমরা প্রায় সাড়ে তিনশর মত ছিলাম। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মিঠঠা খান হেলিকপ্টার থেকে ওদের পক্ষে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল (পরে জেনেছি)
প্রঃ এই যুদ্ধে আপনাদের প্রধান অস্ত্র কি ছিল?
উঃ আমাদের কিছু রাইফেল ছিল, কিছু এল এম জি এবং দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার ছিল। এই মর্টার দু’টির কোন অবলোকন ব্যবস্থা (Aiming Sight) ছিল না। আন্দাজে ছুঁড়তে হত।
প্রঃ আপনাদের পক্ষে হতাহত কেমন হয়েছে?
উঃ আমাদের পক্ষে তেমন হতাহত হয় নি, ওদের পক্ষে কতজন হতাহত হয়েছিল তাও বলা মুসকিল, তবে সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ইতিপূর্বে ৮ই এপ্রিল আর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তখন পাকবাহিনীর একটি দল কালুরঘাটের প্রায় এক মাইল উত্তরে একটি কৃষি ভবন দখল করে নিয়েছিল। পাকবাহিনীর শক্তি ছিল একটি প্লাটুন। পাকসেনারা ওখানে এসে পড়ায় শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি কয়েকজন অফিসারকে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্য বললে কেউ তখন এগুতে উৎসাহিত হলেননা। তবে আমার কথা মোতাবেক লেঃ শমসের মবিন চৌধুরী কিছু সৈন্য নিয়ে আক্রমন পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেননি। উপরন্তু এই আক্রমণ পরিচালনাকালে নায়েক নায়েব আলী পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এমনি আমি নিজে মাত্র ১০ জন সৈন্য নিয়ে ৯ই এপ্রিল হাওলাদার হামদু মিঞা, নায়েক তাহের এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন বি ডি আর সহ সকাল ৮:৩০ মিঃ সময়ে কৃষি ভবনে অবস্থানরত পাক ঘাটি আক্রমণ করি। আমার আক্রমণে প্রায় ২০ জন পাকসেনা (১জন ক্যাপ্টেন ও ১জন সুবেদারসহ) নিহত হয় এবং তারা ঐ পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়।
প্রঃ তারপর?
উঃ তারপর আমি কালুরঘাট ব্রীজের চট্টগ্রামের দিক পুনর্দখল করেছিলাম। ১০ই এপ্রিল ৭১ খবর পেলাম পাক সেনাবাহিনী পটিয়ার কালাপুলের দিক থেকে আমাদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করছে। আমি তখনই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীকে কিছু সৈন্য দিয়ে পটিয়ার কালাপুলে পাঠালাম। ১১ই এপ্রিল ভোরবেলা আমি নিজে পটিয়ায় কালাপুলের অবস্থা জানতে পেলাম। ঐ তারিখ সকাল ৮-৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন ওয়ালি আমাকে খবর পাঠালেন পাক সেনারা প্রায় সাত থেকে আটশত সৈন্য নিয়ে কালুরঘাট আক্রমন করেছে; ক্যাপ্টেন হারুন গুরুতররুপে আহত, লেঃ শমসের মবিন চৌধুরীর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংবাদ পেয়ে আমি ওয়ালিকে বললামঃ “আমাদের লোকদের একত্রিত করবার চেষ্টা কর, পরিস্থিতি ভালভাবে জেনে নাও, আমি আসছি”. সকাল ৯টার দিকে আমি কালুরঘাটে এসে পৌঁছাই। ওখানে গিয়ে আমি মেজর জিয়ার সাথে অয়ারলেসে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম।
পরে আমি তাদের সবাইকে পিছনে সরে আসতে বললাম। লেঃ মাহফুজকে মদনঘাট ডিফেনসে অবস্থান করতে বললাম যতক্ষণ না আমার কালুরঘাটের ডিফেনসের সবাই পিছু হটতে পারে। আমরা সবাই কালুরঘাট থেকে পটিয়াতে একত্রিত হলাম। এবং সেখান থেকে সবাই বান্দরবন রওনা হই। আমার সাথে সৈন্য ছিল প্রায় ৪৫০ জন (তৎকালীন ইপিআর পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট সহ)।
আমরা ১২ই এপ্রিল বান্দরবান পৌঁছেছিলাম। ঐ তারিখেই কাপ্তাই হয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছি। রাঙ্গামাটিতে আমরা ডিফেনস নেবার পর মহালছড়িতে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম। লেঃ জেনারেল মাহফুজ শত্রুর ওপর আঘাত হেনে চলেছিল। কিন্তু পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমনে টিকে থাকা দুরুহ বুঝে পার্শবর্তী নোয়াপাড়া নামক স্থানে ডিফেনস নেয়। সেখান থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে সার্থকভাবে ডিফেনস নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করলেন। শেষ পর্যন্ত আমার নির্দেশ ১৪ই এপ্রিল লেঃ মাহফুজ তার ২০০ এর বেশি কিছু সৈন্য নিয়ে মহালছড়িতে আমার সঙ্গে মিলিত হন। ছুটি ভোগরত ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের (আর্টিলারী) আমার কাছে ঐ তারিখে আসেন। বঙ্গ সন্তান সাহসী বীর ক্যাপ্টেন কাদেরকে মেজর জিয়া আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাকে আমার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অফিসারের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিতে পাঠালাম।