You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.10 | আমিরুল ইসলামের স্মৃতিচারণে তাজ উদ্দিন  - সংগ্রামের নোটবুক

১০ এপ্রিল ১৯৭১ আমিরুল ইসলামের স্মৃতিচারণে তাজ উদ্দিন
১০ই এপ্রিল বিভিন্ন অঞ্চল সফরের জন্য আমাদের বের হবার কথা। একটি ছোট্ট বিমানের ব্যবস্থা করা হলো। বিমানটি খুব নিচু দিয়ে উড়তে পারেন। তাজউদ্দিন ভাই, মনসুর ভাই, শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আমি লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দরে যাই। অন্যানের মধ্যে মিঃ নগেন্দ্র সিং আমাদের সঙ্গী হলেন। বিমানটি খুবই ছোট। এতে বসার মত ৫/৬ টি আসন ছিল। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করাই এই সফরের উদ্দেশ্য। পরদিন খুব ভোরে গাজা পার্কের বাড়ীতে কামরুজ্জামান ভাই-এর সাথে দেখা করে তাঁকে বিস্তারিত সব কিছু অবহিত করি। তাজউদ্দিন ভাই-এর অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে তাঁর আর কোন আপত্তি রইলো না।
খুব নিচু দিয়ে বিমান উড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৈরি অব্যবহৃত বিমানবন্দর বমলার কয়েকটিতে আমরা নামি। এগুলো বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছাকাছি।
ছোট ছোট বন্দরগুলো বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছাকাছি। একটি বিমান বন্দরে আমরা দুপুরের খাবার খাই। বিএসএফ-এর মাধ্যমে খবর দেয়া হলো কোন আওয়ামী লীগ নেতার খোঁজ পেলে পরবর্তী কোন বিমানবন্দরে তৈরি রাখতে।
উত্তর বঙ্গ তথা রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা অঞ্চলের কোন নেতা খুঁজে পাওয়া গেল না। এদের বেশীর ভাগ কোলকাতা এসে গেছেন। কিছুক্ষণ পর আমরা বাগডোগরা বিমান বন্দরে নামি। সেখান থেকে জীপে করে শিলিগুড়ি যাই। গোলক মজুমদার এখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এখানের কোন একটি জঙ্গল থেকে গোপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা প্রচারিত হবে।
এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন ভাই-এর প্রথম বক্তৃতা প্রচার করার পালা। তাজউদ্দিন ভাই প্রচারের জন্য চোখে অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা বক্তৃতার ক্যাসেট গোলক মজুমদারের কাছে দেয়া হলো।
শেখ মনির সাথে কথাবার্তা শেষে তাজউদ্দিন ভাই আমাকে ডাকেন। তিনি জানান, শেখ মনি এখন সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজী নন। আগরতলা গিয়ে দলীয় এমপি, এমএনএ ও নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক শেষে শেখ মনি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। আর এটা করা না হলে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
গোলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে আজ বক্তৃতা প্রচার করা হবে না। এ কথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিলম্ব করা কি ঠিক হবে? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব কিছু ঠিক ঠাক সে মুহুর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে প্রশ্ন দেখা দেবে। তা আমরা ভেবে দেখছি কিনা। ইতিমধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌঁছে গেছে।
আমি গোলক মজুমদারকে বললাম ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন, প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলাম। এই দিন ছিল দশই এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দিন ভাই ও শেখ মনি আছেন। রাত তখন সাড়ে ন’টা। সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসলো। প্রথমে আমার কন্ঠ ভেসে আসলো। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা প্রচারিত হলো। সারা বিশ্বব্যাপী শুনলো স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়লো। বক্তৃতা প্রচারিত হলো। পরে একক সিদ্ধান্তে বক্তৃতা প্রচারের জন্য তাজউদ্দিন ভাই-এর কাছে ক্ষমা ও শাস্তি প্রার্থনা করি। তিনি বলেছিলেন যে, সে সময় আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। সেদিন বক্তৃতা প্রচার না করলে গোলমাল আরো বৃদ্ধি পেত বৈকি। (স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র, ১৫ খণ্ড, সম্পাদিত)