১১ এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসী সরকার বিষয়ে আমিরুল ইসলামের স্মৃতিচারণ
পরদিন ১১ই এপ্রিল সকালে নাশতা করে আমরা বিমানে উঠি। আগের রাতে প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কের অবসান হওয়ায় মনসুর ভাই যেন বেশ খুশী।
খুব নিচু দিয়ে আমাদের ছোট বিমান উড়ছে। দু’দেশের নেতাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে খোঁজ করার জন্য ময়মনসিংহ সীমান্তে আমরা খবর দিয়ে রেখেছিলাম। সৈয়দ নজরুলকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটি স্থানে গিয়ে প্রথমে শুনলাম, নেতৃত্বস্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে বিএসএফ-এর স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নীচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। এ কথা শুনে আমরা ‘ইউরেকা’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি।
মাত্র আড়াই ঘন্টা পরে তাঁরা দু’জন আসলেন। নজরুল ভাই জীপ থেকে প্রথমে নামেন। আমার সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে জানালাম ২৫শে মার্চের পর থেকে মান্নান সাহেব খুব কষ্টে দিনকাল কাটিয়েছেন। পাক বাহিনীর ভয়ে দু’দিন পায়খানায় পালিয়ে ছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে সড়ক পথে হেঁটে ময়মনসিংহ এসেছেন। তিনি একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই ও তাঁর ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে তাজউদ্দিন ভাই ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী তাঁকে অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন ভাইকে বিমানে মোবারকবাদ জানান। এই দৃশ্য দেখে আমরা সকলেই উৎফুল্ল হই। আমরা আবার বিমানে উঠি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল আগরতলা। আমরা বিমানে আসন গ্রহন করি। সামনের আসনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর ভাই। নজরুল ভাই বিমানে বসে ঢাকা থেকে পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি ডঃ আলীম চৌধুরীর ছোট ভাই-এর বাসায় থাকতেন। তিনি ছিলেন নজরুল ভাই-এর আত্মীয়। সেই বাসা থেকে পরচুলা ও মেয়েদের কাপড় পরিধান করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মনসুর ভাই এ কথা নিয়ে এমনভাবে ঠাট্টা করলেন যে বিমানে কেউ না হেসে থাকতে পারলেন না। আমাদের আগরতলা পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা এসে পৌঁছেছেন। কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা হলো। তাঁর চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত গোঁফ তিনি কেটে ফেলেছেন। প্রথমে চিনতেই পারছিলাম না। আমার নিজেরও দাড়ি কেটে ফেলেছি। দু’জনেই দু’জনকে ডেকে হাসি ঠাট্টা করলাম।
আগের রাতে খন্দকার মোশতাক এসেছেন। ডঃ টি হোসেন ঢাকা থেকে তাকে নিয়ে এসেছেন। এম আর সিদ্দিকী কয়েক দিন পূর্বে আগরতলা এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সিলেট থেকে আবদুস সামাদও এসে গেছেন। তাছাড়া তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলী চাষী ছিলেন।
আগরতলা সার্কিট হাউজ পুরোটা আমাদের দখলে। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং ভিন্ন একটি ঘরে অবস্থান করছেন।
ওসমানী যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরী করে ফেলেন। আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব না। ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন।
রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। খন্দকার খুবই মনঃক্ষুণ্ণ। নাটকীয়ভাবে তিনি বললেন, আমরা যেন তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেই। আর মৃত্যুকালে তার লাশ যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি ডঃ টি হোসেনের মাধ্যমে মোশতাক সাহেবের মনোভাব জানতে চাইলাম। মোশতাক ও টি হোসেন-এর মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। দু’জনেই এক জেলার লোক। পারিবারিক পর্যায়েও তাদের সম্পর্ক খুবই মধুর। তিনিই তাকে নিয়ে এসেছেন আগরতলায়।
টি হোসেনের সাথে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। সিনিয়র হিসেবে এই পদ তারই প্রাপ্য বলে তিনি জানিয়েছেন। সারা রাত পরামর্শ হলো।
অনিদ্রা ও দীর্ঘ আলোচনায় আমি খুবই ক্লান্তি অনুভব করি। এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী সভায় থাকতে রাজী হলেন, তবে একটা শর্ত হলো, তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। তাজউদ্দিন ভাই আমাকে একথা জানান। সবাই এতে রাজি হলেন। কেননা, একটা সমঝোতার জন্য এই ব্যবস্থা একেবারে মন্দ নয়। অবশেষে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিষয়টি সুরাহা হলো। একজন হেসে খবর দিলেন, তিনি যোগদানে রাজি হয়েছেন। উপস্থিত সকলে এক বাক্যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। সকলে জহুর ভাইকে মোনাজাত করতে অনুরোধ করলেন। তিনি কয়েকদিন পূর্বে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করে এসেছেন। তাঁর মাথায় তখনো মক্কা শরীফের টুপি। তিনি আধ ঘন্টা ধরে আবেগপ্রবণভাবে মোনাজাত পরিচালনা করেন। তাঁর মোনাজাতে বঙ্গবন্ধুর কথা, পাক দস্যুদের অত্যাচার, স্বজন হারানো, দেশবাসীসহ শরণার্থীদের কথা এলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেকের চোখে পানি এসে গেল। এই মোনাজাতের মাধ্যমে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিলাম।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। তাজউদ্দিন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বৈঠকে সবগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়।
এদিকে ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং-এর বৈঠকে যুদ্ধের বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। বৈঠকে এক পর্যায়ে আমি অংশ নেই। এর পূর্বে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লী কলকাতাসহ দেশের বাইরে ভেতরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়েছে। সব ক’টিতে আমি গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। যুদ্ধের ব্যাপ্তি, প্রকৃতি, সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝবার চেষ্টা করি।