জাগদল হ্যাজ কাম টু স্টে
১৬. ১৯৭৭ সনের জানুয়ারী মাসেই প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাগণ বলে বেড়াতে থাকেন জাতীয় সার্বভৌমত্ব সংহত করা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য একটি রাজনৈতিক কাঠামাে অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলিকে আগের চেয়ে আরাে বেশী তৎপরতা চালানাের সুযােগ দেয়া হবে। সার্বভৌমত্ব সংহত করা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকার একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ১৪
১৯শে জানুয়ারী প্রেসিডেন্টর অন্য এক উপদেষ্টা বাগেরহাটে সর্বস্তরের জন সাধারণের সামনে ঘােষণা করেন যে, “প্রস্তাবিত ফ্রন্টের ম্যানিফেস্টো হবে পূর্ণ গণতান্ত্রিক।”
১৭. মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহযােগী ও সেনা ছাউনির সহযােগিতায় ১৯৭৮ সনের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী জিযার ক্ষমতায় আগমনের গােপন ক্রীড়নক ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে আহবায়ক করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠনের অনুমতি পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলবিধির নিয়ম অনুযায়ী ও রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ চালানাের উদ্দেশ্যে আইযুব খানের পেয়ারা এন.এস.এফ নেতা ব্যারিস্টার আবুল হাসানাত ৭ই ফেব্রুয়ারী প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারী ‘৭৮ তারিখে দলটি সরকার কর্তৃক অনুমােদিত হয়। মেজর জেনারেল জিয়ার ও সেনা ছাউনির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপােষকতা, সাহায্য সহযােগতািয় গঠিত জাগদল-এর মেনিফেস্টোতে ঘােষিত হলাে সরকার পদ্ধতি হবে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির।১৫ [৪ঠা ফেব্রুয়ারি ৭৮ অবজারভার) আমলা, জেনারেল এবং বিদেশী কোম্পানীর বেতনভােগীরা উচ্চস্বরে ঘােষণা করতে থাকেন, ‘আফ্রিকা-এশিয়ার বৃহত্তম দল হিসেবে জাগদল টিকে থাকবে।” ১৮,
২৭শে ফেব্রুয়ারী জাগদলের ১১ দফার মূল লক্ষ্য ও কর্মসূচী প্রদান করা হয়। ১৬
জাগদলের ঘােষণাপত্রে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতির সরকারকে জোড়ালােভাবে সমর্থন জানিয়ে মন্তব্য করা হয়-রাষ্ট্রপতি জনগণের দ্বারা পরিচালিত হলে। স্বাভাবিকভাবেই গণবিমুখ ও স্বৈরতন্ত্রের পথ রদ হবে। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে আইন ও জাতীয় নীতি প্রণয়নে সহায়তা করার জন্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ থাকবে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারে আইন প্রয়ােগ ও নীতি বাস্তবায়নে সুষ্ঠুভাবে করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীমন্ডলীর ব্যবস্থাও থাকবে।
জাগদেল আহবায়ক কমিটি জিয়ার উপদেষ্টা
১৯. ২৩শে ফেব্রুয়ারী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-এর ১৬ সদস্যের আহবায়ক কমিটির নাম ঘােষিত হয়। দলের আহবায়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, সদস্যগণ হলেন পেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা সর্বজনাব সৈয়দ আলী আহসান, আব্দুল মমানেম খান, শামসুল হুদা চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নূরুল হক, এনায়েত উল্লাহ খান, মওদুদ আহমদ, জাকারিয়া চৌধুরী, এম আর খান, আবুল হাসানাত, এম এ হক, ক্যাপ্টেন (অবঃ) সুজাত আলী, আলহাজ্ব এম এ সরকার, আবুল কাশেম।
সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকে না।
২০. জাগদল সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায় শুধু নয় সরকারী অর্থে ও সহায়তায় গড়ে তােলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়। প্রতিবাদে বলা হয় উপরাষ্ট্রপতি ও উপদেষ্টামন্ডলী সরকারী কর্মচারী। সরকারী কর্মচারী হিসেবে তারা কোন দলের সদস্য হতে পারেন না। ১৭ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি উপরােক্ত মন্তব্য করে। জেনারেল ওসমানী জিয়াউর রহমানের সুরকারকে সামরিক সরকার হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এই সরকারের কোন কর্মকর্তা, উপদেষ্টা কোন রাজনৈতিক দলে যােগ দিলে কেবল সরকারের দল নিরপেক্ষ চরিত্র নষ্ট হয় না, এর ফলে বর্তমান সরকারের ভিত্তি সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও জাতির প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকারের বরখেলাপ করা হয়।”১৮ জাগদলের কাগজপত্র তৈরী, এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনের কাজেও সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগ করা হয়েছে। সরকারী স্টেশনারী ব্যবহার করে আমন্ত্রণ জানানাে ইত্যাদি সরকারী অর্থে দল গঠনের নজির কেবলমাত্র জেনারেল আইয়ুব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের সঙ্গেই তুলনীয়। অথচ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিবেশী ভারতে একটি জনসভার কাজে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরাগান্ধীর ব্যক্তিগত সচিবের জড়িত থাকার অভিযােগ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারপতি জগলােছন তার নির্বাচনই বাতিল করে দিয়েছিলেন।
অনিয়মের চ্যালেঞ্জ
