You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.01.08 | ৮ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ শেখ মুজিব - রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডন - সংগ্রামের নোটবুক

৮ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ শেখ মুজিব – রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডন

মুক্তির শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি সদ্য স্বাধীন দেশেই ফিরতে চেয়েছিলেন। ভূট্টো শেখ মুজিবকে তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরান অথবা তুরস্ককে (ইস্তাম্বুল) বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে শেখ মুজিব তা নাকচ করে দেন। পরে শেখ মুজিবকে লন্ডন পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। শেখ মুজিব এ প্রস্তাব তাৎক্ষনিক গ্রহন করেন। কারণ বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস তখন ব্রিটেনে। ব্রিটেন প্রবাসীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছিল আত্মিক যোগাযোগ, সেই ১৯৫৬ সাল থেকেই, তিনি যখন প্রথম ব্রিটেনে এসেছিলেন। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন লন্ডনকে। রাত আড়াইটায় ভূট্টো শেখ মুজিবকে সিহালা রেস্ট হাউজ থেকে নিয়ে রওয়ানা হন চাকলালা বিমানবন্দরে। সাথে ডঃ কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী। রাত তিনটায় বিমান আকাশে উড্ডয়ন করে পিআইএ এর বিশেষ বিমান। বিমানে তখন পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন অফিসার ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিমান বন্দরে বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে বিদায় জানান ভূট্টো এবং পাঞ্জাব গভর্নর গোলাম মোস্তফা খার। বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে বিদায় জানিয়ে ভূট্টো বিমানবন্দর থেকে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসেন সকালে শাহ এর বিমান একই বিমান বন্দরে অবতরনের সময়। তখন ইরানের শাহের পাকিস্তান সফর ছিল। এ সময় বিদেশী সাংবাদিকরা ভূট্টোকে ঘিরে ধরলে তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির এবং তার পাকিস্তান ত্যাগের কথা প্রকাশ করেন। তবে তিনি তখন বলেছিলেন শেখ মুজিবের ইচ্ছায় চার্টার্ড বিমানে করে তার গন্তব্য স্থলে গিয়েছেন। পাকিস্তান রেডিও গ্রিনিচ সময় সকাল সাতটায় পাকিস্তান সময় সকাল ১১ টায় এ খবর প্রচার করে। তবে মুজিব কোথায় গিয়েছেন তা মুজিবের অনুরোধে প্রকাশ করা হয়নি বলে জানানো হয়। রাওয়ালপিন্ডির একজন মুখপাত্র বলেছেন তিনি গন্তব্যস্থলে পৌছার পর যেন তা প্রকাশ করা হয়। রওয়ানা হওয়ার আগে অনেকেই শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ প্রার্থী হলেও শেখ মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি, শনিবার সকাল সাড়ে ৬ টায় বিমান অবতরন করে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তরের দক্ষিন এশিয়া ডেস্কের প্রধান সাদারলেন্ড। খবর দেয়া হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি ছিলেন অবকাশে। খবর পেয়ে তিনি অবকাশ বাতিল করে রাজধানীতে দ্রুত ফিরে আসেন। পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকেই লন্ডনের ক্ল্যারেজ হোটেল বুক করা ছিল। সাংবাদিকগন শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ নিতে চাইলে তিনি তাদের বলেন এখন আমি শুধু দেখব কিছু শুনবো না। আজ কোন এক সময়ে আমি আপনাদের সাথে কথা বলব। বিমানবন্দরে শেখ মুজিব ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে আধাঘণ্টা কথাবার্তা বলেন। পররাষ্ট্র বিভাগ এ সময় তাকে তাদের দেয়া গাড়ী ব্যাবহারের অনুরোধ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। শেখ মুজিবের লন্ডন উপস্থিতির খবর পেয়ে ব্রিটেনের সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ, মিশন কর্মকর্তারা এবং বাঙ্গালীরা বিমানবন্দর ও ক্লারিজ হোটেলে সমবেত হন। নেতাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুজাম্মিল আলী, ব্যারিস্টার আনিস রহমান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, শেখ আব্দুল মান্নান, নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশারফ হোসেন (বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য), জাকারিয়া খান, (জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী), লুলু বিলকিস বানু, জেবুন্নেসা বক্স, গাউস খান, আতাউর রহমান খান, আব্দুল হামিদ, রমজান আলীসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, পাকিস্তান হাইকমিশনে উচ্চপর্যায়ে কর্মরত বাংলাদেশি তিন কূটনৈতিক মহিউদ্দিন আহমদ, রেজাউল করিম ও আজিজুর রহমান সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

এদের মধ্যে শুধুমাত্র মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে চাকরি ছেড়ে, সন্তানসম্ভাবা স্ত্রীকে নিয়ে এক অনিশ্চিত অবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষে এসে যোগ দিয়েছিলেন। ড. সুরাইয়া খানম (যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন পরবর্তী সময়ে),ছিলেন শেফালি বেগম ও আওয়ামী লীগ নেতা বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের আইরিশ স্ত্রী নোরা শরীফ। ৮ তারিখ সকালে হিথ্রো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী পাকিস্তানি বিশেষ ফ্লাইট অবতরণ করার আগে সকালের বিবিসি মর্নিং সার্ভিসে প্রথম ঘোষণা করা হয় শেখ মুজিব মুক্ত হয়ে লন্ডনে আসছেন। সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন (অবশ্য ততক্ষণে তিনি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে) কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে অবতরণ করবে। রয়টার্স সেদিন শিরোনাম করে ‘লন্ডনে শেখ মুজিব’।