২১. দেশে সামিরক আইনের অধীনে জারীকৃত রাজনৈতিক দল বিধির ৬ ও ৭ নং ধারায় দলের তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে চাদা গ্রহণ, রশিদ প্রদান, ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে তার পরিচালনার জন্য যে সমস্ত শর্ত যােগ করে দেয়া হয়েছিলাে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ১ম রাজনৈতিক সন্তান জাগদল তার কিছুই পালন করেনি। তাছাড়া সামরিক সরকারের বেতনভুক্ত উপদেষ্টা হিসেবে রাজনৈতিক দল গঠনে তাদের নৈতিক ও আইনগত অধিকার ছিলােনা। এ অবস্থায় জাগদল গঠিত হলে ঢাকা মুন্সেফ কোর্টে ১৯৭৮ সনে ৪ঠা মার্চে জাগদল গঠনের আইনগত দিক চ্যালেঞ্জ করা হয় কিন্তু সামরিক ফরমানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাগদলকে অনুমতি দেবার ফলে কোর্টের করার কিছুই ছিল। মামলাটি বর্তমান আকারে ও প্রকারে অচল বলে কোর্ট রায় দেয়। ১৯
২২. মামলার রায় যাই হােক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে উপদেষ্টাগণ ছিলেন বাস্তব অর্থেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সংবিধানে উপদেষ্টা পরিষদ বলে কিছুই ছিলাে না। এটা ছিলাে নিছক সাময়িক ব্যবস্থা, সামরিক ফরমানের মাধ্যমে গঠিত। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে জাগদল গঠন করলেও এর উপর ভরসা করতে পারছিলেন না। সরকারী সুযােগ-সুবিধা যানবাহন, হেলিকপ্টার, এমনকি সরকারী তােষাখানা হতে বিপুল অর্থ ব্যয়, প্রশাসন, সেনা চাউনি এবং গােয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করেও জিয়ার সামনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ও গ্রাম পর্যন্ত বিপুল অগণিত কর্মীবাহিনী জিয়ার হিসেবী মস্তি ক্ষকে ‘গরম করে রেখেছিলাে। জিয়াউর রহমানের হিসেবের যােগফলে বাম, ডান, স্বাধীনতা বিরােধী, মুক্তিযােদ্ধা সবকে মিলিয়ে একটি সুবিধাজনক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। তাছাড়া এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতাদের গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। যাদের সংখ্যা ছিল অর্ধ লক্ষাধিক। ২০
১৩, এমনি অবস্থায় জিয়াউর রহমানের ‘সবুজ সংকেত পেয়ে জাগদল-এর আহবায়ক কমিটির এক জরুরী সভা ১৯শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারের বাসভবনে। সভায় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির নির্বাচন ঘােষণাকে অভিনন্দন জানানাে হয়। এবং ঐ ঘােষণার আলােকে অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার অনুরােধ জানানাে হয়। সভায় রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশ গ্রহণ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলবিধি আইনের যে ধারা রাজনৈতিক দল গঠন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পরিপন্থী তা অবিলম্বে বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানাে হয়। অপর এক প্রস্তাবে রাজনৈতিক ক্রিয়াকে সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক করার জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে অবাধ ও প্রকাশ্য রাজনীতি করার অধিকার প্রদানের অনুরােধ জানানাে হয়।২১
২৪. জাগদল কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘােষণার নির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার দাবীর মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান টেলিভিশন ও রেডিওতে এসে ভাষণ দিলেন। ২১শে এপ্রিলের এই ভাষণে ঘােষণা করলেন, দেশে ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১লা মে থেকে ঘরােয়া রাজনীতির পরিবর্তে খােলা রাজনীতি শুরু হবে। সভা সমিতির করা যাবে। তবে মিছিল করা চলবে না।।
২৫. ২৬শে এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ চতুর্থ সংশােধনী বাতিলের দাবী জানান। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম চতুর্থ সংশােধনী বাতিল করে দেশে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি প্রচলনের জন্য মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তার ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেদিন এই বলে বাধা দিয়েছিলেন যে, নির্বাচিত সংসদই ঠিক করবে সরকার পদ্ধতি কি হবে। কিন্তু ৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে নির্ধারিত সে নির্বাচন হয়নি। জিয়া ক্ষমতা দখল করে বিচারপতি সায়েমকে বঙ্গভবন হতে বের করে দিয়ে নির্বাচিত সংসদের উপর সরকার পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা হরণ করে দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করেন। এই অবস্থায় ২৬শে এপ্রিল আওয়ামী লীগ ৪র্থ সংশােধনীর বাতিল এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখলের পর টেলিভিশন, বেতার ভাষণে মে মাসে তার প্রতি আস্থাসূচক গণভােট অনুষ্ঠানের কথা ও ১৯৭৮ সনের ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা ঘােষণা করে। কিন্তু জিয়া দেশবাসীকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি বরখেলাপ করে ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বানের ঘােষণা দেন।
ইলাবরেড ফ্রড
২৬. প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘােষণার পর ৭ দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষে আতাউর রহমান খান এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলােকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে, তাদের জনগণের সামনে হাজির হবার সুযােগ্ না দিয়ে, সভা সমাবেশ গণসংযােগ করার সুযােগ না দিয়ে প্রেসিডেন্ট ও তার উপদেষ্টা অফিসারগণ আড়াই বছর ধরে হাওয়াই জাহাজ ও সরকারী যানবাহনে ঘুরে ফিরে বালাদেশে অতঃপর মাত্র ৪২ দিনের নােটিশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ফরমান জারী করেছেন তা হচ্ছে একটি ইলাবরেড ফ্রড বা বিরাট ভাওতা।২২
Source: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইয়িদ